বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমদের ৯৭তম জন্মবার্ষিকী আজ। তাঁর সমন্ধে আজকের প্রজন্ম খুব কমই জানে। এটা তাদের দোষ নয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি, কারিকুলাম, গবেষণা, আলোচনা ও কর্মকাণ্ডে তাঁকে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। জাতীয় জাদুঘর-মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরগুলো থেকেও তাঁর সম্বন্ধে জানা যাবে খুব কম। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদকে ভালোমতো জানা ছাড়া আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ও গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেও সঠিক জানতে পারব না।
‘স্টেটসম্যানশিপ’ বা রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণ হাজির ছিল তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে। রাজনীতিতে, রাষ্ট্রাচারে এক অনুকরণীয় সততা, নিষ্ঠা, মেধা, প্রজ্ঞা, চিন্তাশীলতার কর্মজীবন হাজির রেখেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তার রাজনৈতিক জীবন, রাষ্ট্রনৈতিক চর্চা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য এক বড় অনুপ্রেরণাও বটে। সে কারণেই তার জন্মদিনে রইল একরাশ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫) জন্মেছিলেন ২৩ জুলাই ১৯২৫ ঢাকার অদূরে অধুনা গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামে। স্বল্পায়ু ছিলেন তিনি। মাত্র ৫০ বছরে বয়সেই তাকে ঢাকার কেন্দ্রীয় জেলখানায় খুনিরা হত্যা করে। তাজউদ্দীন আহমদের জীবন নিয়ে চারটি অধ্যায়ে বা ধাপে ভাগ করে আলোচনা করা হয়েছে।
মেধাবী ছাত্র
তাজউদ্দীন অল্প বয়সে কুরআন শরীফের ১১ পারা মুখস্থ করে ফেলেন। এরপর তার অসামান্য মেধা দেখে তার শিক্ষকরা তাকে স্কুলে ভর্তি হতে বলেন। তিনি সব সময় স্কুলে প্রথম স্থান অধিকার করতেন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে থাকাকালীন ঢাকা বোর্ডে বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। মাধ্যমিক পরীক্ষায় কলকাতা বোর্ডে দ্বাদশ স্থান অধিকার করে সবাইকে চমকে দেন। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি প্রগতিশীল ছাত্র হিসেবে অংশগ্রহণ করেন, ফলে এক বছরের জন্য পড়াশোনা বর্জন করেন সচেতন শিক্ষার্থী হিসেবে। এরপর তিনি ইন্টারমিডিয়েটে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন ১৯৪৩ সালে। ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে তিনি পুরোপুরিভাবে রাজনৈতিক কর্মী হয়ে ওঠেন।
১৯৪৪ সালে মুসলিম লীগের সম্মেলন, কৃষ্ণনগরে ছাত্রলীগের সম্মেলন, ১৯৪৬ সালের সালের নির্বাচন, ১৯৪৬ সালে দাঙ্গা প্রতিরোধ, ‘৪৭-এর দেশভাগ, প্রায় সকল আন্দোলনে তিনি সক্রিয় কর্মী হিসেবে অংশগ্রহণ করতেন। রাজনৈতিক ব্যস্ততার কারণে ইন্টার পাশ করতেই ১৯৪৮ সাল লেগে যায়। অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে ইন্টার পরীক্ষায় তিনি পুরো ঢাকা বোর্ডে চতুর্থ হয়ে সবাইকে চমকে দেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন।
মানবিক কাজ
তেতাল্লিশ সালের দুর্ভিক্ষ তার অন্তরে গভীর রেখাপাত করে গিয়েছিল। তিনি দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে পারেননি, তাই তো গ্রামের যুবকদের একত্রিত করে চাল এবং অন্যান্য শুকনা খাবার সংগ্রহ করে ধর্মগোলা গঠন করে, সেখান থেকে গরিবদের খাবার দান করতেন। তাজউদ্দীনের একটি বড় গুণ ছিল মানুষের সেবা করা। তিনি কাপাসিয়া বন বিভাগের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে দুর্নীতি বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
কথায় আছে, সকালের সূর্যের আলো পূর্বাভাস দিয়ে দেয় সারাদিন কেমন যাবে। ঠিক তেমনি তাজউদ্দীনের ছোটবেলায় মানবিক কাজও ভবিষ্যতের বঙ্গতাজ হওয়ার আভাস দিচ্ছিল।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
তার রাজনৈতিক জ্ঞান অর্জন শুরু হয় ১৯৩৭ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে। কাপাসিয়া থানায় বন্দী স্বদেশী আন্দোলনের তিনজন বিপ্লবীর সাথে দেখা হয় এক রেল স্টেশনে। তাদের বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন তিনি। তাদের থেকে তিনি প্রায় ৫০-৬০টি সমকালীন ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন বই পড়ে রাজনীতির প্রাথমিক দীক্ষা লাভ করেন। এছাড়া বিপ্লবীরা তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, উত্থান-পতন ইত্যাদি নিয়ে তাজউদ্দীনকে অনেক উপদেশ দেন।
ঢাকা কলেজে পড়ার সময় তিনি ঢাকা উত্তর মহকুমা মুসলিম লীগের সদস্য হন। এরপর থেকে তিনি পুরোপুরিভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে যান। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন ১৯৪৪ সালে। এ সময়ে তিনি কলকাতা গিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরিচিত হন। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি ঢাকা জেলার দায়িত্ব পালন করেন, এ নির্বাচনে ঢাকা জেলার সব আসনে মুসলিম লীগ জয় লাভ করে। এ নির্বাচনে তাজউদ্দীন নিজেকে মুসলিম লীগের একনিষ্ঠ সক্রিয় কর্মী হিসেবে প্রমাণ করে দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে নিজের কর্মদক্ষতা ও প্রয়োজনীয়তা জাহির করেন।
১৯৪৬ সালে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা দমনে তিনি ঢাকায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় কর্মী ছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর তিনি ভাষা আন্দোলন সহ বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন। ভাষা আন্দোলনেরও সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের জন্যে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন । ১৯৫০ সালে দাঙ্গা প্রতিরোধ ও ১৯৫১ সালে যুবলীগ গঠনে তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য তিনি অন্যতম অনুঘটক ছিলেন। ১৯৫৪-৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে তাজউদ্দীন সাহেব যুক্তফ্রন্ট থেকে এমএলএ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন এবং বিপুল ব্যবধানে এমএলএ নির্বাচিত হন কাপাসিয়া থেকে।
১৯৫৫ সালে তাজউদ্দীন আহমেদ আওয়ামীলীগ এর দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ছাত্র ও যুবসমাজকে একত্রিত করে জোর দাবি তোলেন।তার কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু তাকে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত করেন।
মেধা, সততা ও কর্মনিষ্ঠার কারণে তিনি মাত্র ৩০ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে সারা দেশে পরিচিতি পেয়ে যান। ১৯৬২ সালে তিনি স্বৈরাচার আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং কারারুদ্ধ হন। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনীত হন। এ সময়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর হয়ে যান এবং আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা বনে যান। ১৯৬৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। তৎকালে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের ছয় দফার বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনের পরামর্শ অনুযায়ী ৬ দফা উত্থাপিত করেন
১৯৬৬-৬৯ সাল পর্যন্ত তাজউদ্দীন কারাগারে ছিলেন। কারাগারে থাকাবস্থায় ১৯৬৮ সালে তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের কারণে পাকিস্তানী সামরিক শাসকেরা তাকে জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তির জন্যে তাজউদ্দীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি তিনি আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন।
রাত জেগে তিনি দলীয় বিবৃতি ও রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করতেন। বঙ্গবন্ধু অনেক দলীয় সিদ্ধান্ত তাজউদ্দীন আহমদের পরামর্শে গ্রহণ করতেন। তাজউদ্দীন নিজ দলে নির্ভরতার প্রতীক ছিলেন, আর প্রতিপক্ষ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে ত্রাস ছিলেন প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তার কারণে। তাজউদ্দীন সম্বন্ধে জুলফিকার আলী ভুট্টো একবার বলেছিলেন, “আমি তো শেখ মুজিবকে ভয় পাই না, আমি ভয় পাই তার পাশে বগলে ফাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঐ খাটো মানুষটিকে।”
তিনি ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতিহার প্রণয়ন, প্রার্থী নির্বাচনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে তাজউদ্দীন আহমেদ এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ও পরম নির্ভরতার বাতিঘর ছিলেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে করতে টালবাহানা শুরু করলে তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু সিরাজুল আলম খান ও তাজউদ্দীনের পরামর্শক্রমে স্বাধীনতা ঘোষণা দিতে সম্মত হন। এ সময় তাজউদ্দীন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পরিমার্জন করে দেন। ২৫ মার্চ রাতে তিনি বঙ্গবন্ধুর পরামর্শক্রমে আত্মগোপন করেন নিজের পরিবারকে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে। ২৭ মার্চ তিনি ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এরপরের গল্পটা তাজউদ্দীনের বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক বাংলাদেশের সশস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয়া। ২৮ মার্চ তিনি মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে ভারত যান আমির-উল ইসলামসহ। সেখানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াপূর্বক তাদের ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ৪ এপ্রিল যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেন।
ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনের সাথে দেখা হওয়ার শুরুতেই প্রশ্ন করেন “মুজিব কেমন আছে? সে ঠিক আছে?” জবাবে তাজউদ্দীন বলেন, “২৫ মার্চের পরে তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি, বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে এখানে পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যেকোনো মূল্যে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজন আশ্রয় ও খাদ্য।”
ঐ বৈঠকে তাজউদ্দীন ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে আশ্বস্ত করেন যথাসময়ে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে। ঐ বৈঠকে তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন। ৫ এপ্রিল তিনি আবার ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনায় বসেন। ইন্দিরা গান্ধী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে ভারতে অবস্থানের অনুমতি, সরকার পরিচালনায় সহায়তা দেন, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সহায়তা, শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্যে সহায়তা প্রদান, বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সহায়তা প্রদান, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বিমান প্রদানসহ অনেক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৭ এপ্রিল তিনি ও আমির-উল ইসলাম কলকাতায় ফিরে আসেন। আমির-উল ইসলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রণয়ন করেন এবং তাজউদ্দীন তা অনুমোদন করেন। দিল্লিতে অবস্থানকালে তাজউদ্দীন আহমেদ ভাষণ রেকর্ড করেন, বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে এ ভাষণ প্রকাশ করা হয়, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। পরে ১০ এপ্রিল শিলিগুড়ির এক গোপন স্থান থেকে আকাশবাণী বেতারে এ ভাষণ প্রকাশ করা হয়। এরপর তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিচালনা শুরু করেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে। তাজউদ্দীন বুঝতে পারেন, বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার জন্য স্বীকৃত একটি সরকার দরকার। এজন্য প্রবাসী সরকার গঠনের জন্য সৈয়দ আমির উল ইসলামকে সাথে নিয়ে আগরতলা রওয়ানা দেন, যাওয়ার পথে তিনি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ময়মনসিংহ সীমান্ত থেকে নিয়ে যান।
১৭ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় এবং শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। তিনি এদিন মেহেরপুরের নামকরণ করেন মুজিবনগর। এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান প্রক্রিয়া অত্যন্ত গোপনীয়তার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি আরেক রেডিও বার্তায় পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের প্রতি আহবান জানান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার জন্য। এরপর থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য তিনি সারাদেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে যাতায়াত করেন বিমানে করে। তিনি সারা রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তার পরিবার কলকাতায় থাকলেও তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন না করে তিনি দাম্পত্য জীবন উপভোগ করবেন না। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকালে তিনি প্রায়ই বিভিন্ন ক্যাম্পে ও রণক্ষেত্রে, দুর্গম অঞ্চলে চলে যেতেন মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারণকে অনুপ্রেরণা দিতে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বসে একসাথে আহার গ্রহণ করতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দিয়ে উজ্জীবিত রাখতেন। এছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায়ই বেতার বার্তা পাঠাতেন দেশের জনসাধারণের উদ্দেশ্যে শত্রুদের নিঃশেষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমদ ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এক বেতার বার্তায় দেশের সকল নাগরিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান বিজয়ের জন্য। তিনি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দেয়ার জন্য পাকিস্তানি শাসকদের আহবান জানান। তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃত বিজয় অর্জিত হবে না। তিনি তার ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বাংলাদেশের জনগণের ও ভারতের সহায়তা কামনা করেন।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে পরাধীন পূর্ব বাংলা নামক ভূ-খণ্ডকে স্বাধীন বাংলাদেশে রূপান্তর করতে সুদক্ষ নাবিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
এরপর তিনি ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশে এসেই সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে দেখা করেন ও তাদের খোঁজখবর নেন। তিনি বিশ্বনেতৃবৃন্দের নিকট বারবার আহবান জানান পাকিস্তানি শাসকদের চাপ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসলে তাজউদ্দীন আহমেদ অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। পরবর্তীতে তিনি পাট, মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ রূপরেখা প্রণয়ন করেন। চীন, ভারত, রাশিয়া সহ অনেক সমাজতান্ত্রিক দেশ ভ্রমণ করেন অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য। তার দায়িত্ব গ্রহণের ৫ মাসের মধ্যে ৫ লাখ টন খাদ্যশস্য আনার ব্যবস্থা করেন। তিনি ১৯৭২-৭৩, ১৯৭৩-৭৪, ১৯৭৪-৭৫ সালের বাজেট প্রণয়ন করেন অর্থমন্ত্রী হিসেবে। তিনি পাট-শিল্পকে রাষ্ট্রায়ত্ত করেন ও বিজেএমসি প্রতিষ্ঠা করেন।
তাজউদ্দীন আহমদ দেশের বাজারে পাকিস্তানি মুদ্রা নিষিদ্ধ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মোটামুটি স্থিতি এনে দিয়েছিলেন। তিনি আমেরিকার বিরোধিতা করতেন ও নিজে মস্কোপন্থী ছিলেন। তাছাড়া তিনি দেশের স্বার্থে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না। ফলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ কোনো অযাচিত চুক্তি চাপিয়ে দিতে পারত না বাংলাদেশের উপর।
তিনি কোথাও দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিতেন না, সাহায্য আনতেন মাথা উঁচু করে। নিজ দেশের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে তিনি অনেকের চক্ষুশূল হন। এছাড়া তার নিজ দলের সিনিয়র নেতারা ও তাজউদ্দীনের অর্জনে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে সরিয়ে দিতে নানা চক্রান্ত শুরু করে। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, তারা জানত বঙ্গবন্ধুকে দুর্বল করতে হলে তাজউদ্দীনকে সরিয়ে নিজেদের রাস্তা পরিষ্কার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা যাবে। তাই তো খন্দকার মোশতাকসহ কিছু ক্ষমতালোভী ব্যক্তি, বহুদলীয় ও বহু-রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তাজউদ্দীনকে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করানো হয় ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর।
তাজউদ্দীনের সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কের টানাপোড়ন ও তাদের চক্রান্তের সফল মঞ্চায়ন। ১৯৭৪ সালের শেষ দিক থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকে তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগে ও সরকারে একেবারে কোণঠাসা হয়ে যান। তাজউদ্দীনের অনুপস্থিতিতে ঘাতকেরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটানোর জন্য ফাঁকা মাঠ পেয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে, ঘাতকদের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন আর বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে লাশ হওয়া যেন বাংলাদেশের অদৃষ্টে লিখা ছিল তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধু থেকে দূরে সরে যাওয়ার পর থেকে।
পর্দার আড়ালের নায়ক
তাজউদ্দীন কখনোই মুখ ফুটে তার কীর্তির কথা বলতেন না বা কাউকে বলতেও দিতেন না, তিনি দেশ ও দেশের জন্য পর্দার আড়ালে থেকে চুপিসারে কাজ করে যাওয়াকে নিজের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাঙালি জাতির জন্য কী আত্মত্যাগ করেছিলেন কখনোই তা জনসম্মুখে বলেননি। তিনি কখনোই প্রচারের আলোয় আসতে চাইতেন না, নীরবে পরিশ্রম করে যেতে পারতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এক ক্যাম্পে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছিলেন-“মুছে যাক আমার নাম, তবু থাকুক বাংলাদেশ।”
মৃত্যু
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে তাজউদ্দীন আহমেদকে এক সপ্তাহ গৃহবন্দী করে রাখা হয়। ২৩ আগস্ট তাকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। কতিপয় বিপথগামী সৈন্য কেন্দ্রীয় কারাগারে সেলের ভেতর বন্দি অবস্থায় ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের ৩ তারিখ রাতে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে তাজউদ্দীন আহমেদসহ জাতীয় চার নেতাকে। তাজউদ্দীনের পেটে ও পায়ে গুলি লাগে। তিনি তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেন। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গতাজের সম্পর্কের ফাটল ধরিয়ে ঘাতকেরা দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি করে দিয়ে যায়, যার ক্ষতচিহ্ন আজও বাঙালি জাতি বয়ে চলেছে। হয়তো বয়ে বেড়াবে চিরকাল!
(লেখাটিতে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা মতামতের সাহায্য নেওয়া হয়েছে)