Sheikhbari to Porabari
Advertisements

খুলনার শেরেবাংলা রোডে অবস্থিত ‘শেখবাড়ি’ একসময় ছিল ক্ষমতার প্রতীক। এটি ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা শেখ আবু নাসেরের বাসভবন। তাঁর পাঁচ ছেলেসহ পরিবারের সদস্যরা এখানে বসবাস করতেন। স্থানীয়ভাবে এটি ছিল রাজনৈতিক শক্তির অন্যতম কেন্দ্র। কেউ কেউ একে বলতেন “দ্বিতীয় গণভবন।”

কিন্তু আগস্ট বিপ্লবের চূড়ান্তলগ্নে ছাত্র-জনতার রুদ্র রোষের শিকার হয়ে এই ভবনটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। জনতার ক্রোধের আগুনে ভস্মীভূত হয়ে ‘শেখবাড়ি’ এখন পরিচিতি পেয়েছে ‘পোড়াবাড়ি’ নামে।

শেখবাড়ি ছিল খুলনায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও প্রভাব বিস্তারের প্রধান কেন্দ্র। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে এটি স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে।

এ বাড়ি থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হতো চাকরি-বাকরি, বদলি, পদোন্নতি, টেন্ডার সিন্ডিকেট, বাজার-ঘাট, জলমহাল, এবং নির্বাচনের ফলাফল। প্রশাসনের কর্মকর্তারা এখানে এসে তদবির করতেন। প্রভাবশালী এই বাড়ির সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিন এবং শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল। যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সোহেল ও অন্য দুই ভাই শেখ রুবেল এবং শেখ বাবুও কখনো ঢাকায়, কখনো খুলনায় থাকতেন।

আগস্ট বিপ্লবের সময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে পরিবারের চার সদস্য ২ বা ৩ আগস্ট এই বাড়ি ছেড়ে ঢাকা হয়ে ভারত বা থাইল্যান্ডে পাড়ি জমান বলে জনশ্রুতি আছে। শেখ হেলাল আরও আগে দেশ ত্যাগ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

৪ ও ৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা দফায় দফায় শেখবাড়িতে হামলা চালায়। তারা ভবনের দরজা-জানালা, গ্রিল, আসবাবপত্র, টিভি, ফ্রিজসহ সব কিছু ভেঙে নিয়ে যায়। পরে পুরো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। প্রথম হামলার পর কিছু পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা বাড়িতে উপস্থিত হলেও পরবর্তী হামলার সময় কেউ এগিয়ে আসেনি।

পরিত্যক্ত এই ভবনের টিনের গেট ও পাশের গলিকে বাঁশ ও টিন দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। এ কাজটি স্থানীয় এক ব্যক্তি তত্ত্বাবধান করেছেন বলে জানা যায়।

১৪ ডিসেম্বর খুলনা রেলস্টেশনের ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ডে হঠাৎ ভেসে ওঠে, “ছাত্রলীগ আবার ভয়ংকর রূপে ফিরে আসবে; জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু; শেখ হাসিনা আবার আসবে।”

এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা স্টেশন মাস্টারের অফিস ঘেরাও করে মিছিল-স্লোগান দেয়। সন্দেহভাজন একজনকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এ নিয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

এরপর ১৬ ডিসেম্বর শেখবাড়ির টিনের গেটসহ নগরীর বিভিন্ন দেয়ালে কালো কালির স্প্রে দিয়ে ‘জয় বাংলা’ লেখা হয়। তিনদিন পর সেগুলো মুছে ফেলা হলেও ওয়াকিবহাল মহল বলছেন, পালিয়ে যাওয়া গণহত্যার দোসররা আবার ফিরে আসার পরিকল্পনা করছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আহম্মদ হামীম রাহাত অভিযোগ করেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী পক্ষগুলোর সমন্বয়হীনতা এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে পালিয়ে যাওয়া দুর্বৃত্তরা ফিরে আসার সাহস পাচ্ছে। তিনি বলেন, “তাদের হাতে লুটপাটের অঢেল অর্থ রয়েছে, যা দিয়ে কেনাবেচার কাজ চলছে। প্রশাসনের পেছনে ইন্ধন না থাকলে তারা এত দ্রুত ফিরে আসতে পারত না।”

তিনি আরও জানান, প্রশাসনকে বারবার সতর্ক করা হলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে খুলনার ছাত্র-জনতা যেকোনো অপতৎপরতা রুখে দিতে প্রস্তুত বলে তিনি আশ্বস্ত করেন।

‘শেখবাড়ি’ এখন অতীতের ক্ষমতার প্রতীক নয়। এটি জনতার ক্রোধের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পালিয়ে যাওয়া দুর্বৃত্তদের সম্ভাব্য ফিরে আসা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

Advertisements