মুসলমানদের ঐক্যের অভাব নিয়ে অভিযোগ শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। আমাদের অনেকের মাঝে হতাশা ও নিরাশার যে অনুভূতি দেখা যায়, তা আমাকে গভীরভাবে পীড়িত করে। এই নেতিবাচক মনোভাব আসে একটি ভুল ধারণা থেকে – যে উম্মাহ বিভক্ত, এবং এই বিভক্তির কারণে আমরা সব সময় পরাজিত।
এই হতাশার মূল কারণ বুঝতে হলে আমাদের বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে স্বীকার করতে হবে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে সংঘটিত সহিংসতা ও অন্যায় আমাদের হৃদয় ভেঙে দেয়। অনেক সময় এই অন্যায়ের কোনো সমাধান দেখা যায় না বলেই আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। কিন্তু আমাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
ইসলাম আমাদেরকে আত্মসমালোচনা করতে শেখায় এবং ভালো কাজের নির্দেশ ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখার আদর্শে (আল-আমর বিল মা’রূফ ওয়া আন-নাহি আনিল মুনকার) অবিচল থাকতে উৎসাহিত করে। এর অর্থ হলো, আমরা সমস্যাগুলো চিনতে পারি, সমালোচনা করতে পারি, এবং পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে পারি – কিন্তু হতাশ হওয়া কখনোই আমাদের পথ নয়।
১৯২২ সালে অটোমান খিলাফতের পতনের পর, অনেক মুসলমান উম্মাহকে পুনরায় একত্রিত করার জন্য নিজেদের শক্তি ও মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। তাদের ধারণা ছিল, খিলাফত ছাড়া মুসলমানরা একত্রে কাজ করতে পারবে না এবং দুর্বল হয়ে পড়বে। এর ফলে মুসলমানদের মাঝে দুটি দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেয় – একদল যারা প্রাচীন ধর্মীয় চর্চা ধরে রাখতে চেয়েছিল এবং আরেকদল যারা সংস্কারের মাধ্যমে উম্মাহকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিল।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই বিতর্ক ও বিভাজন আমাদের কোথায় নিয়ে গেছে? এক শতাব্দী পেরিয়ে গেছে, আমরা এখনো ঐ একই অভিযোগ তুলছি – ‘মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ নয়।’ অথচ যারা একতার অভাব নিয়ে কেঁদে বেড়াচ্ছেন, তারা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন যে, আমরা অনেক দিক থেকেই এখনো ঐক্যবদ্ধ।
আমাদের ঐক্য কোনো কল্পিত সাম্রাজ্যের অধীনে রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক একরূপতার ওপর নির্ভর করে না। বরং এটি বিদ্যমান আমাদের ইসলামি মূলনীতির প্রতি সম্মিলিত আনুগত্যে। কুরআনের বার্তা এবং নবী মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন থেকে আমরা যে সার্বজনীন শিক্ষা পাই, তা আমাদের মধ্যে একটি অটুট বন্ধন তৈরি করেছে।
আজ, খিলাফত বা একটি অভিন্ন রাজনৈতিক কাঠামো ছাড়াই, মুসলমানরা তাদের বিশ্বাস, চর্চা এবং মূল্যবোধের মাধ্যমে অভূতপূর্ব ঐক্যের পরিচয় দিচ্ছে। আমরা বিশ্বজুড়ে একই নামাজ আদায় করি, একই রমজানের রোজা রাখি, এবং এক আল্লাহর প্রতি একইরকম বিশ্বাস রাখি। এই ঐক্য আমাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক পরিচয়ের মেরুদণ্ড।
তাহলে কেন আমরা বিভক্তি নিয়ে অভিযোগ করি? কারণ, এ ধরনের বিভাজনের ধারণা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঔপনিবেশিক এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমাদের বিশ্বাস করাতে চেয়েছে যে, যেহেতু কোনো প্যান-ইসলামিক রাজনৈতিক কাঠামো নেই, তাই আমাদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। কিন্তু ইতিহাস আমাদের অন্য কিছু শিখিয়েছে।
ঔপনিবেশিক শক্তি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে কৃত্রিম সীমানায় বিভক্ত করেছিল, যা আজও দ্বন্দ্বের কারণ। তবুও, ইসলামের মূল চর্চাগুলো – নামাজ থেকে শুরু করে হজ পর্যন্ত – ১,৪০০ বছর ধরে আমাদের একটি অটুট বন্ধনে আবদ্ধ রেখেছে।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা কঠিন সময়ে হতাশ হননি। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৫৭ সালের ভারতীয় বিদ্রোহের পর যখন হাজার হাজার আলেম নিহত হন, তখন দেওবন্দের আলেমরা তাদের পরাজয়ের পরেও ভেঙে পড়েননি। তারা দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামি জ্ঞান সংরক্ষণের জন্য কাজ শুরু করেন। তাদের ইতিবাচক মনোভাব আমাদের শিখিয়েছে, একটি পরাজয় কখনোই শেষ নয়; এটি নতুন শুরুর ভিত্তি হতে পারে।
তাহলে আমরা কেন হতাশ হব? বরং আমাদের উচিৎ আমাদের ঐক্যের ইতিবাচক দিকগুলো খুঁজে বের করা এবং তা উদযাপন করা। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এই ঐক্যের ওপর ভিত্তি করে সমাজকে আরও শক্তিশালী এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা।
এই মুহূর্তটি হতাশার সময় নয়। এটি আমাদের আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ঐক্যের শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার সময়।
শায়খ এম এ খোলওয়াদিয়া শিকাগো, ইলিনয়স-ভিত্তিক ইসলামিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল কাসিম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। তিনি একজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইসলামি ধর্মতত্ত্ববিদ, মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা এবং শিক্ষক। ইসলামি দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। খোলওয়াদিয়ার আল-জাজিরার মতামত পাতায় লেখা ভাওয়াল বার্তার পাঠকের জন্য অনুবাদ করা হলো।