আল-জাজিরার মতামত বিভাগে প্রকাশিত ইউন সানের লেখাটি ভাওয়াল বার্তার পাঠকদের জন্য তরজমা করেছেন ভাওয়াল বার্তার সহ-সম্পাদক।
পুরো বিশ্ব মায়ানমারের গনতান্ত্রীক অগ্রগতি নিয়ে আশাবাদি ছিল কিন্তু ১ ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থান বিশ্ববাসিকে হতবাক করেছে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নতুন সরকার গঠন করার ঠিক আগমুহূর্তে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করে সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা দখল করেছে । অং সান সু চিকে আটকের পাশাপাশি শাসক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রায় সব পরিষদ সদস্যকে বন্দী করা হয়েছে একই সঙ্গে। প্রেসিডেন্ট ইউনি মিন্টও সশস্ত্র বাহিনীর কবজায় রয়েছেন। সামরিক বাহিনী বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করেছে যা দেশটির গণতন্ত্রীকরণ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে ।
কিন্তু মিয়ানমার কি সত্যিই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার সুযোগ হারিয়েছে? সামরিক বাহিনী কি কারণে এই ধরনের আচরণ করেছে ? আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে,দেশটি এখান থেকে কোথায় যায়?
বিতর্কিত নির্বাচন
১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের তাৎক্ষণিক অনুঘটক গত নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচন বলে মনে হচ্ছে।
অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ৮৩ শতাংশ ভোট পেয়ে সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। যদিও সামরিক বাহিনী ধারণা করেছিল যে, তারা অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও জাতিগত রাজনৈতিক দলের কাছে আসন হারাবে। বাস্তবতা হচ্ছে যে এনএলডি পাঁচ বছর আগের চেয়েও বড় ব্যবধানে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতাই প্রমান করে জনগণ সু চির সরকারকে চায় ।যদিও সু চির সরকার তাদের প্রথম ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে ঘোষিত তিনটি বিষয় তথা শান্তি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক সংস্কারে তেমন কিছু করতে পারেনি। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এখনো অং সান সু চির সরকারের প্রতি আস্তা রেখেছে।
সু চির জোটের নিরঙ্কুশ জয় দেখে উদ্বিগ্ন সামরিক বাহিনী নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচন বয়কট করে। সামরিক বাহিনী নির্বাচন কমিশনের (ইউইসি) কাছে ডজন খানেক অভিযোগ দায়ের করে নির্বাচন পুনরায় চালানোর আহ্বান জানিয়েছে। ইউইসি সামরিক বাহিনীর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে যে, নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার মত কোন ঘটনা ঘটে নাই ।
সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং ভেবে রেখেছিলেন ইউএসডিপি নির্বাচনে ভালো করলে সু চির সঙ্গে দর-কষাকষি করে তিনি উর্দি ছেড়ে প্রেসিডেন্ট হবেন। জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাঁর সেই ইচ্ছায় বাদ সাধে। বলা যায়, গত নভেম্বরের ভোটে সশস্ত্র বাহিনীর পরিকল্পনামতো কিছুই হয়নি। এই কারণে ভোটের পর থেকে সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকে। মিয়ানমারে গুঞ্জন রয়েছে, ভোটের পরও সেনাবাহিনী সু চির সঙ্গে দর-কষাকষি করছিল জেনারেল মিন অং কে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য। কিন্তু সু চি সেই আপসে যাননি। তারই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সেনা অভ্যুত্থান।
বিবাদ অনেক দিন ধরেই চলছিল
সামরিক বাহিনীর প্রস্তাব সু চির সরকার প্রত্যাখ্যান করার কারণেই এই অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে বলে মনে কারা হচ্ছে । ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর গত ৭২ বছরে মিয়ানমার মাত্র ১৫ বছরের মতো বেসামরিক সরকারের অধীনে কাটিয়েছে। সেই দুর্ভাগ্য আবারও জেঁকে বসেছে দেশটিতে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নতুন পার্লামেন্ট দায়িত্ব নেওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা দখল করেছে দেশটিতে। এই সময়ে, সামরিক বাহিনী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শাসনের দিক থেকে দেশটিকে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ করে।
২০০৩ সালে দেশটিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাহিদা কে টেনে আনার জন্য সামরিক সরকার তার “গণতন্ত্রের রোডম্যাপ” ঘোষণা করে। রোডম্যাপের উদ্দেশ্য ছিল ধীরে ধীরে মায়ানমারে একটি নতুন শাসন ব্যবস্থা চালু করা যা জনগণকে ক্ষমতা প্রদান করবে এবং একই সাথে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা ও সুবিধা রক্ষা করবে।
দেশটির বর্তমান সংবিধান ২০০৮ সালে কার্যকর হয়। দীর্ঘমেয়াদী গণতন্ত্রীকরণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সংবিধানটির খসড়া করা হয়। বিশেষভাবে “একটি সমৃদ্ধ এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ গণতন্ত্রের” পথ প্রশস্ত করার জন্য সংবিধানটির রচনা করা হয়েছে, যার মানে হচ্ছে সামরিক বলয়ে থাকা একটি গণতন্ত্রান্তিক ব্যবস্থা থাকবে। এটি শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীর জন্য সংসদের সকল আসনের ২৫ শতাংশ বরাদ্দ করেনি, একই সাথে সাংবিধানিক সংশোধনীতে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করেছে।
সু চির সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে বেসামরিক সরকারের উপর সামরিক বাহিনীর প্রভাব কমানোর জন্য সংবিধান সংশোধন করা ছিল অং সান সু চির সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। যদিও সামরিক বাহিনী গত পাঁচ বছরে এই লক্ষ্য অর্জনের প্রতিটি প্রচেষ্টা সফলভাবে ব্যর্থ করেছে। সু চির দল ২০২০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় দেখে সামরিক বাহিনী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তারা চিন্তা করলেন যে, যদি সু চি আবার সরকার গঠন করলে, তাহলে বেসামরিক সরকারের উপর সামরিক বাহিনীর প্রভাব কমানোর আইন করে ফেলতে পারে।
মিয়ানমারের শসনে সেনার প্রভাব কমবে?
গত সপ্তাহের অভ্যুত্থানের পর,একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে সামরিক বাহিনী কি ভবিষ্যতে সরাসরি দেশ শাসন করতে চায় নাকি নামমাত্র বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায় যা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
প্রাথমিকভাবে সামরিক বাহিনী ঘোষণা করেছে যে, তারা এক বছরের মধ্যে একটি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে চায় এবং বিজয়ী রাজনৈতিক দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়। সত্যিই, ৫০ বছর ধরে দক্ষতার সাথে দেশ শাসন করতে ব্যর্থ হওয়ার পর, সামরিক বাহিনী শাসনের দৈনন্দিন সমস্যা মোকাবেলা করার চেয়ে সংবিধান দ্বারা তাদের বিশেষ মর্যাদা এবং সুবিধা রক্ষা করতে বেশি আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে।
মাধ্যমে সামরিক বাহিনী সরাসরি শাসন করার ইচ্ছার কথা ঘোষণা করেনি, কিন্তু শুধুমাত্র তার সহনশীলতার সীমা প্রদর্শন করেছে।
সামরিক বাহিনীর যা প্রয়োজন এবং যা চাচ্ছে তা হচ্ছে, বেসামরিক সরকারের ২০০৮ সালের সংবিধানে এমন আইন করা যাতে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ না করে। গত সপ্তাহের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী সরাসরি শাসন করার ইচ্ছার কথা ঘোষণা করেনি,কিন্তু দেশটিতে গণতন্ত্রের জমিন শক্ত হতে দিতে চান না জেনারেলরা এইটা বুঝা যায়।
তবে এর মানে এই নয় যে সামরিক বাহিনী বিদ্যমান ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন করবে না। সম্ভবত সংবিধান এমন ধারা সংশোধনের প্রচেষ্টা শুরু করবে যা তাদের কর্তৃপক্ষের জন্য হুমকি।
উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে মায়ানমারে এফপিটিপি নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে। এই ব্যবস্থা থাকায় সু চির দলকে সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের সুযোগ কর দেয়। যদি নির্বাচন ব্যবস্থা পিআর পদ্ধতিতে হত, তাহলে সামরিক বাহিনী সমর্থিত অন্যান্য রাজনৈতিক দল আরো আসন পেত। এবং সু চির দল এত সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও পেতে পারত।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংসদে আধিপত্য বিস্তার করার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। সেখানে জোট সরকারের প্রয়োজনীয়তাও তৈরি করতে পারে। সংসদে এক দলের আধিপত্য দেখার পর, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ভবিষ্যতে এই ধরনের দপরিস্থিতি যাতে না হয়, তাই সংবিধানের নিয়ম পরিবর্তন করতে চাইবে।
মিয়ানমারে কি আবার গণতন্ত্র ফিরবে ?
৭৫ বছর বয়স্ক সু চি একাধিক গুরুতর অভিযোগ নিয়ে অভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে ফিরে আসাটা সম্ভব নাও হতে পারে। এর মানে এই নয় যে, সু চির দল রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিদায় নেবে। দলটির ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। এবং তরুণ প্রজন্ম গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হক এইটা চায়, তাই আগামী বছরগুলোতে তরুণরা মিয়ানমারের গণতন্ত্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এইটা নির্ভর করে সামরিক বাহিনী কিভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর হস্তক্ষেপ করে, যদি নির্বাচন দেয় এবং বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়।
যদিও মিয়ানমারের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল এবং এর বিশ্ববিখ্যাত নেতার ভাগ্য অনিশ্চিত, এছাড়াও মায়ানমারে আরো উদ্বেগের বিষয় রয়েছে।
অভ্যুত্থান এখনো শেষ হয়নি, এবং আমরা এখনো জানি না মিয়ানমারের জনগণ সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে কিভাবে সাড়া দিতে যাচ্ছে। জনগণের ক্রমবর্ধমান অবাধ্যতার প্রতিক্রিয়ায় সামরিক বাহিনী ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে দিয়েছে। জান্তাদের বিরুদ্ধে জনগণ ইতোমধ্যে আন্দলন শুরু করেছে । সমাজের অনেকে এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে। ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং রাজধানী নয়াপাইদাউ-এর মন্ত্রণালয় গণ ওয়াকআউটের মধ্যে দিয়ে সামরিক বাহিনীকে চাপ সৃষ্টি করছে।
নার্স, ডাক্তার, আইনজীবী, শিক্ষক, প্রকৌশলী, কৃষক, রেলওয়ে কর্মচারী, সরকারী কর্মচারী, কারখানার কর্মী এবং এমনকি কিছু পুলিশ কর্মকর্তাসহ হাজার হাজার মানুষ সামরিক সরকারকে পঙ্গু করার জন্য ধর্মঘট বা দলত্যাগ করেছে।
তবে এখনো আশা আছে
বিশ্ব জুড়ে মিয়ানমারের বিশেষ কুখ্যাতি ছিল সামরিক শাসনের জন্য। গণতন্ত্রের অবস্থা মিয়ানমারে কখনোই ভালো ছিল না। দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা খুবই ধীর। দেশটি স্বাধীনের পর মাত্র ১৫ বছরের মতো বেসামরিক সরকারের অধীনে কাটিয়েছে। তবে গত সপ্তাহের অভ্যুত্থান নিঃসন্দেহে গত ১০ বছরে করা বেশীরভাগ অগ্রগতি মুছে ফেলেছে। কিন্তু লড়াই এখনো শেষ হয়নি, জনগ্ণের লাড়াই চলছে। আগামী সপ্তাহ এবং মাসগুলোতে যাই ঘটুক না কেন, মিয়ানমারের জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনবে যেমনটা তারা আগে অনেকবার করেছে। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাবে যা তাদের তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেবে।