সাইপ্রাস নিয়ে তুরস্ক-গ্রিস উত্তেজনা
Advertisements

সাইপ্রাস এলাকার মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। সম্প্রতি এ বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে এবং দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে সাজ সাজ রব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

গ্রিসসহ ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী আরো অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কে যখন উত্তেজনা চলছে তখন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান বলেছেন, ‘বিতর্কিত সাইপ্রাস এলাকা নিয়ে যদি শান্তি আলোচনা শুরু করতেই হয় তাহলে তা হতে হবে দ্বিপক্ষীয়। তৃতীয় কোনো পক্ষ এ আলোচনায় অংশ নিতে পারবে না।’ তবে তিনি দুদেশের সরকার বলতে ঠিক কোন্‌ কোন্‌ সরকারকে বুঝিয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ তিনি কি সরাসরি তুরস্ক ও গ্রিস সরকারকে বুঝিয়েছেন না কি সাইপ্রাসের যে দুই অংশের ওপর তুরস্ক ও গ্রিসের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সেখানকার স্থানীয় সরকার বা প্রশাসনের কথা বুঝিয়েছেন সেটা পরিষ্কার নয়। যাইহোক, প্রেসিডেন্ট এরদোগান তুরস্কের নিয়ন্ত্রণাধীন সাইপ্রাস দ্বীপের অধিবাসীদের জন্য পানি সরবরাহের বিষয়ে অনলাইন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়ে গিয়ে বলেছেন, ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে যারা সাইপ্রাসে বসবাসকারী তুর্কি অধিবাসীদের হত্যা করেছিল, তারা সবসময়ই আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাছাকাছি পৌঁছা মাত্রই কোনো না কোনো অজুহাতে আলোচনার টেবিল থেকে পালিয়ে যায়।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট গ্রিস নিয়ন্ত্রিত সাইপ্রাস দ্বীপের নেতাদেরকে অভিযুক্ত করে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘তারা যদি পূর্ব ভূমধ্যসাগর এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে তুর্কি অধ্যুষিত দ্বীপবাসীদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে তাহলে আঙ্কারা তা কিছুতেই মেনে নেবে না।’

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের এসব বক্তব্য থেকে বোঝা যায় সাইপ্রাস এলাকা নিয়ে গ্রিসের সঙ্গে দেশটির বিরোধ বজায় রয়েছে এবং বর্তমানে এ বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। তুর্কি কর্মকর্তারা সবসময়ই সাইপ্রাস ইস্যুতে গ্রিসের নেতাদের উদ্দেশ্য করে বক্তব্য রাখতেন কিন্তু এবার প্রেসিডেন্ট এরদোগান সরাসরি গ্রিসের নিয়ন্ত্রিত সাইপ্রাস দ্বীপ এলাকার স্থানীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য করে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘গ্রিস নিয়ন্ত্রিত সাইপ্রাস এলাকার নেতাদের ঔদ্ধত্য ও অবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সাইপ্রাস আলোচনায় কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না’।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তুর্কি প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক এসব বক্তব্যের সঙ্গে সাইপ্রাস নিয়ে সাম্প্রতিক শান্তি আলোচনা স্থগিত হয়ে যাওয়ার একটা সম্পর্ক রয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে, তুর্কি কর্মকর্তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায় শত্রু ভাবাপন্ন দুদেশের মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ এবং এ বিষয়টি এ দু’দেশের মধ্যে তিক্ততার চরম বহি:প্রকাশ। আঙ্কারার বক্তব্য থেকে আরো বোঝা যায় ওসমানিয় শাসনের অবসান ঘটার পর সাইপ্রাস এলাকার বহু দ্বীপ তুরস্ক ফেরত পেলেও এ নিয়ে গ্রিসের সঙ্গে বিরোধের অবসান ঘটেনি। অন্যদিকে সাইপ্রাস নিয়ে তুর্কি কর্মকর্তাদের কড়া বক্তব্যের পর গ্রিসও কঠোর ও গরম গরম বক্তব্য দিচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।

বাস্তবতা হচ্ছে, বিতর্কিত সাইপ্রাসের তুর্কি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তুরস্কের যে সেনা মোতায়েন রয়েছে তা বহি:র্বিশ্বে এটাই তাদের প্রথম সেনা সমাবেশ। ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই তুরস্ক সরকার তুর্কি অধ্যুষিত সাইপ্রাস দ্বীপ এলাকায় সেনা মোতায়েন করে এবং এখনো তারা সেখানেই অবস্থান করছে। সাইপ্রাসে গ্রিসের অধিবাসীদের শত্রুতার হাত থেকে তুর্কি মুসলমানদের রক্ষার লক্ষ্যেই তৎকালীন তুর্কি সরকার সেখানে সেনা পাঠিয়েছিল। তুরস্কের কর্মকর্তাদের অভিযোগ ১৯৭৩ সালে গ্রিসে সামরিক অভ্যুত্থানের পর গ্রিসের নেতারা একদিকে, তুরস্ক ও ব্রিটিশদের মধ্যকার চুক্তি অন্যদিকে গ্রিস ও ব্রিটিশদের মধ্যকার চুক্তিকে পদদলিত করা শুরু করে। তুর্কি কর্মকর্তাদের মতে সাইপ্রাসে তুর্কি সামরিক অভিযানের আগেই এথেন্সের তৎকালীন অভ্যুত্থানকারী সামরিক নেতারাই মূলত এ অঞ্চলে সংকট ও উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য দায়ী ছিলেন।

এ ছাড়া সাইপ্রাস অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টির আরো কিছু কারণ রয়েছে। এ ব্যাপারে তুরস্কের সমুদ্র বিষয়ক ‘কুচ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরামর্শ পরিষদের সদস্য সাহি শাবাক উগলু বলেছেন, সাইপ্রাস নিয়ে গ্রিসের সমস্ত দাবিকে তুরস্ক প্রত্যাখ্যান করেছে। কেননা গ্রিস তুরস্কের ওসমানিয় সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল।

এ কারণে দুই দেশের সমাজেই এক ধরণের অহংকার বা আত্মমর্যাদার বিষয়টি কাজ করে। তুরস্কের রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, ‘সেই তখন থেকেই পূর্ব ভূমধ্যসাগর, অ্যাজিয়ান সাগরের মালিকানা এবং সাইপ্রাস দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে তীব্র বিরোধ চলে আসছে।’ তিনি আরো বলেছেন, বিতর্কিত বিষয় নিয়ে তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে এ পর্যন্ত বেশ ক’বার বৈঠক হয়েছে কিন্তু প্রতিবারই বৈঠক স্থগিত হয়ে যায় এবং খুব একটা এগোয়নি। কেননা কেউই কোনো ছাড় দিতে চায় না। বর্তমানে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে এবং পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে কেউ এক টেবিলে আলোচনায় বসতেও রাজি নয়। মোটকথা বিস্ফোরণমুখ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

যাইহোক, সাইপ্রাস নিয়ে আঙ্কারা ও এথেন্সের নেতাদের মধ্যে তীব্র বিরোধের কারণে প্রায়ই তারা মারমুখো অবস্থানে চলে যায়। তুরস্কের কর্মকর্তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বিরাজমান সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে সাইপ্রাসে দুই দেশেরই কর্তৃত্ব বজায় থাকবে এবং তুর্কিদের অধিকারকে উপেক্ষা করা যাবে না। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান সাইপ্রাসকে দুই দেশে ভাগ করার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ‘গ্রিকভাষীদের প্রাধান্য যেখানে সেই দক্ষিণ সাইপ্রাস ও তুর্কিদের প্রাধান্যের উত্তর সাইপ্রাস আলাদা দেশ হোক’। এরদোগান আরো বলেছেন, ‘সাইপ্রাসে দুই ধরনের মানুষ বাস করেন। দুইটি আলাদা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আছে। তাই সার্বভৌমত্ব ও সাম্যের ভিত্তিতে দুইটি আলাদা দেশের আলোচনা শুরু হোক। অন্যদিকে গ্রিস তুরস্কের এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছে এথেন্স চায় সমগ্র সাইপ্রাসের পূর্ণ স্বাধীনতা।

পার্সটুডে

Advertisements