১। ইসলাম যৌন নির্যাতন (sexual Violence) নিরোধকল্পে মূলত প্রতিরোধ ও প্রতিকার উভয় পন্থাই অনুসরণ করে। এ দুটো পদ্ধতির কোনও একটা দিকেই ব্যত্যয় ঘটলে মূলত ইসলামের যে সুরক্ষা প্রস্তাবনা তা অকার্যকর হয়ে পড়ে।
প্রতিরোধমূলক (preventive) ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে, নারীর জন্য পর্দার বিধান। সফরকালে সুরক্ষার জন্য সমর্থ পুরুষ রাখা। ঘরে অবস্থানের পরামর্শ। আর পুরুষদের জন্য দৃষ্টিকে অবনত রাখা।
নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই সংযমের চর্চা করা৷ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা নিশ্চিত করা। পর্ন ও অশ্লীলতার যাবতীয় পথ বন্ধ রাখা। দ্রুত বিবাহ নিশ্চিত করা৷
আর প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা বলতে মূলত আইনি প্রতিকারকে (Legal Remedy) নির্দেশ করে। যেখানে দ্রুত সময়ের মধ্যে অপরাধীর উপযুক্ত সাজা নিশ্চিত করা হবে প্রকাশ্য দণ্ড কার্যকরের মাধ্যমে।
যেন তা সম্ভাব্য অপরাধপ্রবণ মনোবৃত্তির লোকদের জন্য নজির হয়ে থাকে। ইসলাম প্রকাশ্য ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলে। একইসঙ্গে প্রকাশ্য দণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেয়। যেন অন্যদের জন্য তা শিক্ষা হয়।
ইসলামী বিচারব্যবস্থায় যৌনাপরাধ (Sexual offence) মূলত দুই ধরনের। একটা হচ্ছে, ইচ্ছাকৃত যৌনসম্পর্ক (Intentional sex) যা একটা নির্দ্দিষ্ট বয়স (Age of consent) পেরুবার পর বাঙলাদেশে বৈধ।
কিন্তু ইসলামি আইনে ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণের জন্য উদ্যত হওয়া, এমনকি শারীরিক আক্রমণ ছাড়া হুমকি প্রদানের মাধ্যমে ধর্ষণ করলেও সেটার সাজা ইসলামি আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি (Capital Punishment)।
বিবাহিত, অবিবাহিত যাই হোক, গ্রহণযোগ্য ও উপযুক্ত প্রমাণ পেলে দ্রুততম সময়ে দণ্ডারোপ করা হবে। এর জন্য চারজন সাক্ষীরও বাধ্যবাধকতা নেই। উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতেই দণ্ডারোপ করা যাবে।
২। আদতে ইসলামে ‘জিনা’ বা ‘ব্যভিচার’ আর ‘ধর্ষণ’ এক নয়। ধর্ষণ বুঝাতে আরবিতে ‘ইগতিসাব’ ব্যবহৃত হয়। ‘জিনা’ শব্দটাই আমরা যেন ‘ধর্ষণ’ অর্থে নিয়ে গেছি। ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। সঙ্কটটা এ জন্যেই তৈরি হয়েছে।
‘জিনা’ বলতে সেটাই যেটা আমাদের বিদ্যমান আইনে অপরাধ নয়, অর্থাৎ ‘ইনটেনশনাল সেক্স’, মানে সম্মতির ভিত্তিতে যৌন সম্পর্ক। আর ‘ইগতিসাব’ বা ধর্ষণ হচ্ছে বলপ্রয়োগপূর্বক কারও সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন।
সেমতে ধর্ষণ আর জিনা উভয়ের দণ্ডবিধান ইসলাম একভাবে করে না। মনে রাখতে হবে, জিনা বা ব্যাভিচার ব্যাক্তিগত জীবনাচারে ‘মোরালিটি’র চর্চা থেকে সরে গেলেই ঘটে। ধর্ম থেকে দূরে গেলেই এর বিস্তার হয়।
আর ধর্ষণ হচ্ছে মেজর ক্রাইম, পৃথিবীর কোনও সমাজে যেমন অন্যায় খুন একেবারে বন্ধ করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি এটাও। যেসব মানুষ এই ধরনের অপরাধ করে তার পেছনে কোনও কারণ দাঁড় করিয়ে ব্যাপারটাকে লঘু করা যায় না।
জিনার শাস্তি অবিবাহিত হলে একশ বেত্রাঘাত, আর বিবাহিত হলে মৃত্যুদণ্ড। আর ধর্ষণের ক্ষেত্রে এ ধরণের কোনও স্তরভাগ করা হয় নি। জিনার শাস্তির ক্ষেত্রে ইসলামকে তুলনামূলক নমনীয় দেখা যায়, এই কাজ থেকে গোপনে সংশোধনকে ইসলাম উৎসাহিত করে।
কিন্তু ইসলামে ধর্ষককে দেখা হয় ‘মুহাররিব’ হিসেবে, যার ইংরেজি অনুবাদ করা হয় “war against God and the state” অর্থাৎ রাষ্ট্র ও আল্লাহ্র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী। যে সমস্ত অপরাধীদের মুহাররিব বলে তাদের ব্যাপারে কোনও ছাড় নেই।
রাষ্ট্র তাদেরকে ‘সর্বোচ্চ অপরাধ’ তথা ‘Capital Crime’-এ অপরাধী হিসেবে সর্বোচ্চ সাজা তথা ‘Capital Punishment’ নিশ্চিত করতে বাধ্য।
কোরআন তাদের শাস্তি স্থির করছে,
১।মৃত্যুদণ্ড
২। হাত ও পা কেটে দেওয়া
৩। দেশান্তর বা দ্বীপান্তর।
এবার রাষ্ট্র অপরাধের ধরন ও প্রকৃতি অনুযায়ী সাজা নির্ধারণ করবে।
ইসলাম যে সমস্ত অপরাধীদের মুহারিব হিসেবে বিবেচনা করে তাদের ব্যাপারে কোনও ছাড় নেই। রাষ্ট্র তাদের উপর দণ্ড প্রয়োগে বাধ্য। কোনও অবস্থাতেই তাদের দণ্ড মওকুফ বা শিথিল করা যাবে না।
অপরাধীকে ক্ষমার যে সুযোগ বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে, ইসলামে এইধরনের ক্ষেত্রে সে সুযোগ রাষ্ট্রপ্রধানের নেই। বরং রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সমস্ত প্রতিষ্ঠান এই দণ্ড কার্যকরে বাধ্য।
সুতরাং ধর্ষণে নারীর পোশাক কি ছিল বা না ছিল সে বিষয় বিচারে বিবেচ্য নয়। এবার আসা যাক, পোশাক কি আসলেই ধর্ষণ রোধ করে? ইসলাম এ কথা বলে না যে, কেবল পর্দাই ধর্ষণ রোধ করে। ইসলাম বরং পর্দার বিধান দিয়েছে, কারণ এর দ্বারা ব্যাভিচার কমে, ধর্ষণের হার কমে।
প্রকৃতিগতভাবে যারা অপরাধী নয়, অন্তত এমন লোকদের দ্বারা ধর্ষণের ব্যাপার কঠিন হয়। কিন্তু ইসলাম কেবল নারীকেই এ ব্যাপারে বলে না, বরং পুরুষদেরকেও নিজেদের লজ্জাস্থান হেফাজত এবং চোখকে সংযত রেখে অবনতভাবে চলতে বলে।
আর শাসকগোষ্ঠীকে বলে বিচার নিশ্চিত করতে। জিনা বা ব্যভিচারের ব্যাপারে নারীর পোশাক নিয়ে প্রশ্ন যারা তুলে তারা যদি পুরুষের দৃষ্টি নিয়ে কথা না বলে বুঝবেন ইসলামের মুখোশে বরং সে ভণ্ডামি করতে এসেছে, অর্ধ সত্য প্রচার করতে।
আবার যারা পোশাককে এসবের জন্য কোনও কারণ বলেন না, যারা মনে করেন পর্দার প্রয়োজন নেই, পোশাকের স্বাধীনতার নাম করে পর্দাহীনতা চালু করতে চায় এরা মূলত সমাজে ব্যাভিচার চালু করতে চায়।
এরাও ধর্ষকপক্ষের অংশ। তারা মূলত নগ্নতা ও যৌনতার সহজলভ্যতার আলাপ এই ভিন্ন মোড়কে সুযোগ বুঝে বাজারে ছাড়ে।
৩। জিনা ও ধর্ষণ রুখতে পোশাক অতি অবশ্যই অন্যতম বিষয়, তেমনি পুরুষের দৃষ্টি নত রাখাও। এতে খোদায়ী নিরাপত্তা কায়েম হয়। আর এই জন্যেই পোশাকের স্বাধীনতার অবাধ রাষ্ট্র আমেরিকায় যতবেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, মুসলিম বিশ্বের কোথাও এরকম ঘটে না।
এমনকি পতনের এই কালেও সেই হার অনেক কম। আসলে মূল কথা হচ্ছে, এই যে বাঙলাদেশে অধুনা ধর্ষণ, বলাৎকারের মত ঘটনা বেড়ে গেছে এটা কেবল এই জন্যই নয় যে, কেবল পর্দাহীনতা বা অশ্লীলতা। বরং আইনি প্রতিকার ও ন্যায়বিচার না থাকাটাই এর প্রধানতম কারণ।
ভয়ঙ্কর ব্যাপার এই যে, বাঙলাদেশের বিদ্যমান ত্রুটিপূর্ণ বিচারব্যবস্থা উল্টো ক্রিমিনাল ফ্রেন্ডলি হয়ে উঠেছে। সুতরাং পতনটা সামগ্রিক।
রাষ্ট্রে যখন ন্যায়বিচার থাকবে না তখন এইরকম ঘটনা ঘটবেই। দ্বীনদারদের শুধু যে রক্ষাকবচটা আছে সেটা হচ্ছে পর্দা ও শালীনতা। কিন্তু কেবল এই একটা ব্যাপার এইরকম অপরাধ দমনে পৃথকভাব কার্যকর কিছু না।
একটা মেশিনের প্রধান পার্টসগুলো অকার্যকর রেখে যেমন দুয়েকটা পার্টস দিয়ে মেশিন সচল রাখা যায় না তেমনি ইসলামে এই ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যে পূর্ণ প্রস্তাবনা তা বাস্তবায়ন না করে একটা দুটো এলিমেন্টের সাহায্যে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
ফলত যৌন নিগ্রহের মত অপরাধ বৃদ্ধিতে কেবল পর্দার অবনতি দিয়ে ইসলামের প্রসঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। আদতে এই যে অপরাধ দমনে ব্যর্থতা তা মূলত শাসনযন্ত্রের।
মনে রাখা দরকার, ধর্ষণকে কোনও সাধারণ অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিলে চলবে না। ধর্ষণ একইসঙ্গে একটি রাজনৈতিক অপরাধ। ক্ষমতাদর্পের সঙ্গে এর সম্পর্ক গভীর। ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ও বিচারহীনতা এর অন্যতম অনুঘটক।
৪। ইসলাম নারীকে আত্মরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করে। ইমাম বাগাভী রহ. বলছেন,
‘যদি কেউ ধর্ষণের চেষ্টা করে এবং কোনও নারী তা প্রতিহত করতে গিয়ে কাউকে হত্যাও করে তবে তা কোনও পাপ হিসেবে পরিগণিত হবে না। এমনকি তা বিচারযোগ্য অপরাধ বলেও বিবেচিত হবে না।’
উমার রা. এঁর সময়ে একবার এক নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হলে সে ধর্ষকামীর মাথা বরাবর পাথর ছুঁড়ে মারে। এতে লোকটি নিহত হয়।
উমার রা. বললেন, ‘আল্লাহই তাকে হত্যা করেছে। আল্লাহ্র কসম এর জন্য কোনও দিয়াত নেই।’ ( Diyat, Financial Compensation, Blood Money)
এই যে নারীর ইজ্জত রক্ষার অধিকার- ইসলামে তা স্বীকৃত। কেবল স্বীকৃতই নয় বরং তা প্রমোটেড। কিন্তু আমাদের মেয়েরা সম্ভবত উগ্র কোনও ধর্ষককে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলার মত দক্ষ নয়।
এখন যে হারে সামাজিক সুরক্ষা ভেঙে পড়ছে- তাতে বরং মেয়েদের আত্মরক্ষার সক্ষমতা অর্জন করাটা জরুরি। সেই প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবারের এবং রাষ্ট্রের।
ইসলামের যাবতীয় কানুন মেনেই তা করা যেতে পারে। ধর্ষণ বন্ধে এটা অনেকাংশে কার্যকর একটা পদক্ষেপ হতে পারে।
আমাদের বোনেরা, মায়েরা, মেয়েরা যেন নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
এমনকি বাংলাদেশের পেনাল কোডের ১০০ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের জন্য কেউ আক্রান্ত হলে সে আত্মরক্ষার স্বার্থে তাকে হত্যা করলেও তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না।
৫। এই দেশে ধর্ষিতাদের ব্যাপারে যে সামাজিক মনস্তত্ত্ব তাও অত্যন্ত খারাপ। রুঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, এই সমাজ ধর্ষকের চে’ ধর্ষিতাকেই বেশি ঘৃণা করে। এটারও বদল হওয়া উচিত।
মুনাফিকদের সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের দুইজন দাসী ছিল যাঁদের তিনি পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করেছিলেন। তাঁরা রাসুল ﷺ এঁর কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ করলেন।
আল্লাহ্ কোরআনে আয়াত নাজিল করে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন। ইসলাম চিরতরে পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ করলো। পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করাকে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট এর আওতায় নেওয়া হলো।
এই দুই নারী সাহাবিয়্যা ছিলেন মুসাইকা রা. এবং উমাইমা রা.। ইমাম নববী রহ. ছয়জন নারীর নাম উল্লেখ করেছেন। যাঁরা পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হয়েছিল।
তাঁদের মর্যাদা ইসলামের দৃষ্টিতে সামান্যও কম নয়। তাঁরাও সেইসব মানুষের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা কিয়ামত পর্যন্ত আগত উম্মতের পরবর্তীদের থেকে উত্তম।
ইসলাম যৌন নির্যাতন নিরোধকল্পে ও নিরসনে যে প্রতিরোধ ও প্রতিকার মূলক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে আমাদের নিজেদের সন্তানদের সুরক্ষার জন্যই তা বাস্তবায়নের দাবি নিয়ে আমাদের দাঁড়াতে হবে।
কল্যাণ ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসরণের মধ্যেই। আসুন আমরা মূল জায়গার দিকে দৃষ্টি দিই।