সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না পরিবহন নেতাদের চাপেই
Advertisements

২০১৮ সালে দেশজুড়ে প্রবল ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ফেরানোর লক্ষ্যে ১৮টি নির্দেশনা দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিট। দু-একটি বাদে সেসব নির্দেশনার বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয়নি এখন পর্যন্ত। পরের বছর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১১১টি সুপারিশ করে সাবেক নৌ-পরিবহনমন্ত্রী ও শ্রমিক নেতা শাজাহান খানের নেতৃতে গঠিত একটি কমিটি। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে শক্তিশালী টাস্কফোর্স। তিনটি সভা ছাড়া দৃশ্যমান আর কিছুই করতে পারেনি এ টাস্কফোর্স। ২০১৮ সালে পাস হয়েছে সড়ক পরিবহন আইন, যার বিধিমালা এখনো তৈরি হয়নি। এর মধ্যেই নেয়া হয়েছে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ। সড়ক নিরাপত্তায় আইন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা, বিভিন্ন কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতাদের দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বর্তমানে দেশের সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোয় তিনজন ব্যক্তির দৃশ্যমান নিয়ন্ত্রণের কথা জানিয়েছেন পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে খন্দকার এনায়েতুল্লাহ ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তিনি একই সঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিবও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য খন্দকার এনায়েতুল্লাহর। ঢাকার বাইরেও যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে এ পরিবহন মালিক নেতার। জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা রয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতির দায়িত্বে। ঢাকার বাইরের পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে মশিউর রহমান রাঙ্গার। অন্যদিকে দেশের পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে সাবেক নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের। তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীও পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ তিন-চারজন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতা বড় চাপ প্রয়োগকারী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছেন। ধর্মঘট, কর্মবিরতির মাধ্যমে তারা এরই মধ্যে সড়ক আইন সংশোধনীর দাবি আদায়ের কাছাকাছি চলে এসেছেন। তাদের অনড় অবস্থানের কারণেই সম্প্রতি বেড়েছে গণপরিবহন ও পণ্যবাহী যানবাহনের ভাড়া। অতীতে বিভিন্ন সময় তারা একইভাবে সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেমন আদায় করে নিয়েছেন, তেমনি সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নেও দাঁড়িয়েছেন বাধা হয়ে।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনও নিরাপদ সড়ক ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের দায়ী করছেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা দেখে আসছি, পরিবহন খাতে একটি চাপ প্রয়োগকারী গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা আদায়ের নামে কথায় কথায় ধর্মঘটে যায় এ গোষ্ঠী। বর্তমানে গোষ্ঠীটি আরো অনেক শক্তিশালী হয়েছে। তাদের শক্তি এখন এতটাই বেশি যে সরকারও তাদের ভয় পায়। এ কারণে আমরা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দেয়া নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সড়ক আইন কার্যকর হচ্ছে। এসবের দরুন সড়ক নিরাপদ তো হচ্ছেই না, উল্টো দিন দিন আরো অনিরাপদ হচ্ছে। আমরা নিরাপদ সড়ক করার প্রতিশ্রুতি পাই, কিন্তু আদতে সেগুলোর বাস্তবায়ন দেখি না।

পরিবহন খাতের চাপ প্রয়োগকারী গোষ্ঠীটিকে সরকার ভয় পায়—ইলিয়াস কাঞ্চনের এ মন্ত্যব্যের প্রতিফলন ঘটেছে গতকাল বিআরটিএ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত শিক্ষার্থীদের ‘হাফ পাস’ দাবির বিষয়ে এক বৈঠকের পর সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলামের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, আমরা যদি শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া নেয়ার দাবিটি মালিক-শ্রমিকদের ওপর চাপিয়ে দিই, তাহলে তারা ধর্মঘটের মতো কর্মসূচিতে যেতে পারেন। এতে জনভোগান্তি তৈরি হবে। তাই আমরা মালিকদের অনুরোধ করেছি শিক্ষার্থীদের হাফ পাস দাবিটি বিবেচনায় নেয়ার জন্য। তারা নিজেরাই যেন এ বিষয়ে একটা প্রস্তাব ঠিক করে আমাদের দেন, সে অনুরোধ করেছি।

২০১৮ সালের নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১৮টি নির্দেশনা দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিট। চলন্ত বাসের দরজা বন্ধ রাখা, যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানো-নামানো বন্ধ, বাসের দৃশ্যমান স্থানে চালক ও হেলপারের ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর, সেলফোন নম্বর প্রদর্শন, মোটরসাইকেল আরোহীদের বাধ্যতামূলক হেলমেট পরিধান, বাসে চালক ও যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহার, ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাসের উভয় পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে রাস্তা পারাপার সম্পূর্ণ বন্ধ করা, ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাসগুলোতে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সব সড়কে জেব্রা ক্রসিং ও রোড সাইন দৃশ্যমান করা, ফুটপাত হকারমুক্ত রাখা, অবৈধ পার্কিং ও স্থাপনা উচ্ছেদ করা, ঢাকার সড়কে স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু, অবৈধ ও আনফিট পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মতো বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। বাস্তবে মোটরসাইকেল আরোহীদের বাধ্যতামূলক হেলমেট ব্যবহার ছাড়া আর কোনো নির্দেশনাই সেভাবে বাস্তবায়ন হয়নি।

এসব উদ্যোগের বাস্তবায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. মিজানুর রহমান বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা বলি আর সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন বলি, অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এই যে একটা আন্দোলন হলো, তার পরিপ্রেক্ষিতে নানা নির্দেশনা এল, কিন্তু বাস্তবায়নের বেলায় গিয়ে কিছুই হলো না। তার দায়টা কিন্তু সরকারের ওপরই বর্তায়। পাশাপাশি পরিবহন মালিক-শ্রমিকদেরও কিন্তু একটা দায় থেকে যায়। কারণ সড়কের বড় স্টেকহোল্ডারদের একটা বড় অংশ তারা।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর পরই সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ পাস করে সরকার। তবে এখনো আইনটির বিধিমালা তৈরি হয়নি। যদিও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চাপের মুখে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। তাদের দাবির মুখে দুর্ঘটনার মামলায় চালকদের জামিনসহ বিভিন্ন ধারায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণ কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

দেশের সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাবেক নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। ১৫ সদস্যের ওই কমিটি সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য ১১১টি সুপারিশসংবলিত একটি প্রতিবেদন কাউন্সিলে জমা দেয়। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য গঠন করা হয় টাস্কফোর্স, যার সভাপতি করা হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। গঠনের পর এ টাস্কফোর্স মাত্র তিনটি বৈঠক করেছে। এর বাইরে সুপারিশ বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি এ টাস্কফোর্স।

সামগ্রিকভাবে দেশের সড়ক পবিবহন খাতের বিশৃঙ্খলার জন্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপ প্রয়োগের কথা বলা হলেও এসব সংগঠনের নেতারা তা মানতে নারাজ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগগুলোকে আমরা সবসময় স্বাগত জানিয়ে আসছি। পাশাপাশি সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।

সূত্রঃ বণিক বার্তা

Advertisements