সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের মুসলিম পরিচিতি
Advertisements

১.সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন (১৯২০-১৯৯৫) ছিলেন একজন ধ্রুপদী মুসলিম জাতীয়তাবাদী এবং কেতাদুরস্ত শিক্ষাবিদ। তার জীবনযাপন ও শৈলী এমন ছিল যা তাকে বাঙালি মুসলমান আশরাফ সমাজের একজন বিশিষ্টজন করে তুলেছিল। তিনি উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী ও সুশৃঙ্খল বাঙালি মুসলমান অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবী বর্গের একজন নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি ছিলেন। তার ব্যক্তিত্বে একাধারে ধ্রুপদী ইসলামীয় বুনিয়াদ এবং ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষজ্ঞতার বিরল সম্মিলন ঘটেছিল। ইসলামিকতা ও আধুনিকতার এমন অসাধারণ ও বিদগ্ধ যুগলবন্দী যে অল্প কয়েকজন বাঙালি মুসলিম শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবি ও চিন্তকদের মধ্যে উদ্ভাসিত হয়েছিল তিনি ছিলেন তাদের প্রধানতম। স্কুল পর্বে মাদরাসা শিক্ষা এবং এরপরে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে আধুনিক শিক্ষার সুষমিত সংশ্লেষ তাকে দিয়েছিল একধরনের সম্পূর্ণতাছোঁয়া বিদ্যা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। বিলেতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই শিক্ষাজীবনের শীর্ষবিন্দু হিশেবে ডক্টরেট ডিগ্রিও তিনি হাসিল করেছিলেন। আর এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম। শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন পর্বে শীর্ষস্থান অর্জন করা তার জন্যে রীতিমত একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল।

২.মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রতি ছাত্রজীবনেই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনই চল্লিশ দশকে ‘পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ গঠন করেছিলেন। প্রকাশনা ও লেখালেখিতে সক্রিয়তার শুরু এই সময় থেকেই। সম্মেলন আয়োজন করে আসন্ন আজাদীর মর্মশাঁসকে সহযোগী ও সমর্থকদের মধ্যে প্রচার ও প্রসারে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। একই বিষয়ে কলকাতায় ‘পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’র সম্মেলনের একটি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। মাত্র ২৪ বছর বয়সে এই কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন।১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের আজাদী হাসিলের পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে শিক্ষক হিশেবে যোগ দেন। ষাট দশকের বিভিন্ন পর্বে তিনি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হবার পরে যথাক্রমে রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন।

সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের কৃতী ছাত্র হিশেবে এবং পরবর্তীকালে কেতাদুরস্ত ও এংলোফিল অধ্যাপক হিশেবে একজন কিংবদন্তীসুলভ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। তার পোষাক-পরিচ্ছদ ও জীবনশৈলী ছিল অভিজাত, বর্ণাঢ্য ও চৌকস। তিনি নিজে যেমন এক্ষেত্রে অত্যন্ত পরিপাটি ও উচ্চবর্গীয় রুচি অনুসারী ছিলেন তেমনি তিনি তার ছাত্রদের কাছ থেকেও একইরকম শরাফতি ও উচ্চমান প্রত্যাশা করতেন। এর পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে যে মতামত ও বিদ্রুপ-বিতর্ক উদ্গীরিত হত তা তাকে একজন আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। কিন্তু তার শিক্ষার্থীজীবনের উজ্জ্বল ফলাফল ও শিক্ষকজীবনের বর্ণাঢ্যতা, মেধার্জিত যোগ্যতা, বৈদগ্ধ ও অভিজ্ঞতাবলে উপাচার্য পদলাভ তাকে একজন সমীহযোগ্য শিক্ষাবিদ করে তুলেছিল। শিক্ষা প্রশাসনের পদসোপানে তার এই উর্ধ্বমুখী ও দ্রুত উত্তরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ ছিল না। তার মেধা, যোগ্যতা ও কর্মসাফল্যের কারণে এটাই ছিল বরঞ্চ স্বাভাবিক ও অনিবার্য।তাকে নিয়ে যে বিতর্কটি পরবর্তীকালে দেখা দিয়েছে সেটি সম্পূর্ণত একটি রাজনৈতিক বিষয়। তিনি একাত্তর সালে সাধারণ নির্বাচন উত্তর ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে যে রাজনৈতিক ও সামরিক সংকট দেখা দিয়েছিল সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিশেবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তার ভাষায় “বিচ্ছিন্নতাবাদী” কর্মকান্ডকে তিনি সমর্থন করতে পারেননি। এটি তার কাছে ছিল তার আজীবন লালিত বিশ্বাস ও আদর্শের প্রশ্ন। এক্ষেত্রে তিনি কোনোরকম আপোষ কিংবা আত্মসমর্পণ করতে রাজী ছিলেন না। তবে তিনি দাবি করতেন যে তিনি নিজে কোনো রকমের অপরাধ করেননি; কিংবা অন্য কাউকেও অপরাধে প্ররোচিত বা উদ্বুদ্ধ করেননি। ১৬ ডিসেম্বরের পরে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, নির্যাতন করে মৃত ভেবে ফেলে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে তিনি বেঁচে যান; পরে চিকিৎসা পাবার পরে জেলে বন্দী জীবন কাটান ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত।

সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের মেধা ও প্রতিভা তার সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কিংবদন্তী তৈরি করেছিল তা একই বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী কবি বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে যে মিথ আছে তার কথাই মনে করিয়ে দেয়। বুদ্ধদেব বসুও কলকাতায় তার পরবর্তী সাহিত্যিক, সম্পাদনা ও অধ্যাপনা জীবনে খুব স্টাইলিশ ও এংলোফিল ছিলেন। আবার সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের এংলোফিলিজমে এমন কিছু অনুষঙ্গ ছিল যা কোনো কোনো সময় হয়তো সাহেবীপনা বলে প্রতীয়মান হতে পারে; যেমন কথিত আছে যে যখন তিনি কোথাও আমন্ত্রিত হতেন তখন তিনি তার নিজের ব্যবহারের জন্য পকেটে করে কাঁটা চামচ ও ছুরি নিয়ে যেতেন; কারণ তিনি হাত দিয়ে খাওয়াকে নীচু সভ্যতার নিদর্শন বলে মনে করতেন। এসব ক্ষেত্রে তার আচার-আচরণকে আরেক প্রখ্যাত বাঙালি এংলোফিল লেখক নীরদ সি চৌধুরীর সঙ্গে তুলনা করলে বোধকরি খুব ভুল করা হবে না।

৩.সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের বুদ্ধিবৃত্তিক বুনিয়াদে ছিল মুসলিম উম্মাহভিত্তিক সভ্যতা, সংস্কৃতি ও পরিচিতির এক ধ্রুপদী বোঝাপড়া। আরবি, ফারসি, উর্দু ও তুর্কী ভাষায় বিধৃত উচ্চাঙ্গের মুসলিম সাহিত্য, ধর্মচিন্তা ও সংস্কৃতিকে তিনি মুসলমানদের সাধারণ গৌরব ও মহিমান্বিত ঐতিহ্য হিশেবে গ্রহণ করতেন। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিদ্যার সর্বোচ্চ স্তরে কৃতিত্বের সঙ্গে ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করেছিলেন। কিন্তু এই শিক্ষা ও বিদ্যাকে তিনি তার মুসলিম বুনিয়াদী শিক্ষা ও জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখে বুনন করতে পেরেছিলেন। এখানেই সাজ্জাদ হোসায়েনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্য ও বৈশিষ্ট্যসূচক স্বাক্ষর নিহিত। তার জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তিকাঠামোতে ছিল তার ধর্মবিশ্বাসের নির্যাস। যার উৎসমূল হিশেবে তিনি বরণ করেছিলেন রাসুল স.-এর উপরে নাজিলকৃত প্রত্যাদেশরূপ ওহি। তার যাবতীয় মানব অর্জিত হিকমা ও জ্ঞানকান্ডের অস্তিত্ব ও মূল্য নির্ধারিত হত এই ইলমী বুনিয়াদের কষ্টিপাথরে। এই কারণে তার চিন্তা ও ভাবনাবিশ্ব ছিল একধরনের অবিচল ও অটল তৌহিদী আত্মবিশ্বাসে অলংকৃত ও সজ্জিত।

৪.আর এই তৌহিদী জ্ঞানতত্ত্বের প্রেরণায় তিনি বাঙালি মুসলমানের অটল অনড় আত্মপরিচিতি, জাতিসত্তা ও রাষ্ট্রসত্তা নিরূপণ করেছিলেন। যার মধ্যে বিধৃত সত্যনিষ্ঠা ও ইতিবাচকতা আজ সময়ের পরিক্রমায় ক্রমশঃ উদ্ভাসিত হচ্ছে। তিনি নিজেও একাত্তর উত্তর বাংলাদেশের বাস্তবতার আলোকে কিভাবে বাঙালি মুসলমান বিশ্বে একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি ও রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে পারে তার একটা দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন তার লেখা বিভিন্ন গ্রন্থের মাধ্যমে।

৫.প্রতিটি মানুষেরই সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু মেধাবী ও আদর্শনিষ্ঠ মানুষদের একটি বা দুটি সীমাবদ্ধতা দিয়ে তাদের ইতিবাচক ভূমিকা ও অবদানকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দেয়াটা একটা আত্মঘাতী মনোভাব। এ ধরনের অন্ধ উপেক্ষা ও প্রত্যাখ্যানের সংস্কৃতি থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। যার যা প্রাপ্য সম্মান তাকে তা দিতে হবে।

Advertisements