মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা। এই দিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জে. আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি রেসকোর্স ময়দানে মিত্রবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। তবে বেদনাদায়ক ও রহস্যজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে এ প্রশ্ন ইতিহাসবিদ, গবেষক এবং সাধারণ মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেন ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাঁর লেখায় একটি অভূতপূর্ব বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস। মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর যৌথ অভিযানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পর্যুদস্ত। এর মধ্যেই ওসমানী সাহেব তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে লক্ষ্ণৌতে গিয়ে আহত খালেদ মোশাররফকে দেখে আসার নির্দেশ দেন। খালেদ মোশাররফের আশঙ্কা ছিল যে, ভারত স্বাধীন বাংলাদেশের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। তিনি অভিযোগ করেন, ভারত আমাদের ভালো মানের চীনা অস্ত্র সরিয়ে নিম্নমানের ভারতীয় অস্ত্র সরবরাহ করছে।
লক্ষ্ণৌ থেকে ফেরার পথে ডা. জাফরুল্লাহ দিল্লিতে একটি অদ্ভুত ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। ফ্লাইটে তাঁর সঙ্গে ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ, যিনি তাকে দিল্লির চুক্তি নিয়ে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। কলকাতায় ফিরে ডা. জাফরুল্লাহ পুরো বিষয়টি ওসমানী সাহেবকে জানালে তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, “You sold the country, I will not be a party to it.”
ডিসেম্বরের প্রথম দিক থেকেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ওসমানীর চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, তাঁকে প্রয়োজনীয় যাতায়াতের জন্য হেলিকপ্টার সরবরাহে দেরি করা হয় এবং সামরিক যোগাযোগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। এমনকি, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকটি ইউনিট তাঁর নির্দেশ এড়িয়ে চলারও অভিযোগ ওঠে। যশোর ক্যান্টনমেন্টে ভারতীয় সেনাদের লুটপাটের খবর পেয়ে ওসমানী হতাশ হন। তাঁর বক্তব্য ছিল, “ভারত আমাদের সমরক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছে এবং তাদের উদ্দেশ্য সন্দেহজনক।” উদাহরণস্বরূপ, ভারত আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহে বিলম্ব করেছে এবং মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি অপারেশনে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। এছাড়া, কিছু ক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীর চাহিদার তুলনায় নিম্নমানের অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগও ওঠে। এরই মধ্যে জানা যায়, ভারত বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও পুলিশ ব্যবস্থায় নিজেদের লোক মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছে। ওসমানী এই পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করেন।
১৬ ডিসেম্বর সকালে ওসমানী সিলেট যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সিলেটের উদ্দেশ্যে ভারতীয় এম-৮ হেলিকপ্টারে যাত্রা শুরু হয়। যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন ওসমানী, তাঁর এডিসি শেখ কামাল, জেনারেল এম এ রব, ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত, এবং ডা. জাফরুল্লাহ।
যাত্রাপথে হঠাৎ একটি অজানা বিমান হেলিকপ্টারের ওপর গুলি চালায়। গোলা বিস্ফোরণে জেনারেল রব গুরুতর আহত হন এবং পাইলট জানান, অয়েল ট্যাংক ফেটে গেছে। হেলিকপ্টারটি বড়জোর দশ মিনিট উড়তে পারবে। এমন এক সংকটময় মুহূর্তে ওসমানী নিজে তৈলাধারের ছিদ্র বন্ধ করার চেষ্টা করেন এবং সাহস জুগিয়ে বলেন, “Do not worry my boys, I know Sylhet like the palm of my hands.”
শেষ মুহূর্তে একটি নিরাপদ স্থানে জরুরি অবতরণ করা হয়। স্থানীয় জনতা প্রথমে হামলাকারী ভেবে আতঙ্কিত হলেও ওসমানীকে চিনে বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ে।
এই আক্রমণ কারা চালিয়েছিল? এটি এখনো এক রহস্য। পাকিস্তানের সমস্ত বিমান তখন ধ্বংস বা গ্রাউন্ডেড ছিল, সুতরাং এটি ভারতীয় কোনো ষড়যন্ত্র ছিল কি না, সেই প্রশ্নও ওঠে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেনি, যা এই ঘটনার প্রকৃত কারণ নিয়ে সংশয় বাড়িয়ে দেয়। সব বিমান তখন ধ্বংস বা গ্রাউন্ডেড। সেক্ষেত্রে এটি কি ভারতীয় কোনো ষড়যন্ত্র ছিল? ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এই ঘটনার কোনো তদন্ত প্রকাশ করেনি।
ওসমানী সেদিন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে প্রবাসী সরকারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করার কারণ ছিল একাধিক। প্রথমত, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে তাঁর মতানৈক্য এবং দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে বিভাজন ও কৌশলগত মতভেদ। গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলাবদ্ধতায় ওসমানী প্রধানমন্ত্রীর আদেশ মান্য করেন। কিন্তু তাঁর মনে যে ক্ষোভ ছিল, তা স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়েছিল। ইতিহাস আজও সেই সিদ্ধান্তের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
১৬ ডিসেম্বরের সারেন্ডার অনুষ্ঠানে ওসমানীর অনুপস্থিতি শুধু একটি ঘটনার বিষয় নয়; এটি মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজনীতি, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং কৌশলগত বিভেদের প্রতিফলন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই অভিজ্ঞতা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি নতুন দিক উন্মোচন করে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সহজ ছিল না এবং এর পেছনে বহু অজানা অধ্যায় রয়েছে।
তথ্যসূত্র:
কালের খেয়ায়, ছাপা হয়েছে শুক্রবার ৯ জুন, ২০২৩। পৃষ্ঠা ৪ থেকে পৃষ্ঠা ৭। শিরোনাম, অগ্রন্থিত রচনা/মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি খন্ডচিত্র/জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ডা. জাফরুল্লাহ