নির্বাচনের আগে সরকারের পক্ষে ৩৫ কাল্পনিক কলামিস্ট লিখছেন
Advertisements

বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করে স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের শত শত লেখা সম্প্রতি দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব লেখকরা ভুয়া পরিচয়, ছবি এবং নাম ব্যবহার করেছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের পক্ষে এসব লেখা ব্যবহার করে গুজবভিত্তিক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া, ওয়াশিংটনভিত্তিক ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের সাউথ এশিয়া ব্রিফসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এসব লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

এএফপির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কথিত বিশেষজ্ঞদের একটি দল নিয়মিত এসব মতামত লিখছেন। তারা বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ প্রকৃত বিশ্লেষকদের নামে বানোয়াট মন্তব্যও উদ্ধৃত করেছেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরকারবিরোধী নেতিবাচক ‘প্রচারণা’ ঠেকাতে ‘ভালো কলামিস্ট’ খোঁজার ঘোষণা দেওয়ার পর গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এ ধরনের অনেক লেখা অনলাইনে প্রকাশিত হয়। তবে এ নিয়ে মন্তব্য করেনি পররাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এএফপিকে বলেছেন, এ বিষয়ে মন্তব্য করার মতো পর্যাপ্ত সময় নেই তাঁর।

এএফপির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত বছর ৬০টি দেশি এবং বিদেশি সংবাদমাধ্যমে ৩৫ জনের নামে ৭০০ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাদের নামে এর আগে কখনও এ ধরনের নিবন্ধ প্রকাশিত হয়নি। লেখাগুলোতে বতর্মান সরকারের প্রতি সমর্থন দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে চীনের প্রতি জোরালো সমর্থন এবং যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে মার্কিন চাপ রয়েছে। তবে চীন বর্তমান সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেছে।

এএফপির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যেসব নামে লেখাগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তার বাইরে তাদের কোনো অনলাইন উপস্থিতি নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং একাডেমিক জার্নালেও তাদের কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়নি।

আলোচিত নামগুলোর মধ্যে ১৭টির সঙ্গে পশ্চিমের এবং এশিয়ার বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের কথিত সংযোগ রয়েছে। তাদের মধ্যে ৯ জন যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন বলে পরিচয়ে লিখেছেন, সেসব বিশ্ববিদ্যালয় এএফপিকে নিশ্চিত করেছে, ওই সব নাম তারা কখনও শোনেনি। এসব কলামিস্টের মধ্যে আটজন যেসব ছবি ব্যবহার করেছেন, সেগুলো অন্য মানুষের। তাদের মধ্যে ভারতের একজন জনপ্রিয় ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সারের ছবিও রয়েছে।

কথিত লেখকদের একজনের নাম ডরিন চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের প্রশংসা করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতার সমালোচনা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের প্রশংসা করে অন্তত ৬০টি নিবন্ধ লিখেছেন। ডরিন চৌধুরী তাঁর পরিচয়ে যে ছবিটি ব্যবহার করেছেন, তা একজন ভারতীয় অভিনেত্রীর। আর তিনি নেদারল্যান্ডসের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন বলে জানিয়েছেন, সে প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ তাঁর নামে কোনো তথ্য খুঁজে পায়নি।

তাঁর নামের সঙ্গে থাকা ই-মেইল থেকে একটি উত্তর পেয়েছে এএফপি, যেখানে দাবি করা হয়েছে যে ‘নিরাপত্তার স্বার্থে ছদ্মনাম’ ব্যবহার করেছেন। তবে ই-মেইলে তাঁর আসল পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি এবং ভুয়া ছবি ব্যবহারের কারণও জানা যায়নি। ব্যাংকক পোস্ট এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের একটি ব্লগসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন ফুমিকো ইয়ামাদা নামে একজন। তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ স্টাডিজের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। তবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর উপস্থিতির কোনো রেকর্ড নেই এবং বাংলাদেশ স্টাডিজ নামে সেখানে গবেষণার কোনো ক্ষেত্র নেই।

ইয়ামাদার নিবন্ধগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শের প্রশংসা রয়েছে। পাশাপাশি ওয়াশিংটনের গণতন্ত্র এবং অন্যদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের নিন্দা করা হয়েছে। অন্যদের মানবাধিকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্বৈত মানদণ্ডের’ কড়া সমালোচনা রয়েছে এসব লেখায়। কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত বিশেষজ্ঞের নামে ভুয়া বক্তব্য প্রকাশের উদাহরণও অনুসন্ধানে তুলে এনেছে ফরাসি বার্তা সংস্থাটি।

নেদারল্যান্ডসের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজের একজন অধ্যাপক জেরার্ড ম্যাকার্থি বলেছেন, পৃথ্বী রাজ চতুর্বেদীর নামে মিয়ানমারের প্রতি ‘পশ্চিমা দ্বিচারিতার’ নিন্দা করে একটি নিবন্ধ তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এতে তাঁর নামে সম্পূর্ণ বানোয়াট উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। যেসব পত্রিকা এসব লেখা ছেপেছে, তাদের কয়েকজন জানিয়েছেন, লেখকদের একাডেমিক পরিচয় এবং অন্যত্র প্রকাশিত তাদের লেখা দেখে সরল বিশ্বাসে তারা সেগুলো ছেপেছিলেন।

ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক জানান, চলতি বছরের শুরুর দিকে তাঁর কাছে এ রকম অনেক মতামতধর্মী লেখা পাঠানো হয়। এর অধিকাংশই ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে লেখা। কিন্তু এক পর্যায়ে সন্দেহ হওয়ায় তিনি সেসব লেখা প্রকাশ করা বন্ধ করে দেন। তাঁর মনে হয়েছে, এসব লেখা ভাড়াটে লেখকদের দিয়ে তৈরি করেছে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী।

ওই সব লেখক আসলে ‘কাল্পনিক’ জেনে হতবাক হন ওই সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘লেখকদের পরিচয় যাচাই করার বিষয়ে ভুল তথ্য ও অপপ্রচারের যুগে আমাদের আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিল।’

Advertisements