ইসলাম ধর্মের সাথে সম্পর্কিত বইগুলোকে রাষ্ট্র উগ্রবাদী বই হিসেবে চিহ্নিত করছে। রাষ্ট্রের দেয়া উগ্রবাদী বা জঙ্গি চেনার ইন্ডিকেটরের সাথে মিলে যাচ্ছে ধার্মিক মুসলিমদের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য। নবীজীর জীবনী হয়ে যাচ্ছে উগ্রবাদী বই আর টাখনুর উপর কাপড় পড়া হয়ে যাচ্ছে জঙ্গির আলামত। রাষ্ট্রের এসকল কার্যকলাপে অনেকেই বিস্মিত হচ্ছেন, অনেকে পরামর্শ দিচ্ছেন উগ্রবাদী বই চিহ্নিত করতে রাষ্ট্রকে আরো সতর্ক হওয়া উচিত। আবার বড় একটি অংশ কেন এমনটি ঘটছে বুঝে উঠতে পারছেন না। এই সমস্যাটা বুঝতে আমাদের প্রথমে রাষ্ট্রের(State) চরিত্রের দিকে নজর দেয়া জরুরি, বিশেষত সেক্যুলার রাষ্ট্রের।
সেক্যুলার রাষ্ট্র নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্ম থেকে পৃথক দাবি করলেও তার নিজেরই রয়েছে নিজস্ব ধর্মভাব। রাষ্ট্র সর্বদা নাগরিকদের অখণ্ড, নিরবিচ্ছিন্ন ও নিঃশর্ত আনুগত্য দাবি করে। যেমনটা আমরা ধর্মকে তার অনুসারীদের প্রতি করতে দেখি। রাষ্ট্র পবিত্রতার কতগুলো সিম্বল নির্মাণ করে। যেমন: জাতীয় পতাকা,জাতীয় সঙ্গীত,শহিদ মিনার, জাতির জনক ইত্যাদি। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় দাঁড়ানো, জাতির জনকের সম্মানে বিশেষ আইন, শহিদ মিনারে খালি পায়ে যাওয়া ইত্যাদি বিধিমালা রাষ্ট্রীয় সিম্বলে পবিত্রতা আরোপ করে। কেউ পতাকাকে লাঞ্ছনা করলে বা শহীদ মিনারের ‘অবমাননা’ করলে, এমনকি জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করার কথা বললেও সেটা রাষ্ট্রদ্রোহীতার পর্যায়ে ফেলা হয় ঠিক যেমনটা ধর্ম ধর্মদ্রোহীতাকে অনেকসময় রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে শাস্তির কথা বলে। কেউ যদি রাষ্ট্রের স্থপতির বিরুদ্ধে কিছু বলে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। আবার, ধর্মের পরিসরে, যেমন ইসলামে, কেউ যদি রাসুলের কটুক্তি-অবমাননা করে, সেই ‘শাতিমে রাসুল’ শাস্তিযোগ্য হয়। তথাকথিত সেকুলার রাষ্ট্রের আদালতের কোন সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করলে তা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। পবিত্রতা তখন শুধু ধর্মের জগতেরই বোধ নয়,রাষ্ট্র ও রাজনীতির ইহপরিমন্ডলেরও এর উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়।
রাষ্ট্রের জাতীয় উৎসবগুলো ধর্মের আচার অনুষ্ঠানেরই সদৃশ। ধর্মের আছে দোজখ/নরক আর রাষ্ট্রের আছে কারাগার, পাইক-বরকন্দাজ, ও শাস্তির নানা কারিগরি। রাষ্ট্রের কাছে সংবিধান ‘বিধান’ এর মর্যাদা পায়, যেমন ধর্মও বিধান দেয়। ধার্মিক বরাত দেয় ধর্মগ্রন্থের, আর রাষ্ট্র দেয় সংবিধানের। শহিদ মিনারে খালি পায়ে উঠবার যে পবিত্রানুভুতির নির্মাণ চলে, তা-ও সেকুলারিজমের ধর্ম হয়ে উঠবার নজির, রাষ্ট্রের ধর্ম হয়ে উঠবার বাসনার প্রতীক। রাষ্ট্রভাষাকে সেকুলারিজম ডিফেন্ড করে কিন্তু, যখনি রাষ্ট্রধর্মের প্রসঙ্গ আসে তখন সেকুলার রাষ্ট্রের ভিন্নরূপ দেখা যায়।
সেকুলারিজম রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথক করার কথা বলে নিজেই ধর্মের রূপে আবির্ভূত হয়। ধর্মের সীমারেখা টেনে দেয়, কোথায় কতটুকু ধর্ম পালন করা যাবে তাও নির্ধারণ করে দেয় সেক্যুলার রাষ্ট্র। ধর্মের ব্যাপারে নানা সীদ্ধান্ত তারা প্রদান করে। যেমন ভারতের তিন তালাক বিষয়ক আদালতের রায়। মাদ্রাসার উপর চায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে, সেক্যুলার রাষ্ট্রের এই ধর্মীয় বাসনার মাঝেই ধর্মের সাথে তার অম্ল মধুর সম্পর্কের শিকড়ের সন্ধান মেলে।
রাষ্ট্রের এই ধর্মবাসনার প্রসঙ্গ আলাপ করেছেন W.T Cavanaugh তাঁর Migration of the Holy(২০১১)-তে। Cavanaugh দেখাচ্ছেন, যদিও ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতার কথা বলা হয়, তবে আসল কথা হলো, পবিত্রতার ধারণা চার্চের বদলে জাতিরাষ্ট্রের দিকে স্থানান্তরিত হয়। চার্চের ভুমিকা দখল করে নেয় জাতিরাষ্ট্র । এটাকে তিনি migration of the holy ব’লে অভিহিত করেন। জাতিরাষ্ট্রই হয়ে উঠে আধুনিক চার্চ।
তিনি তাঁর Myth of religious Violence (২০০৯) বইয়ে দেখান, ধর্মসাপেক্ষতা-ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্ম-রাজনীতি এই যে যুগ্মবৈপরীত্ব বা বাইনারিসমূহ এগুলো পশ্চিমা আবিষ্কার । তিনি এই বইটিতে প্রায় চল্লিশটি উদাহরণ দিয়ে দেখান যে, “ধর্ম সমস্যা আর রাষ্ট্র সমাধান” এটি ভুয়া কথা। সেকুলার ন্যাশন স্টেটকে সবকিছুর দাওয়াই ভাবাই একটা সমস্যা, সমাধান তো নয়ই। হোসে কাসানাভোর ফ্রেইজ ব্যবহার করে তিনি ধর্মের(ক্যাথলিক বনাম প্রোটেস্টান্ট) নামে পরিচালিত যুদ্ধ যে আসলে “wars of early modern European state formation” বা “প্রাক-আধুনিক ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্র গঠনের যুদ্ধ” সেটিকে সামনে আনেন।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে ছোট ছোট তিনটি বেতার-কথিকা প্রচার করেন। The false God of Science, The false God of Nationalism, The false God of Money এ শিরোনামত্রয়ীতে। “জাতীয়তাবাদের মিথ্যা খোদা” কথিকায় তিনি দেখান, একালে জাতীয়তাবাদ ধর্ম হয়ে উঠেছে, আর এই জাতীয়তাবাদের আকীদা-বাক্যঃ”My country—right or Wrong”। তিনি তুলে ধরেন সেই ১৯৫৩ তেই যে, বিজ্ঞানও একালে ধর্মের জায়গা নিয়ে নিয়েছে, মানি নিয়েছে খোদার জায়গা, সবাই যেন পুজো করছে রাষ্ট্রের, বিজ্ঞানের আর অর্থের।
আর,কার্ল স্মিত তাঁর Political Theology বা রাজনীতির ধর্মতত্ত্ব বইয়ে দেখাচ্ছেনঃ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলো “Secularized theological concept”। থিওলোজি থেকে রাষ্ট্রতত্ত্ব-এ স্থানান্তরিত হয়েছে অনেক ধারণা। ধর্মের Omnipotent God হয়ে যায় ‘সেকুলার রাষ্ট্র’-এর Omnipotent Law-giver। তাঁর মতে, কর্তৃত্ব,আইনের প্রাধান্য,পবিত্রতা,মুক্তি,পরিশুদ্ধি ইত্যাদি অনেক ধারণাই ধর্মাগত। প্রকৃত প্রস্তাবেই তো, ‘সুনীতি’র বহু ধারণা মানুষের যুগ যুগান্তরব্যাপী ধর্মচর্চার ফল।’ সম্ভবত “The Jewish Question” বইয়ে কার্ল মার্ক্সও বলেনঃ রাষ্ট্র ইহলোকের ধর্ম হতে চায়,আর ধর্মকে রাখতে চায় পারলৌকিক রাষ্ট্র ক’রে।
সেক্যুলার জাতি রাষ্ট্রের এই ধর্ম হয়ে উঠার প্রবণতা ও বাকি ধর্মের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে অপরাপর ধর্মের জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিশেষভাবে যে ধর্ম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার দাবি করে বা রাষ্ট্রকে ধর্ম অনুসারে পরিচালনার বাসনা রাখে তারা স্বভাবতই সেক্যুলার রাষ্ট্রের তরফ থেকে বাঁধার সম্মুখীন হয়। সামগ্রিক ধর্মের অনুসারী ও সেক্যুলার রাষ্ট্র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। যে মুসলিমরাই রাষ্ট্রে সেক্যুলার ডগমার স্থলে ইসলামকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয় তারাই সেক্যুলার রাষ্ট্রের চোখে শত্রুপক্ষ তথা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়। তারা সেক্যুলার দর্পণে হয়ে যায় অপরাধী, জঙ্গি, সন্ত্রাসী, উগ্র ও মৌলবাদী। রাষ্ট্রে একসাথে ইসলাম ও সেকুলারিজম নামক দুই পরষ্পর বিরোধী মতাদর্শ চলা সম্ভব নয়। তাই সেকুলার রাষ্ট্রের পক্ষে পূর্ণাঙ্গ ধর্মচর্চার স্পেস দেয়া অকল্পনীয় ও বাস্তবতাপরিপন্থী।
একজন মুসলিম যখন ধর্মের অবস্থান থেকে শহীদ মিনারে নগ্নপদে পুষ্পার্পণ, জাতীয়তাবাদী পতাকাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ বা নিরবে দাঁড়িয়ে থাকা, জাতীয় সংগীতের বিরোধীতা করে তা সেক্যুলার রাষ্ট্র বেঠিক হিসেবে বিবেচনা করে। তার দেয়া পবিত্রতার উপর আঘাত হিসেবে বিবেচনা করে। আবার কোন মুসলিমকে চাইলেও রাষ্ট্রীয় আইন, অর্থনীতি , রাজনীতি পুরোপুরি ধর্মাশ্রয়ে পালনের সুযোগ সেক্যুলার রাষ্ট্র দিবে না। কারণ এগুলো ইসলাম অনুযায়ী হলে সেক্যুলারিজমের স্বয়ংক্রিয়ভাবে মৃত্যু ঘটবে। সেক্যুলার রাষ্ট্র চাইবে তার অস্তিত্বের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলো বিনাশ করতে। তাই সেক্যুলার রাষ্ট্র যখন কোন বইকে উগ্রবাদী বই হিসেবে সনাক্ত করবে তা অবশ্যই তার নিজস্ব লেন্সে করবে, যাতে তার ফায়দা অর্জিত হয়। তার কর্তৃত্বের জন্য যা বা যারা হুমকি তাকেই অপরাধী বা শত্রু হিসেবে সাব্যস্ত করার পাশাপাশি উগ্র, মৌলবাদী নানা ট্যাগ লাগিয়ে দমনে প্রবৃত্ত হবে।
সাময়িক প্রতিবাদ ও জনচাপে কর্তৃত্বের জন্য সরাসরি বা প্রধান হুমকি নয় এমন কিছু বইকে হয়তো এই তালিকা থেকে বাদ দেয়া সম্ভব হবে কিন্তু সামগ্রিক ইসলাম পালন কখনোই সেক্যুলার রাষ্ট্রে সম্ভব নয়। নিরাপদ নির্বিঘ্নে পরিপূর্ণ ইসলাম পালন করতে চাইলে ইসলাম প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। আর তার জন্য অন্যতম কাজ হতে পারে রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায় থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পর্যন্ত ইসলামের যটিলতা মুক্ত পূর্ণাঙ্গ দাওয়াহ সম্প্রসারণ। রাজ দরবারের সাথে আলেমদের দাওয়াহ ও কল্যাণের নিমিত্তে ডাইলোগের সম্পর্ক হওয়া জরুরি, দাওয়াহ বর্জিত স্বার্থ আদায় ও সুবিধা গ্রহণের সম্পর্ক নয়। আবার বই নিষিদ্ধ করেও সেক্যুলার স্টাবলিশমেন্টের জন্য বেশি ফায়দা আছে বলে মনে হয় না , কেননা নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষন বেশি। আমার ফাঁসি চাই’ বইটি নিষিদ্ধ না হলে কখনোই এতো প্রচার ও পঠিত হতো না। সর্বোপরি এই বিরোধ দুই মতাদর্শের বিরোধ। এই বই আটক ও ইন্ডিকেটর প্রদর্শন কেবল বাইরের অবয়ব মাত্র।
.
সহায়তা গ্রহণ ও চয়ন:
রাষ্ট্রের ধর্মভাব শীর্ষক প্রবন্ধ