মার্কিন দেশে ঘটা ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলা চক্রান্ত না পরিকল্পিত ঘটনা নাকি দুর্ঘটনা- এ নিয়ে বিস্তর পরস্পর বিরোধী গবেষণা হয়েছে। আরো হবে। তবে একই রকম কূল কিনারাবিহীন সমাধানপত্র নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
এই ঘটনার পরে একটি পরিকল্পিত (civilisational terrorism) সভ্যতার সন্ত্রাসবাদ দেখতে পাই আমরা। কিতাবি নাম ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ (war on terror)! ২০০১ এবং ২০০৩-এ ধারাবাহিকভাবে আফগানিস্তান ও ইরাকে হামলার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্বোধন হয়। এতে অংশ নেয় ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্য, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ এবং বাকি দুনিয়া। আমেরিকান এই ক্লাসিক ক্রাইমের অংশ হওয়া দেশগুলোর বুদ্ধিজীবি ও মিডিয়া গত প্রায় দুই দশক ধরে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক খবর ও এনালাইসিস কোনো রকম সেন্সর ছাড়াই কপি পেস্ট করে চালিয়ে গেছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচনা যা হয়েছে তা ওই পশ্চিমেই; যা পশ্চিমের গনতন্ত্রের কথা বলার স্বাধীনতার পুচ্ছে পেখম লাগিয়ে সৌন্দর্য বাড়িয়েছে।
ওই গণতন্ত্র অত্যাচারিত দেশগুলোর বেসামরিক নাগরিক, নারী, বৃদ্ধ, শিশু হত্যাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যে পেন্টাগনের টেবিল থেকে দুঃখ প্রকাশের সৌন্দর্যের চ্ছটায় নিহত মজলুমদের কুৎসিত নয়তো কিম্ভূতকিমাকার দেখা গেছে। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতা সাহিত্যাশ্রিত প্রোপাগান্ডার কিলিং মেশিনের দায়িত্ব নিয়েছে। কোনটা খবর হবে আর কোনটা হবে না, কোন প্রতিরোধকে সন্ত্রাস আর কোন সন্ত্রাসকে আত্মরক্ষার স্বাধীনতার ব্যাচ লাগিয়ে গ্লোরিফাই করতে হবে সেই মুন্সিয়ানার প্রতিযোগিতা চলছে।
দুই দশকে যত বেসমারিক মানুষ হত্যা হয়েছে তার বিচারের প্রশ্নও নেই! কী সুন্দর! সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আরেক নাম ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সেখানেও ইসলামকে ক্লাসিফাই করা হয়েছে লিবারেল আর এক্সট্রিমিজমে!
দুই দশকের সাংবাদিকতা, কিলিং মেথডের উপরে নির্মিত গেমস, বিগ বাজেটের মুভি, ভূই ফোঁড় সংগঠন ও এসাইলাম পাওয়া নেতা, বাকস্বাধীনতা, গনতন্ত্রের চর্চা সবই ছিল ইসলামোফোবিয়ার পাটাতনের উপর নির্মিত। আর্মস ম্যানুফ্যাকচারার, ডিলার, স্মাগলারদের পোয়াবারো। ওয়ার অন টেরর তথা পশ্চিমের দাসত্বের বিনিময়ে দেশে দেশে রেজিম পয়দা হয়েছে। বুমেরাং না হওয়া পর্যন্ত রেজিম চলে। ক্যাপিটালিজমের মহান (!) যজ্ঞের ধোয়া উড়িয়ে রেজিমগুলো স্ব স্ব দেশের সম্পদগুলো পশ্চিমা ব্যাংকের কর্মচারীর হাতে আমানত রেখেছে। ক্ষমতা যদি খেয়ানতের খাতায় যায় এই কর্মচারীরা যেন তখন ঈমাদারিত্বের পরাকাষ্ঠা দেখায়। এই কর্মকান্ডের সামগ্রিক পরিভাষা প্রবাহমান গণতন্ত্র।
তো দুই দশকের যুদ্ধকে হালালের ফতোয়া দিয়ে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করে, সভ্যতাকে মাটিতে মিশিয়ে লাশের মিছিলের ওপর হামাগুড়ি দিতে দিতে আটলান্টিকের ওপারে পৌঁছে গেছে তারা। তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসাকে মিডিয়া এমনভাবে প্রচার করছে যেন মানবতার ধ্বজা উড়িয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত সৈনিক তার শিশু সন্তান, পিতামাতা বা স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরছে। অথচ এই হাত দিয়েই কারো নিষ্পাপ শিশু, অসুস্থ মা-বাবা, স্ত্রীকে বিনা অন্যায়ে হত্যা করে সে ফিরেছে। কী করবেন, ওই আবেগে ভিডিও দেখে কাঁদবেন নাকি বিচার চাইবেন!
সামরিক সক্ষমতা, মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা, দুনিয়ার অত্যাচারীদের জোট, বায়াসড বিনোদন- কোনো কিছু কি পেরেছে মিথ্যার বেসাতিকে টিকিয়ে রাখতে, বিজয়ী করতে? পারেনি। আফগানিস্তানে ঐতিহাসিক পতনের পর ওয়ার ক্রাইমের অপরাধের বিচারের আওয়াজ কি উঠেছে? না। এড়িয়ে গিয়েছে। স্বীকৃতি নামক সার্টিফিকেশনের ডিলারশিপও তাদের হাতে। ওই স্বীকৃতির সোনার হরিণ পেতে যুগ যুগ ধরে তুরস্ক অপেক্ষা করছে ( ইইউতে এন্ট্রি), আফগানিস্তান করবে, ইরান করছে। কত রং আর রূপের যুদ্ধ জারি আছে সেটা কী আমরা বুঝি! হাতের এ্যান্ড্রয়েড থেকে মেগা মিডিয়ার জায়ান্ট স্ক্রিন সবখানেই বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বের রমরমা ক্যারিয়ারের হাতছানি।
আমরা কতটুকু বোধের জাগ্রত করতে পেরেছি, কোন মরীচিকার পিছনে ছুটতে গিয়ে হয়ে যাচ্ছি আত্মপরিচয়হীন। এইসব প্রশ্ন মনে মধ্যে উঁকি দেয় না। যুদ্ধ এখনো জারি আছে। ময়দানের যুদ্ধের জয় বিজয় শেষ কথা না। বিজয় উদযাপনের যোগ্য হওয়াটাও এখন ভীষণ জরুরি।
সভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাসবাদের স্বরূপ অনুসন্ধানে কতটা গবেষণা হচ্ছে। গাল-গল্পময় আলোচনা আবেগে সুড়সুড়ি দিতে পারলেও বুদ্ধিবৃত্তিক পঙ্গুত্ব কাটানো যায় না। সভ্যতার স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে বিশেষ সভ্যতার স্বার্থকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে কোটি কোটি ডলার, লাখ লাখ মানুষের জীবন যারা ধ্বংস করে দিতে পারে, তাদের কাছে কী আশা করছেন, কেন করছেন? যদি কোনো একক বিকল্পের অনুসন্ধান না পাওয়া যায়, তবে সভ্যতার কৃত্রিম সংঘাতে বাস্তুহারা হওয়ার মানসিক প্রস্তুতিই কিঞ্চিৎ ব্যথার উপশমের দাওয়াই হতে পারে।
লেখক : আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক