লীগের সাংস্কৃতিক আধিপত্য
Advertisements

বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ চরিত্রগত দিক থেকে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ। এটা আমি গত ১৫ বছর ধরে বলে আসছি। বিগত বছরগুলোতে আমাদের সমাজে একধরনের সাংস্কৃতিক গণহত্যা (কালচারাল জেনোসাইড) চলেছে। লীগময় সংস্কৃতির বাইরে অন্য কোনো সংস্কৃতিকে বিকশিত তো দূরের কথা, মাথা তুলে দাঁড়াতেই দেওয়া হয়নি। তাদের নির্মূল করার সব রকমের আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের সাংস্কৃতিক ইন্ডাস্ট্রির চরিত্রও স্বাধীন নাগরিক সত্তার বিকাশের পরিপন্থী।

আমি যখন ফ্যাসিবাদ মোকাবেলার জন্য সাংস্কৃতিক প্রশ্নের মীমাংসাকে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেখার প্রস্তাব দিয়েছি, তখন অনেকেই আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। কারণ, লীগের বিরুদ্ধে যারা রাজনৈতিক লড়াই করেছেন, তারাও কমবেশি সেকুলার পরিসরের মধ্যে আটকে থাকার কারণে রাজনৈতিকভাবে এন্টি-লীগ ও এন্টি-শাহবাগী হলেও সাংস্কৃতিকভাবে শাহবাগী থেকে গেছেন। আমাদের বুদ্ধিজীবিতা বলতে যা বোঝানো হয়, তা মোটা দাগে শাহবাগী। এমনকি শাহবাগের বিরুদ্ধে যারা তিন-চারজন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ফ. ম. ওরফে দেহতত্ত্ববাদী খাটাশটাও সাংস্কৃতিকভাবে শাহবাগী (যদিও রাজনৈতিকভাবে এন্টি-শাহবাগী)। এরা ইসলামকে শত্রু মনে করেন খুব গভীরভাবে, কিন্তু ইসলামের প্রতি মানুষের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার হিসাব-নিকাশ করতে কোনো আপত্তি নেই। ফলে তাদের ইসলাম নিয়ে আলোচনা মানেই একপ্রকার নাস্তিকের ধর্মবাসনা।

অন্যদিকে, শাহবাগের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসেবে যারা অন্তরে গভীর মুনাফেকি নিয়ে শাপলার সাফল্য চাইছিলেন, তাদের বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি চলবে না। শাপলার উত্তরণের মধ্য দিয়ে শাহবাগ রাজনৈতিকভাবে রাজনীতিহীন হয়েছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক ইন্ডাস্ট্রি এখনও তাদের হাতে রয়ে গেছে এবং তাদের আদর্শই মূলধারায় টিকে আছে। ফলে শাহবাগের পরাজিত শক্তি নানা ছুতোয় ফেরত আসতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। এটা মাথায় রাখতে হবে।

এরা নারীর অধিকারের নামে আন্দোলন করতে থাকলে একসময় ধর্ষণ উৎসবে রূপ নেবে। কেননা, এদের রাজনৈতিক এজেন্সি হলো লীগ, আর লীগ মনে করে নারীদের ধর্ষণ করা তাদের অধিকার। আমি বারবার বলেছি, শাহবাগ হলো ইতিহাসের কষ্টিপাথর। এতে ঘষা দিয়ে যে কারো রাজনৈতিক চরিত্র বুঝে নেওয়া যায়। বেগম খালেদা জিয়া এটাকে বলেছিলেন ‘ধর্মনাশা’। এটি ছিল গণহত্যাকারী এক মব। এরাই নাগরিক ও গণতন্ত্রের ধারণার আওয়ামীকরণ করেছে।

সাংস্কৃতিকভাবে এই ধারাকে পুরোপুরি পরাজিত করতে হবে, নাহলে বাংলাদেশ লীগমুক্ত হবে না। চিন্তার দিক থেকে ‘এ কান্ট্রি উইদাউট লীগ’ নিশ্চিত হওয়ার পরেই বাংলাদেশের প্রকৃত বিকাশ শুরু হবে। লীগের সর্বশেষ অস্ত্র হলো সংস্কৃতি। তাদের ঢাল হলো— আলো, স্টার, ভারত।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইন্ডাস্ট্রিতে এই ধারাটি সবচেয়ে শক্তিশালী। একে মোকাবেলা করার জন্য ভণ্ড লোক দিয়ে হবে না, পপুলিস্ট উগ্রবাদী দিয়েও হবে না। দরকার কাউন্টার ন্যারেটিভ, চিন্তাশীল ও দার্শনিক হস্তক্ষেপ। ফকিন্নি এসথেটিকস সেন্স দিয়ে হবে না। নিৎসে বলেছেন, ‘ইভেন ভায়োলেন্স হ্যাজ অ্যান এসথেটিক সেন্স।’

আপনি একটা তেলাপোকা মারলে কেউ আপনাকে খারাপ বলবে না, বরং বাহবা দেবে। কিন্তু আপনি একটা প্রজাপতি মারলে সবাই আপনাকে নিষ্ঠুর বলবে। বিষয়টা বুঝতে হবে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদী (পড়ুন— হিন্দুত্ববাদী) তথাকথিত প্রগতিশীল, ইসলাম বিদ্বেষী রাজনীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির দার্শনিক বয়ানকে মূলধারা করতে হবে। ২০২৪-এর অভ্যুত্থান একটি ডানপন্থী অভ্যুত্থান। ফলে ডানপন্থার মধ্যেই একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আমাদের বের করতে হবে, যেখানে ইসলামের অনুসারীরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকবে না। তথাকথিত সেকুলার পরিসরের নামে ইসলামবিদ্বেষী পরিসরকে মূলধারায় রাখা চলবে না— এই অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে।

এই কারণে আমাদের একটি মূল্যবোধভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। যারা সংস্কৃতি চর্চা করতে চায়, তাদের তা করতে দিতে হবে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির চর্চার কোনো সুযোগ গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে দেওয়া যাবে না। আমি এগুলো নিয়ে অনেক বিস্তারিত বলেছি, লিখেছি, এবং বলছি। আশা করি, এখন বিষয়টা আরও পরিষ্কার।

আর একটি কথা, এরা ৫৪ বছর ধরে নারীবাদী আন্দোলন করছে, অথচ নারীরা দিন দিন আরও অনিরাপদ হয়ে উঠছে। তথাকথিত আধুনিক পরিমণ্ডলের বাইরে অন্য নারীদের বিষয়ে তাদের কোনো অবস্থান নেই, কোনো কথা নেই। তাদের এই সিলেক্টিভ মানবতাবাদ সরাসরি লীগের জাহেলিয়াতকে শক্তিশালী করেছে। নাগরিকভিত্তিক বাংলাদেশ গঠনের বদলে দেশকে বিভিন্ন গোত্রে (ট্রাইব) বিভক্ত করেছে। তাদের ‘জেন্ডারড ইসলামোফোবিয়া’র সঙ্গে নারীর অগ্রগতির কোনো সম্পর্ক নেই।

অন্যদিকে, আধুনিক নারীকে শত্রু মনে করার রাজনীতি ইসলামী ধারাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। নারীদের সমর্থন প্রয়োজন, আর সেটা তাদের ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করে সম্ভব নয়। শরীরের ধারণার দার্শনিক, সামাজিক ও নৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা তুলতে হবে। কথায় কথায় বিভাজন সৃষ্টি না করে বাইনারি ভাবনা ভেঙে ফেলতে হবে।

নারী ও শিশুবান্ধব সমাজ না হলে সুন্দর দেশ গড়া সম্ভব নয়। তাদের নিরাপত্তা না থাকলে কোনো অগ্রগতির অর্থ থাকবে না।

যাহোক, এগুলো নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে, এবং ভবিষ্যতেও করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ দেশ গঠনে যেকোনো বিভাজন রুখে দিতে হবে— সেটা হোক দলে, হোক লিঙ্গভিত্তিক। নারী-পুরুষ নয়, দল-মত নয়, তাই এখন শ্লোগান হবে—দল যার যার,রাষ্ট্র সবার।

রাষ্ট্র আমার কাছে জবাবদিহি করবে, আমার নিরাপত্তা দিতে বাধ্য থাকবে। এমন একটি দেশ গঠন করতে হবে।

Advertisements