পবিত্র কুরআনের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতকে ইসলামী শরীয়ার দ্বিতীয় উৎস হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। রাসূলের সুন্নতের এই মর্যাদা যুগ যুগ ধরে স্বীকৃত এবং সর্বজন সমর্থিত। উম্মতের দীর্ঘ ইতিহাসে কোন ইমাম, ফকীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির কেউই বিষয়টিকে অস্বীকার করেননি। তারা বরং অস্বীকারকারীদেরকে অবস্থাভেদে ভ্রষ্ট, মুরতাদ এবং মুলহিদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
প্রাচ্যবাদের হাত ধরে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে মুসলিম বিশ্বের উপর বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের পরিণামে বিচ্ছিন্ন কিছু নামধারী মুসলিম হাদীসের প্রামাণ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এবং সাধারণ মুসলিমদেরকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। দুঃখজনক বিষয় হল, মুসলিম সমাজের ভিতরই প্রাচ্যবিদদের কিছু ভাবশিষ্য তৈরি হচ্ছে। যারা সাধরণ মুসলিমদের ভিতরে বদ্ধমূল থাকা রাসূলের সুন্নাহের প্রতি অগাধ ভালবাসা ও বিশ্বাসকে আঘাত করছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের সকলের জন্যই জরুরী হল, ইসলামী শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস হিসেবে হাদীসের অবস্থানের মূল দর্শনকে বোঝা এবং ধারণ করা।
সার্বিকভাবে সুন্নত বলা হয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা, কাজ এবং তাকরীরকে। এই সুন্নত ইসলামী শরীয়ার দ্বিতীয় উৎস এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা পালনের আবশ্যিকতা ইসলাম ও কুরআনের অপরিহার্য দাবি। বিষয়টি আমরা কয়েকটি পয়েন্টের মাধ্যমে প্রমাণিত করব।
এক. পবিত্র কুরআনের অসংখ্য জায়গায় মহান আল্লাহ তা’য়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে সবগুলো আয়াত জমা করা সম্ভব না আলোচনা সংক্ষিপ্ত রাখার স্বার্থে। আমি কেবল কয়েকটি আয়াতের অনুবাদ তুলে ধরছি।
“তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো, যাতে তোমাদের উপর রহম করা হয়।” ( সূরা আলে ইমরান, ১৩২)
“যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে সে অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে।” (সূরা আহযাব, ৭১)
এই ধরণের কিছু আয়াতে মহান আল্লাহ তা’য়ালা রাসূলকে আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়ে তার ফজিলত বর্ণনা করেছেন। আবার এমন কিছু আয়াতও আছে যেখানে মহান আল্লাহ তা’য়ালা রাসূলের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়ে তাঁকে অমান্য করার ভয়াবহতাও বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
“আপনি বলুন! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো। এরপর তারা যদি বিমুখতা প্রদর্শন করে তাহলে আল্লাহ কাফেরদের ভালবাসেন না।” ( সূরা আলে ইমরান,৩২)
“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে মানো, রাসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের কর্ম বিনষ্ট করো না।” (সূরা মুহাম্মাদ,৩৩)
এরকম আরো অনেক আয়াত আছে, যেইসব আয়াতে মহান আল্লাহ তা’য়ালা রাসূলের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছে, এর সফলতা বর্ণনা করেছেন। পাশাপাশি যারা অমান্য করবে তাদেরকে কাফের, ফাসেক, আমল বিনষ্টকারী ইত্যাদি ভয়াবহ বিধায়ে অভিযুক্ত করেছেন।
দুই. প্রথম পয়েন্টে আমরা রাসূলের আনুগত্যের আবশ্যিকতার বিষয়টি অকাট্য হিসেবে জানতে পারলাম। এখন প্রশ্ন হল, আমরা কোন জিনিসের ক্ষেত্রে রাসূলের আনুগত্য করব? এই আনুগত্য কি কেবল কুরআনের বিধিবিধান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নাকি শর’য়ী বিধান রচনায় কুরআনের শব্দের বাইরে রাসূলেরও বিশেষ ও আল্লাহ প্রদত্ত সংরক্ষিত অবস্থান আছে? এই প্রশ্নের উত্তরও আমরা পবিত্র কুরআনের ভিতরই দেখতে পাই।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,” রাসূল তোমাদের যা দেন তোমরা তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাকো।” (সূরা হাশর, ৭)
অন্য আয়াতে বলছেন,” তোমরা তাদের সাথে কিতাল করো যারা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম করে না।” (সূরা তাওবা,২৯)
লক্ষ্য করুণ, উল্লেখিত আয়াত দুটিতে মহান আল্লাহ তা’য়ালা হালাল হারাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাসূলের স্বতন্ত্র অথোরিটির কথা বলেছেন। সূরা আহযাবের ৩৬ নং আয়াত, সূরা নিসার ৬৫ নং আয়াত, সূরা আ’রাফের ১৫৭ নং আয়াত সহ আরো বেশ কিছু আয়াতে মহান আল্লাহ তা’য়ালা কুরআনের বাইরে রাসূলকে আলাদাভাবে নির্দেশনা ও নিষেধাজ্ঞা দানের মর্যাদা এবং দায়িত্ব দিয়েছেন।
তিন. পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তা’য়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উত্তম নমুনা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন,” যারা আল্লাহ ও আখিরাতের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম নমুনা।” (সূরা আহযাব,২১)
আর নমুনা এমন কিছু হয়, যা প্রায়োগিক এবং কার্যকর। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন পবিত্র কুরআনের সেই প্রায়োগিক রূপদাতা। এজন্যই সুন্নতকে কুরআনের ব্যাখ্যা বলা হয়। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের অন্যতম দায়িত্ব ছিল, মানুষকে কুরআনের ব্যাখ্যা শুনানো। মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলছেন, “আপনার কাছে আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষের সামনে সেসব বিষয় বিস্তারিত বিবৃত করতে পারেন যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে।” (সূরা নাহল,৪)
আরবরা আরবীভাষী হওয়া সত্ত্বেও তিনি রাসূলকে কুরআন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দায়িত্ব দিয়েছেন। এর থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যায়, এই বিশ্লেষণ শাব্দিক অর্থ ও শাব্দিক মর্ম ব্যতীত ভিন্ন জিনিস। এই বিশ্লেষণ সেই বিশ্লেষণ, যা ইসলামের সামগ্রিকতাকে ধারণ করে এবং যা আল্লাহ রাসূলের কাছে গাইরে মাতলু (অপাঠিত) ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন। ফলে রাসূলের এইসব বাণীও ওহীর অন্তর্ভুক্ত। কারণ মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলছেন, “তিনি প্রবৃত্তির তাড়নায় কিছু বলেন না। বরং তা ওহী যা তার কাছে প্রত্যাদেশ হয়।” (সূরা নাজম- ৩,৪)
উপরের আলোচনায় আমরা দেখতে পেলাম রাসূলের কথা, কাজ ও সমর্থন মুসলিম উম্মাহর জন্য অবশ্য পালনীয় বিষয় এবং ইসলামী শরীয়ার একটি উৎস হওয়ার ব্যাপারটি কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। আর এই কুরআন কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর জন্য অবশ্য পালনীয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে আর কোন আসমানি গ্রন্থ আসবে না,যা কুরআনকে রহিত করবে। সুতরাং কিয়ামত অবদি কুরআনের নির্দেশ কার্যকর থাকার অপরিহার্য দাবি হল, রাসূলের সুন্নতও কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে। নতুবা পবিত্র কুরআনের উপর বুতলান তথা অকার্যকরীতার মত জঘন্য অপবাদ চলে আসে। (নাঊযুবিল্লাহ)
রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের সর্বশেষ নবী। তার পর আর কোন নবী আসবেন না। উপরের আলোচনায় আমরা এটাও দেখেছি যে, রাসূল তথা রিসালাতের দায়িত্ব হিসেবে মহান আল্লাহ তা’য়ালা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আইনি ক্ষমতা, মর্যাদা ও দায়িত্ব দান করেছেন। আর এই অবস্থান নির্দিষ্ট কোন জমানার সাথে সম্পৃক্ত নয়। বরং মহান আল্লাহ তা’য়ালা কিয়ামত পর্যন্ত সর্বশেষ নবী এবং সমগ্র মানবজাতির রাসূল হিসেবে তাঁকে প্রেরণ করেছেন। (দেখুন: সূরা আরাফ-১৫৮, সূরা সাবা-২৮, সূরা আহযাব-৪০)
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ রাসূল- এটি দ্বীনে ইসলামের মূল বিশ্বাসের একটি অংশ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের অপরিহার্য দাবি হল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের সাথে সম্পৃক্ত সমস্ত বিষয় কিয়ামত পর্যন্ত বহাল, সংরক্ষিত এবং কার্যকর থাকবে। এখন আমরা যদি বর্তমান সময়ে রাসূলের সুন্নতকে অসংরক্ষিত দাবি করি, তবে সেটা আল্লাহর দেয়া দ্বীনে ইসলাম ও কুরআনের উপর অপবাদ হয়ে যাবে। এবং এই দ্বীনকে রহিত হিসেবে দাবি করা হয়ে যাবে। মা’আযাল্লাহ।
ইসলামী জ্ঞানতত্ত্বে এটাই হাদীসে নববীর প্রামাণ্যতার মূল দর্শন। আমরা যদি এই মূল দর্শনটা বুঝতে পারি, তখন হাদীসের প্রামাণ্যতা নিয়ে কোন প্রশ্নই আসার সুযোগ নেই। কারণ ইসলাম ও কুরআনের অপরিহার্য দাবি হল, রাসূলের আনুগত্য ও তার সুন্নাহর প্রতিপালন কিয়ামত পর্যন্ত বহাল ও কার্যকর থাকবে। যেহেতু আর কোন নবীও আসবেন না এবং কুরআনকে রহিতকারী নতুন কোন কিতাবও আসবে না। সুতরাং সুন্নতে নববী কিয়ামত পর্যন্তই সংরক্ষিত এবং পালনযোগ্য থাকবে, যেকোনভাবেই হোক। এটাকে সংরক্ষিত রাখা স্বয়ং মহান আল্লাহ তা’য়ালা নিজ যিম্মায় নিয়েছেন।
এখন আমাদের দেখার বিষয় হল, তিনি কিভাবে সুন্নতের ভাণ্ডারকে সংরক্ষিত রেখেছেন। এবং তার সংরক্ষিত রূপ পর্যন্ত পৌঁছার এবং শুদ্ধভাবে বোঝার সঠিক পদ্ধতি কি। এখানে এই প্রশ্ন আসার সুযোগই নেই যে, সুন্নতের ভাণ্ডার আসলেই সংরক্ষিত আছে কি নেই। কারণ কিয়ামত পর্যন্ত তা সংরক্ষিত থাকবেই। এটাই ঈমান, ইসলাম ও কুরআনের অপরিহার্য দাবি। এখানে চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস মুমিনের নেই। আমাদের জানতে হবে, মুহাদ্দিসীনে কেরামকে কতটা কষ্ট ও সতর্কতার মধ্যে রেখে উম্মতের বিশ্বস্ত সিলসিলা ও সনদের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তা’য়ালা দ্বীনের এই উৎসকে সংরক্ষিত রেখেছেন।
পরিশেষে কথা হল, আমরা যদি হাদীসের ভাণ্ডার নিয়ে সন্দিহান হয়ে যাই তবে আমাদের সালাত, হজ্ব, জাকাত কিছুই থাকবে না। আমরা যদি উম্মাহর বিশ্বস্ত সনদের সিলসিলাকে অবিশ্বাস করে বসি তাহলে আমাদের কাছে দ্বীনের কিছুই থাকবে না। এমনকি কুরআনও না। কারণ এই কুরআনের সুবিন্যস্ত সংকলনটাও উক্ত সিলসিলায়ে আদেলার মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। এজন্যই সালাফদের অনেকেই হাদীস অস্বীকারকারীদেরকে মুরতাদ, মুলহিদ এবং ইসলাম থেকে খারিজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মহান আল্লাহ তা’য়ালা মুসলিম সমাজকে ইনকারে হাদীস এবং সর্বোপরি প্রাচ্যবাদের ফিৎনা থেকে হিফাজত রাখুন। আমিন।