সুন্দরবনে ১৭ বছরে কমছে ৩২৬ বাঘ
Advertisements

২৯ জুলাই আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস। বাংলাদেশের জন্য দিবসটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, বাঘ আমাদের জাতীয় প্রাণী। দেশে বীরত্ব ও শক্তির প্রতীক হিসেবে বাঘকে দেখা হয়। আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের লোগো বেঙ্গল টাইগার। বাংলাদেশে ‘বাঘ বাঁচায় সুন্দরবন, সুন্দরবন বাঁচাবে লক্ষ জীবন’ আর বিশ্বে ‘তাদের বেঁচে থাকা আমাদের হাতে’ প্রতিপাদ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হবে।

তবে করোনা পরিস্থিতিতে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘের অন্যতম আবাসস্থল সুন্দরবন-সংলগ্ন বাগেরহাট ও খুলনায় দিবসটি উপলক্ষে কোনো কর্মসূচি নেই। বন বিভাগের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে অনলাইনে আলোচনা সভার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে এই দিবস পালনের কার্যক্রম।

এদিকে জরিপ অনুযায়ী গত চার বছরে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনে সর্বশেষ ২০১৫ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। ক্যামেরা ট্র্যাকিং পদ্ধতি বাঘ জরিপে বাঘের সংখ্যা এখন ১১৪টি। চোরাশিকার বন্ধে স্মার্ট পেট্রোলিংও চালুকরণসহ সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এর আগে সরকারের নানা উদ্যোগেও বিপদমুক্ত হতে পারছিল না সুন্দরবনের বাঘ। সুরক্ষার অভাবে বিপন্ন হয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ২০০৪ সালে যেখানে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০, সেখানে এখন বাঘ রয়েছে ১১৪টি। দেড় যুগেরও কম সময়ের ব্যবধানে ৩২৬টি বাঘ কমে যাওয়া বা মারা যাওয়াকে উদ্বেগের সঙ্গে দেখা হয়েছে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৩৫০টি। ১৯৮২ সালের জরিপে দেখা যায় বাঘের সংখ্যা ৪২৫টি। ১৯৮৪ সালে সুন্দরবনের ১১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়। ২০১৮ সালে করা একটি জরিপের ফলাফলে বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘ রয়েছে ১১৪টি। ২০১৫ সালে ‘ক্যামেরা ট্র্যাকিং’ পদ্ধতিতে পরিচালিত জরিপে বাঘের সংখ্যা বলা হয়েছে ১০৬টি।

২০০৪ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী ৪৪০টি বাঘের মধ্যে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় ৮৯টি পুরুষ, ১৭০টি স্ত্রী এবং ১২টি বাঘ শাবক, বাগেরহাটের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় ৩২টি পুরুষ, ১২৮টি স্ত্রী এবং ৯টি বাঘ শাবকের অবস্থান জরিপে উল্লেখ করা হয়েছিল।

অর্থ্যাৎ দেড় যুগেরও কম সময়ের ব্যবধানে ৩২৬টি বাঘ কমেছে সুন্দরবনে। আর কয়েক বছরে বেড়েছে মাত্র ৮টি বাঘ। তবে বর্তমানে সুন্দরবনের বাঘের আনাগোনা বাড়ছে। সম্প্রতি সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় বাঘের অবাধ বিচরণ ও প্রতিনিয়ত বাঘের শাবকের দেখা মিলছে বলে জানান সুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালিরা।

প্রাণী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা বিভিন্ন সময়ে সুন্দরবনের বাঘের মৃত্যুর জন্য ৯টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস), লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়া, মিঠাপানির অভাব, খাদ্যসংকট, বন ধ্বংস, বাঘের আবাসস্থলের অভাব, চোরাশিকারি, অপরিকল্পিত পর্যটন ও বনের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচল।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, সুন্দরবন এশিয়ার মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বৃহত্তম আবাসভূমি। কিন্তু বন বিভাগ এই আবাসভূমিকে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ করতে পারেনি। সুন্দরবনকে বন্য প্রাণীদের জন্য নিরাপদ করা গেলে বাঘের সংখ্যা আরও বাড়বে। বাঘ রক্ষায় আবাসস্থল সংরক্ষণ, বনের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত পর্যটনের বিকাশ, বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ বাস্তবায়নে নানা সুপারিশ করেছেন তারা।

সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, আশঙ্কাজনক হারে সুন্দরবনে বাঘ কমেছে। এটা বাঘের জন্য একধরনের হুমকি। তবে বাঘ ও সুন্দরবনের বন্য প্রাণী রক্ষায় সরকার সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ বনভূমিকে অভয়াশ্রম ও সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে ঘোষণা করেছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের যে শর্ত, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে বাঘের প্রজনন বাড়বে। প্রজনন বাড়লে বাঘও বাড়বে।

সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম আকন বলেন, বাঘের ওপর যেসব হুমকি আছে, তা বন্ধ করতে হবে। বাঘসহ বন্য প্রাণী রক্ষায় সাধারণ মানুষকেও সোচ্চার হতে হবে। বন্য প্রাণী হত্যা, ক্রয়-বিক্রয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মাদ বেলায়েত হোসেন বলেন, বিশ্ব বাঘ দিবসে প্রতিবছরই বিভিন্ন আয়োজন করা হয়। গত বছরও সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি।

এ ছাড়া তিনি আরও জানান, বাঘের প্রজনন, বংশবৃদ্ধিসহ অবাধ চলাচলের জন্য গোটা সুন্দরবনের অর্ধেকেরও বেশি এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঘ সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। চোরাশিকারিদের তৎপরতা বন্ধে স্মার্ট পেট্রোলিংও চালু রয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

Advertisements