বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, স্বৈরাচার সরকারের সুবিধাভোগীরা ঘরে-বাইরে, প্রশাসনে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে চায়। ষড়যন্ত্রের বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে না পারলে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের অর্জন বিপন্ন হবে। রাষ্ট্রকে জনগণের প্রত্যাশিত কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, স্বৈরাচারের দোসরদের বসিয়ে রেখে কোনো উপকার মিলবে না। মাফিয়াচক্র বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে। তবে মানুষ বাকস্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। মাফিয়াচক্রের কবল থেকে বঞ্চিতরা অধিকার চায়। শহীদদের রক্তের দাগ এখনো শেষ হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যক্রম সম্পাদন করতে হবে। সরকারের কিছু সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) বিকেলে এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন। জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের (জেডআরএফ) ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী তথা রজতজয়ন্তী উপলক্ষে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এসময় জেডআরএফ’র ওভারসিজ কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ডা: জুবাইদা রহমানও ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিলেন।
তারেক রহমান নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সমালোচনা করে বলেন, বর্তমানে দেশে কৃষক-শ্রমিক-দিনমজুর এবং স্বল্প আয়ের মানুষ দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখোমুখি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যে দিশেহারা। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও মানুষের আয় সেভাবে বাড়েনি। সরকারকে বলবো- জিনিসপত্রের দাম কমাতে পদক্ষেপ নিন। সিন্ডিকেট ভেঙে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনুন। প্রয়োজনে উপদেষ্টা পরিষদের আকার বাড়ানো যেতে পারে।
তিনি রাষ্ট্রের সংস্কার নিয়ে বলেন, সংস্কার অনেক প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেটি ধারাবাহিক ও চলমান প্রক্রিয়া। কখনো সময়সাপেক্ষ। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। জনগণের সাথে সংস্কার কাজ করলে সেটি সহজ হয়।
তারেক রহমান আরো বলেন, ‘স্বৈরাচারের আমলে তাদের বিভিন্ন নেতাকর্মী দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি-জায়গা, দোকান ও ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান দখল করেছিল। তারা সেগুলো পুনরুদ্ধারে মরিয়া হয়েছে। সেগুলো পুনরুদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ। নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের যেমন দায়িত্ব তেমনই রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের দায়িত্ব রয়েছে। সেজন্য সবাইকে স্বেচ্ছাসেবীর মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। আসুন আমরা প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে প্রত্যেকে আমরা প্রত্যেকের তরে এই মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাই। আমি সবশেষে জুলাই-আগস্টে হতাহত এবং ক্ষতিগ্রস্তদের আবার কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি।’
জেডআরএফ’র কার্যক্রম প্রসঙ্গে সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য নাম। জেডআরএফ একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। দীর্ঘদিন ধরে আপনারা বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করছেন এটি প্রশংসনীয়। সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। জেডআরএফ’র কার্যক্রমকে আমি সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। স্বৈরাচার সরকারের পতন আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সারাদেশে জেডআরএফ’র স্বেচ্ছাসেবীরা অভাবনীয় কাজ করেছে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে বলেন, ‘আজকে স্বাধীন দেশে আমরা আছি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লব হয়েছে। নতুন প্রজন্ম রাজনীতি বিমুখ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জুলাই-আগস্টের বিপ্লবে ছাত্র-জনতা কিন্তু মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন। তারাই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে লড়েছেন। আজকে তারাই রাজনীতিতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। তবে তাদেরকে দায়িত্ব বোধ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বিচারের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা দেশকে ভালোবাসি।’
ড. মঈন খান বলেন, ‘বিএনপির হাল ধরেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার আগে জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর বেগম খালেদা জিয়া হাল ধরেছিলেন। তিনি নেতৃত্ব দিয়ে দলকে মানুষের কাছে নিয়ে যান। এই যে ত্যাগের ধারাবাহিকতা সেটি নতুন প্রজন্মকে মনে রাখা উচিৎ। জিয়াউর রহমান মাত্র চার বছরে দেশের যে পরিবর্তন এনেছিলেন পরবর্তী ৪০ বছরেও অন্যরা আনতে পারেনি। আজকে পরিবেশের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু জিয়াউর রহমানই তো প্রথম খাল খনন কর্মসূচি করেছিলেন। এটিই তো পরিবেশবান্ধব কর্মসূচি। তিনি নতুন পরিচয় দিয়েছেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। যা একটি ফুলের বাগান। সেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেরা রয়েছেন। তিনি মনে করতেন বাংলাদেশের সকল ক্ষমতার উৎস দেশের জনগণ। সুতরাং দেশপ্রেমিক সবারই উচিৎ শহীদ জিয়াউর রহমানের আদর্শকে ধারণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা।’
ড. মঈন খান আরো বলেন, ‘বিএনপি লগি-বৈঠা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি করে না। বিএনপি জনগণের জন্য রাজনীতি করে। জেডআরএফ যার নামে হয়েছে তার কথা বলতে গেলে বলা শেষ হবে না। জেডআরএফ নিরলসভাবে দেশের গরিব-অসহায় মানুষকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। আজকে জিয়াউর রহমানের কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। তিনি কালুরঘাট বেতারেকন্দ্রে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জীবন বাজি রেখে সম্মুখসমরে যুদ্ধ করেছিলেন। যা দেশবাসীকে আরো বেশি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ উপাধি বীর উত্তম উপাধি লাভ করেন। তিনি উন্নয়ন-উৎপাদনের রাজনীতি শুরু করেন। কোটি কোটি মানুষের জীবন পদ্ধতি পরিবর্তন করে আধুনিক পর্যায়ে নিয়ে যান। জেডআরএফ শুধু ২৫ বছর নয়, দুইশত পঞ্চাশ বছর ধরে জিয়াউর রহমানের কর্মকাণ্ড তুলে ধরবে।
রজতজয়ন্তী উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, পররাষ্ট্রনীতি এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক অধ্যাপক এম. শাহীদুজ্জামান, রাষ্ট্রদূত এস এম রাশেদ আহমেদসহ নিহত ও আহত পরিবারের কয়েকজন।
এসময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপি ও পেশাজীবী নেতৃবৃন্দের মধ্যে অধ্যাপক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম, প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম রিজু, ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ উদ্দিন বকুল, সাইফুল আলম নীরব, গোলাম সারওয়ার, সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, অধ্যাপক আখতার হোসেন খান, ড. মো: আব্দুর রশিদ, অধ্যাপক লুৎফর রহমান, ডা: হারুন আল রশিদ, ডা: মো: আব্দুস সালাম, ডা: শাহ মুহাম্মদ আমান উল্লাহ, ডা: শাহাদত হোসেন, ডা: মো: আনোয়ারুল হক, অধ্যাপক এস এম আব্দুল আওয়াল সোহাগ, ড. আব্দুল করিম, ড. আবুল হাসনাত মো: শামীম, সাংবাদিক আব্দুল হাই শিকদার, কামাল উদ্দিন সবুজ, আমিরুল ইসলাম কাগজী, আতিকুর রহমান রুমন, প্রকৌশলী মাহবুব আলম ও প্রকৌশলী আইয়ুব হোসেন মুকুলসহ অনেক ডাক্তার, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে অধ্যাপক ছবিরুল ইসলাম হাওলাদারের কুরআন তিলাওয়াতের পর অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন রজতজয়ন্তী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ডা: সৈয়দা তাজনিন ওয়ারিস সিমকী।
অনুষ্ঠানে গত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ১০ জন নিহতের পরিবার এবং ১০ জন আহতকে ক্রেস্ট দিয়ে সম্মাননা জানানো হয়। নিহতদের পরিচয় তুলে ধরেন ব্যারিস্টার মীর হেলাল, ডা: পারভেজ রেজা কাকন এবং ডা: সরকার মাহবুব আহমেদ শামীম। আহতদের পরিচয় তুলে ধরেন ডা: সাজিদ ইমতিয়াজ উদ্দিন।
এরআগে সকালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে নেতাকর্মীদের নিয়ে জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এসময় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা: ফরহাদ হালিম ডোনার, রজতজয়ন্তী উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, জেডআরএফের শামীমুর রহমান শামীম, ডা: পারভেজ রেজা কাকন, ডা: সরকার মাহবুব আহমেদ শামীম, প্রকৌশলী মাহবুব আলম, ড. আবুল হাসনাত মো: শামীম, ডা: এ কে এম মাসুদ আখতার জীতু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালের ১৮ অক্টোবর জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্মৃতি রক্ষায় এই প্রতিষ্ঠাটি গড়ে তুলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্টও তিনি। জেডআরএফ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ‘একটি উদ্যোগ, একটু চেষ্টা এনে দেবে স্বচ্ছলতা, দেশে আসবে স্বনির্ভরতা’ স্লোগান নিয়ে গরীব এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করে আসছে।