বাংলাদেশে বায়ান্নো থেকে একাত্তর হয়ে পঁচাত্তর পর্যন্ত যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সকল ঘটনার নেপথ্য চেতনা ও প্রেরণা হিশেবে কাজ করেছে সেখানে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জাতীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রপ্রতীক। কারণ এই বাঙালি জাতীয়তার নেতৃত্ব এসেছিল ইউরোকেন্দ্রিক শিক্ষা, জ্ঞানবৃত্ত ও সংস্কৃতির কলকাতা ভার্শনে প্রস্তুতকৃত উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে। এই উঠতি এলিটের কাছে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক রোল মডেল ছিল কলকাতা-নিবাসী অনাবাসী-জমিদার ব্রাহ্ম-বৈদগ্ধ্যের অবতার রবীন্দ্রনাথ।
কিন্তু একাত্তরে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক রক্তাক্ত সামষ্টিক আন্দোলন ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ফলে যে বিপুল জনগোষ্ঠী এই আন্দোলনে শামিল হয়েছিল তারা তাদের নিম্নবিত্তসুলভ জীবনশৈলী ও জীবনচেতনায় উচ্চবিত্ত, বিদগ্ধ, উচ্চবর্গীয় রুচি ও জীবনচর্যার অনুশীলক রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করতে পারছিল না। আর তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বাঙালিত্ব নির্ভর স্বতন্ত্র রাষ্ট্রচেতনা ছিল অনুপস্থিত। এছাড়া বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের পরিচয় নির্মাণে যে ইসলাম হল প্রধান সূত্র সেই ইসলামকে রবীন্দ্রনাথ প্রকারান্তরে কোনোভাবেই ওউন করতে চান নি। বরঞ্চ বাঙালি মুসলমানকে ধর্মবিশ্বাসে মুসলিম থেকেই সংস্কৃতিতে “হিন্দু” হবার পরামর্শ দিয়েছেন।
এই প্রেক্ষাপটেই একজন উৎকেন্দ্রিক মার্কসবাদী চিন্তক নিয়ে এলেন এই রাবীন্দ্রিক হিন্দুভাবাপন্ন বাঙালি জাতিবাদ ও উন্নাসিক “ভদ্রলোকীয়” আভিজাত্যবাদের সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে জনরুচির আধার হিশেবে চৈতন্য, নিতাই ও লালনের ত্রয়ী বা নদীয়ার ত্রিত্ববাদ। চৈতন্য ও নিতাই এই ঐতিহ্যের উৎস হলেও মূল ফোকাসটা ফেলা হল লালনের উপরে। লালনের বেশ কয়েকটি সুবিধা আছে। এক হল তিনি নিজেই নিজেকে হিন্দু বা মুসলমান বলে চিহ্নিত করতে দিতে চাননি। অর্থাৎ তাকে সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে দেখাবার একটা চমৎকার সুযোগ তিনি নিজেই তৈরি করে রেখে গেছেন। নদীয়ার ভাবের মধ্যে মার্কস, হাইডেগার, ফুকো, দেরিদা ও অন্যান্য পোস্টমডার্ন চিন্তার ছায়া আবিস্কারকারীরা লালনের এই সুবিধাগুলিকে কাজে লাগিয়ে তাকে একজন বর্ণ, জাতি, সম্প্রদায়, শ্রেণি ও লিঙ্গ উত্তীর্ণ মাত্রায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন। যা আসলে সম্পূর্ণ কাল্পনিক, অনুমানমূলক এবং অবাস্তব। এক কথায় ইউটোপিয়ান। এভাবে বাঙালি মুসলমানকে লালন অনুসারী বানিয়ে নদীয়ার ভাব সূত্রে পুনরায় মনুবাদী কাঠামোর অঙ্গীভূত করার একটা চেষ্টা হয়েছে। অথচ বাঙালি মুসলমান সুলতানী আমল থেকেই একটি ইনসাফ ও আদল ভিত্তিক সাম্যের সমাজ বিনির্মাণে ব্যাপৃত আছে। তাকে এই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করা অর্থ হল তার ঐতিহাসিক গতিপথকে বিভ্রান্ত করা।
এতে করে একদল উৎকেন্দ্রিক ও বিভ্রান্ত শহুরে মধ্যশ্রেণির কাছে একজন হাতের নাগালের জনলগ্ন কালচারাল আইকন হিশেবে লালনের কিছু আকর্ষণ তৈরি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু লালনকে দিয়ে আমজনতা ও বিদগ্ধ নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি উভয়কেই মৈত্রীবন্ধনে বাঁধবার আশা দুরাশাই রয়ে গেছে। কারণ শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি কিংবা নিম্ন মধ্যশ্রেণির একটি বিপুল অংশ যারা ইসলামিকতার বিভিন্ন ভাষ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তারা লালনকে একজন বাউল গানের স্রষ্টার চাইতে বেশি কিছু বলে গ্রহণ করতে রাজী নয়।
বাঙালি জাতিবাদ যেমন রবীন্দ্রনাথকে ফলস প্রফেট হিশেবে পেয়ে বিভ্রান্ত হয়েছে, ঠিক একইভাবে নদীয়ার এই তৃণমৌলিক নবপ্রাণিত ভাবান্দোলনও শেষমেশ বাঙালি মুসলমানকে লালন সাঁই নামক আরেক ফলস প্রফেট বিভ্রান্তির শিকারগ্রস্ত করতে চাইছে। কিন্তু যখন একটি জনসমষ্টি ইসলামিকতার ধ্রুপদী ও জনমুখী বৃত্তে নিজেদেরকে বরণ করে নেয় তখন তাদের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আইকন হবার কিছু পূর্বশর্ত ও মানদন্ড তৈরি হয়ে যায়। লালন সেই পূর্বশর্ত ও মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে পারে না।