সম্পর্ক না থাকলেও পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ইসরাইলে
Advertisements

মধ্যপ্রাচ্যের বিতর্কিত দেশ ইসরাইলের সঙ্গে বাংলাদেশের নেই কোনো ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক। এমনকি বাণিজ্যিক সম্পর্কও স্থাপিত হয়নি। আবার দেশটিকে স্বীকৃতিও দেয়নি বাংলাদেশ। দেশটি ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বাংলাদেশের নাগরিকদের। অথচ এক দশকের বেশি সময় ধরে ইসরাইলে পণ্য রপ্তানি করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু কীভাবে রপ্তানি হচ্ছে, তা নিয়ে মুখ খুলতে রাজি নয় কেউ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিমাণে কম হলেও বাংলাদেশের নিয়মিত রপ্তানি বাজার ইসরাইল। একসময় তৃতীয় দেশের মাধ্যমে এ রপ্তানি শুরু হয়। পরে তা সরাসরি রপ্তানিতে রূপ নেয়। তবে ঠিক কবে থেকে দেশটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শুরু হয়েছে, তা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারছে না। আবার রপ্তানি পণ্যের মূল্যই বা কীভাবে ফেরত আসছে তাও স্পষ্ট নয়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, গত প্রায় ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ইসরাইলে রপ্তানি করা হয় চার লাখ ৭৭ হাজার ৮২২ ডলারের পণ্য। এর মধ্যে অন্যতম হলো তৈরি পোশাক। তবে কয়েক বছর ধরে যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া ও কুষ্ঠরোগের ভ্যাকসিনও রপ্তানি হচ্ছে দেশটিতে। এছাড়া সামান্য কিছু সবজি, আসবাবপত্র ও মোটরসাইকেলও রপ্তানি করা হয়েছে।

এদিকে ইসরাইলের পাশাপাশি ফিলিস্তিনেও সামান্য পরিমাণে পণ্য রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। এক দশকে ফিলিস্তিনে রপ্তানি হয় তিন লাখ পাঁচ হাজার ৪৬৩ ডলারের পণ্য; যা বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রায় পুরোটাই তৈরি পোশাক। তবে এক বছর সামান্য কিছু সবজি ও আসবাবপত্র রপ্তানি করা হয়েছে।

জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি শেয়ার বিজকে বলেন, পাসপোর্ট থেকে ‘এক্সসেপ্ট ইসরাইল’ তুলে দেয়া হলেও ইসরাইলের সঙ্গে ভবিষ্যতে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করা হবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে। এখনই এ বিষয়ে মন্তব্য করা উচিত নয়। তবে ইসরাইলে কীভাবে ও কী পরিমাণ পণ্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় তা জানা নেই।

ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে ইসরাইলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল আট হাজার ৪৬২ ডলারের, যার প্রায় পুরোটাই নিট পোশাক। এর মধ্যে রয়েছে জার্সি, ট্রাউজার, পুলওভার, টেবিলওয়ার, কিচেনওয়ার, কার্ডিগান ও অন্যান্য টেক্সটাইল পণ্য। পরের অর্থবছরও প্রায় একই ধরনের পণ্য রপ্তানি হয় দেশটিতে। সে বছর রপ্তানি আয় ছিল ২২ হাজার ৪৩৫ ডলার।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে কিছু খাদ্যপণ্য রপ্তানি হয়। আর ওই বছর রপ্তানির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৫৭৭ ডলার। পরের অর্থবছর তৈরি পোশাকের পাশাপাশি কিছু আসবাবও রপ্তানি হয়েছে। ওই অর্থবছর ইসরাইলে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৭ হাজার ২৩৬ ডলার। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছর তৈরি পোশাক ও আসবাব ছাড়াও যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া ও কুষ্ঠরোগের ভ্যাকসিন রপ্তানি করা হয়। সে বছর রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ২১ হাজার ৫৬৮ ডলার।

২০১৬-১৭ অর্থবছর ভ্যাকসিনের (যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া ও কুষ্ঠরোগ) পাশাপাশি শীতের পোশাক ও ঝাড়বাতি রপ্তানি করা হয়। সে বছর রপ্তানির আয় ছিল রেকর্ড এক লাখ এক হাজার ৯৯৫ ডলার। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছর ভ্যাকসিন ও বিভিন্ন আসবাবপত্র রপ্তানি করা হয়। সে বছর রপ্তানি আয় হয় ৮৩ হাজার ৬৮০ ডলার।

২০১৮-১৯ অর্থবছর ইসরাইলে আবারও রেকর্ড এক লাখ ১৮ হাজার ৭০ ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে বড় অংশই ছিল ভ্যাকসিন। এছাড়া কিছু মোটরসাইকেল ও সামান্য পরিমাণ আসবাবপত্র রপ্তানি হয়। আর ২০১৯-২০ অর্থবছর ও চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) শুধু ভ্যাকসিন রপ্তানি হয়েছে ইসরাইল। এ দুই বছর রপ্তানি আয়ের পরিমাণ যথাক্রমে ২৮ হাজার ৬৭ ডলার ও ৪৩ হাজার ৭২৭ ডলার।

ইসরাইলে রপ্তানির বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন বলেন, ‘ইসরাইলের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়।’ এ সময় রপ্তানির তথ্যের উৎস ইপিবি উল্লেখ করা হলে তিনি ‘দুঃখিত’ বলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের নাগরিকদের ইসরাইলে যাতায়াতের অনুমতি নেই। এতদিন বাংলাদেশের ইস্যুকৃত পাসপোর্টের প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল ‘দিস পাসপোর্ট ইজ ভ্যালিড ফর অল কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড এক্সসেপ্ট ইসরাইল’ (বিশ্বের যে কোনো দেশের জন্য এই পাসপোর্ট কার্যকর থাকবে, শুধু ইসরাইল ছাড়া)। যদিও বর্তমানে নতুন ইস্যু করা ই-পাসপোর্টে ‘এক্সসেপ্ট ইসরাইল’ শব্দ দুটি তুলে দেয়া হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এর কারণ ব্যাখ্যায় সম্প্রতি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক আগে যেরকম ছিল এখনও তা-ই থাকবে। তবে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে আমরা পাসপোর্টে এক্সসেপ্ট ইসরাইল শব্দ দুটি তুলে দিচ্ছি।’

বাংলাদেশের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ইসরাইল। তবে ২৪ মে এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ‘বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের ইসরাইল ভ্রমণে আগের মতোই নিষেধাজ্ঞা আছে। ইসরাইলের বিষয়ে বাংলাদেশের যে অবস্থান সেখান থেকে বাংলাদেশ সরে আসেনি এবং বাংলাদেশ এক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অবস্থানেই অবিচল রয়েছে।’ এছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের কেউ ইসরাইলে গেলে শাস্তি পেতে হবে।

ইপিবির তথ্যমতে, ইসরাইলের পাশাপাশি ফিলিস্তিনেও বাংলাদেশ নিয়মিতই সামান্য পরিমাণ রপ্তানি করে যাচ্ছে। এর মধ্যে ২০১১-১২ অর্থবছরে ফিলিস্তিনে রপ্তানি হয় ১৮৬ ডলারের পণ্য, যার পুরোটাই তৈরি পোশাক। মূলত কিছু টি-শার্ট ও অন্যান্য টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি করা হয় সে বছর। পরের অর্থবছর কোনো রপ্তানি হয়নি ফিলিস্তিনে। তবে ২০১৩-১৪ অর্থবছর রপ্তানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৬৬৩ ডলার। সে বছর রপ্তানি পণ্যের প্রায় পুরোটাই ছিল বিভিন্ন ধরনের সবজি, ফল ও ফলের জুস। তবে ২০১৪-১৫ অর্থবছর কোনো রপ্তানি হয়নি দেশটিতে।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে ফিলিস্তিনে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ১২৫ ডলার। এর প্রায় পুরোটাই ছিল টি-শার্ট। তবে সামান্য কিছু আসবাবপত্র রপ্তানি হয় ওই বছর। আর ২০১৬-১৭ দেশটিতে রেকর্ড এক লাখ ১৯ হাজার ৯৭৭ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এর পুরোটাই তৈরি পোশাক। পরের চার অর্থবছর একই পণ্য রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছর রপ্তানি করা হয় ৭০ হাজার ১৩৬ ডলারের পণ্য, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৭ হাজার ১৭০ ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছর ৩৬ হাজার ৬৩৮ ডলার ও চলতি অর্থবছরের ৯ মাস (জুলাই-মার্চ) ১৯ হাজার ৮৬৫ ডলার।

সূত্রঃ শেয়ার বিজ

Advertisements