যেখানেই প্রধানমন্ত্রীর বিশেষায়িত প্রকল্প সেখানেই বাধাদানের দুঃসাহস দেখান পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড় উপজেলার বেপরোয়া চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কুমার কারবারী। রামগড়ের করিডোর নির্মাণের আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য কার্যক্রমই হোক আর প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পই হোক সর্বত্রই বিশ্ব কারবারীর ভয়ংকর চাঁদাবাজির থাবা পড়ে। কখনো গোপন বাহিনীর নাম ভাঙিয়ে, কখনো উপজেলা চেয়ারম্যান পদের দাপট খাটিয়ে আবার কোথাও যুবলীগের বাহাদুরি দেখিয়ে চাহিদা মাফিক চাঁদা হাতিয়ে নেন। তার নেতৃত্বে এবং তাকে ঘিরেই সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে উঠেছে রামগড়ে। সবকিছুরই সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছেন তিনি। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জবরদখল, ব্যবসা-বাণিজ্য ছিনিয়ে নেওয়াসহ বিভিন্ন অপকর্ম চালায় তার সিন্ডিকেট। তারা যেমন দল নিয়ন্ত্রণ করেন তেমনই নিয়ন্ত্রণ করেন প্রশাসন। এছাড়া শান্তিবাহিনী ও ইউপিডিএফ-এর নামে গোপন চাঁদাবাজিও চলে তার। পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম পাহাড়ি প্রবেশদ্বার, আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র রামগড় বিশ্ব কারবারী ও তার বাহিনীর কাছেই জিম্মি হয়ে পড়েছে। তার এ প্রতাপের নেপথ্য শক্তি হচ্ছে, তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) কুজেন ত্রিপুরার ভাতিজির স্বামী। অন্যদিকে ভায়রা ভাই হচ্ছেন খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসাইপ্রু চৌধুরী অপু।
কিছুদিন আগেও বিশ্ব প্রদীপ কুমার কারবারী অতি সাধারণ এক যুবলীগ সদস্য ছিলেন। বাবা ছিলেন পুলিশ সদস্য। সীমিত আয়ে সংসার চালানো কষ্টকর ছিল। কিন্তু সেই পাহাড়ি দরিদ্র পরিবারের বেকার যুবক বিশ্ব কারবারী এখন অর্থবিত্তে রামগড়ের যুবরাজ হয়ে উঠেছেন। কয়েক বছর আগে যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে টুকিটাকি সাপ্লাইয়ের বাণিজ্যে নেমে পড়েন তিনি। এরপর ঠিকাদারি কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ ও টেন্ডারবাজিতে একচ্ছত্র প্রভাব খাটাতে গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। ভয় দেখিয়ে অন্যের ঠিকাদারি কাজ বন্ধ করে দিতেই তৎপর হয়ে ওঠেন তিনি। সেসব ঠিকাদারের কাছ থেকে মধ্যস্থতার নামে গোপনে বাহিনীর জন্য লাখ লাখ টাকা লেনদেনের ঘটনাতেও বারবার তারই নাম উঠে আসে। তাকে সাপ্লাইয়ের কাজ না দেওয়ায় কয়েকজন ঠিকাদার কয়েক বছর ধরেই সীমাহীন যন্ত্রণা পোহাচ্ছেন। এরই মধ্যে তাদের ঠিকাদারি কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকল্পে ব্যয় করা বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নেওয়ারও সুযোগ পাচ্ছেন না তারা। পিলাক নদীর উপরে বৈদ্যপাড়া ও পাতাছড়ায় প্রায় বিশ কোটি টাকার ব্রিজ নির্মাণ করতে গিয়ে এক প্রসিদ্ধ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বিশ্ব প্রদীপ কুমারের নগ্নথাবার শিকার হয়েছেন। প্রায় দুই বছর ধরে নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হচ্ছে। বিষয়টি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। তারপরও অজ্ঞাত কারণে বিশ্ব প্রদীপ ও তার বাহিনীর সদস্যরা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এলাকার মাদক সাম্রাজ্য পরিচালনাসহ ক্যাসিনো আদলের ত্রিপুরাসহ আসাম রাজ্যে প্রচলিত শিলং জুয়াও পরিচালনা করেন তারা।
যেভাবে উত্থান : এমপির ভাতিজিকে বিয়ে করার মধ্য দিয়েই আলাদিনের চেরাগ জোটে বিশ্ব কারবারীর কপালে। রাতারাতি বনে যান উপজেলা যুবলীগের সম্পাদক। দেখতে না দেখতেই উপজেলা চেয়ারম্যান। তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। রামগড়ের তৈছালাপাড়া ও গরুজব এলাকায় সরকারি জমি বন্দোবস্ত পাওয়া বাঙালিদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে উচ্ছেদ করেছেন। দখল করা জায়গায় গড়ে তুলেছেন নিজের বিরাট বনায়ন প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৫টি ঘরও প্রভাব খাটিয়ে নিজের বাগানবাড়িতে তুলেছেন তিনি। সেখানে তার কর্মচারীদের নামে এ প্রকল্পের ঘর কীভাবে বরাদ্দ করিয়েছেন তা সবাইকে হতবাক করেছে। এখন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রেও পরিবার পিছু ৪০ হাজার টাকা অগ্রিম হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
যাদের নিয়ে বিশ্ব বাহিনী : পাহাড়ি ও বাঙালি মিলিয়ে অন্তত ৩০ পেশাদার অপরাধীর সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্ব কারবারীর অস্ত্রবাজ বাহিনী। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রেকর্ডেও তারা দখলবাজ সন্ত্রাসী ও কেউ কেউ জামায়াত শিবিরের ক্যাডার হিসাবে তালিকাভুক্ত। কিন্তু বিশ্ব কারবারী তাদের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের পরিচয়ে নিজের বাহিনীতে ঢুকিয়েছেন। এরাই দাপিয়ে বেড়ায় গোটা রামগড় এলাকা। বাহিনীর সদস্যরা আলাদা আলাদা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে একেকটি অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে বলেও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। বিশ্ব বাহিনীর চোরাকারবার ও মাদক বাণিজ্য দেখভাল করে খাড়া বাদশা, জিয়া, নয়নসহ ১০-১২ জনের একটি গ্রুপ। অন্যদিকে মুরগি মিলন ও বাবুলসহ ৭-৮ জনের একটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে অস্ত্র ব্যবসা। ইয়াবা ও শিলং লটারি জুয়া পরিচালনা করেন জিয়াসহ ৪-৫ জনের দল।
সীমান্ত বাণিজ্য করিডোর নির্মাণসহ নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে রামগড় এলাকায় সবচেয়ে সেরা হয়ে উঠেছে বালুর বাণিজ্য। সেখানে বালুর উৎস হিসাবে চিহ্নিত পিলাক ঘাট, বৈদ্যপাড়া, চৌধুরীপাড়া, জিরো পয়েন্ট, তালমনীপাড়াজুড়ে রীতিমতো আলাদা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বিশ্ব প্রদীপ কুমারের সহযোগীরা। রাজাকার মান্নানের ছেলে সুমন ও জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে ৮-১০ জন অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত রামগড়ের বালু সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। এ খাত থেকে প্রতিদিন তারা অন্তত ৩০ হাজার টাকা চাঁদাবাজি করে। বিশ্ব বাহিনীর হয়ে জায়গাজমি জবরদখল, সরকারের বরাদ্দ পাওয়া ভূমি থেকে প্রকৃত মালিকদের উচ্ছেদ করা, ঘরবাড়িতে ভাঙচুর চালানোর মতো অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে কালডেবার চোরা শাহজাহান, রাজাকার মান্নান, জাহাঙ্গীর কাইলা হানিফসহ ১০-১২ জন। এ চক্র সম্প্র্রতি ইউএনও সমিতির কেনা জমি ও বাগান থেকে প্রায় ৪০ একর জায়গা জবরদখল করে নিয়েছে। সেখানে কেয়ারটেকারসহ পাহারায় থাকা নিরাপত্তা কর্মীদের মারধর করে গুরুতর জখম করে। সেখান থেকে কোটি টাকা মূল্যের গাছ কেটে প্রকাশ্যে বিক্রি পর্যন্ত করে দেওয়া হয়েছে। অথচ এসব ব্যাপারে রামগড় থানা পুলিশ বিশ্ব ও তার বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা পর্যন্ত রেকর্ড করেনি।
অপকর্মের শেষ নেই : দুদিনব্যাপী রামগড় অনুসন্ধানে বিশ্ব কারবারী, তার পরিজন ও নিজস্ব বাহিনীর অপকর্ম ও লুটপাটের অজস কাহিনি বেরিয়ে এসেছে। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী প্রকল্প রামগড় ইউপির প্রকল্পের চেয়ারম্যান হিসাবে দীর্ঘসময় দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এ প্রকল্পে প্রতি তিন মাস অন্তর ব্যয় হয় ১৮১ টন চাল। প্রতি কার্ডে ৩ কেজি থেকে ৪ কেজি চাল কম এবং ব্যবসায়ীদের থেকে প্রতি কেজি চালের বিপরীতে ২.৫০ টাকা করে প্রতি ডিওতে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। এমপির আত্মীয়তার সুবাদে তার এসব কার্যকলাপের প্রতিবাদ করার সাহস কারও নেই। এছাড়া তিনি রামগড় উপজেলা পরিষদ চালাচ্ছেন এককভাবে। ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার ফারুকের জন্য নির্ধারিত কক্ষে ত্রাণের বস্তা রাখায় তিনি এর প্রতিবাদ করেন। এতে কক্ষটি ব্যবহার থেকে বিরত থাকলেও আরেক ভাইস চেয়ারম্যানের (মহিলা) কক্ষে বিশ্ববাহিনীর সদস্যরা আড্ডায় মশগুল থাকেন এবং কক্ষটি ব্যবহার হয় টি-স্টল হিসাবে। ভাইস চেয়ারম্যান দুজনের ক্ষোভ থাকলেও প্রতিবাদ করে এমপি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার চোখে খারাপ হতে চান না তারা। এদিকে, বিশ্ব কারবারী তার জগন্নাথপাড়া এলাকার সরু রাস্তার কারণে বাড়িতে গাড়ি নিয়ে চলাচল করতে পারতেন না। এ কারণে তিনি রাস্তার পাশের মন্দিরের দেওয়াল ভেঙে নতুন রাস্তা তৈরি করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান এমপির বরাদ্দ, জেলা পরিষদের বরাদ্দ, উপজেলা পরিষদের বরাদ্দ এবং আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের পদ-পদবি সবকিছুতে বিশ্ব কারবারীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। তিনি একাই উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। আমরা শুধু কাগজেকলমে কমিটিতে আছি কিন্তু এলাকার মানুষের জন্য আমরা কিছুই করতে পারছি না।
এ ব্যাপারে উপজেলা চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কারবারী মোবাইল ফোনে বলেন, আমি চাঁদাবাজি বা টেন্ডারবাজির কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নই। স্থানীয় কিছু সাংবাদিক হয়তো আমার বিরুদ্ধে যুগান্তরকে ব্যবহারের পাঁয়তারা চালাচ্ছেন।
এ সময় অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন তুলতেই তিনি ক্ষেপে ওঠেন। হুমকি দিয়ে বলেন, যুগান্তরে আমার বিরুদ্ধে কোনো সংবাদ প্রকাশ করলেই আমি একের পর এক মামলা দিয়ে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ব। একপর্যায়ে ক্ষিপ্ততার সঙ্গেই তিনি ফোন কেটে দেন।
সূত্রঃ যুগান্তর