বেইজিং সফর সংক্ষিপ্ত করে আজ (বুধবার রাতে) দেশে ফিরছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পূর্বনির্ধারিত সূচি মতে, চীনে দ্বিপক্ষীয় সফর শেষে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সরকারপ্রধানের ঢাকা ফেরার কথা ছিল। কূটনৈতিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে ঠিক কী কারণে প্রধানমন্ত্রী চীন সফরটি সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফেরার এমন সিদ্ধান্ত নিলেন এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সে বিষয়ে সরকারের তরফে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য বা ভাষ্য প্রচার হয়নি।
সরকারপ্রধানের সফরসঙ্গী হিসেবে বেইজিংয়ে অবস্থান করা একজন কর্মকর্তা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ৮ই জুলাই বেইজিংয়ে পৌঁছার পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ই জুলাই দেশে ফেরার ব্যবস্থা নিতে সফর প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেন। রাষ্ট্রাচার বিভাগ তৎক্ষণাৎ সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়, সে অনুযায়ী বেইজিংয়ের স্থানীয় সময় বুধবার রাত ১০টায় বিমান উড্ডয়নের ক্লিয়ারেন্স পাওয়াসহ অন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়।
পরিবর্তিত সূচি মতে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিশেষ ফ্লাইটটি বেইজিং ক্যাপিটাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রধানমন্ত্রী এবং তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে রওনা করে বাংলাদেশ সময় বুধবার মধ্যরাতে ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে। স্মরণ করা যায়, বুধবার দিনের শুরুতে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং এবং বিকালে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক হবে প্রধানমন্ত্রীর। দুই বৈঠকের মাঝে ২০ থেকে ২২টি চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনের সহযোগিতা কামনা:
এদিকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারের রাখাইনে ফেরাতে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারপ্রধানের চীন সফরের দ্বিতীয় দিনে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সফরসঙ্গী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এ তথ্য জানান।
মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী চীনের নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে আপনারা আমাদের সহায়তা করুন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান ওয়াং হুনিং-এর নেতৃত্বে দলটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখা চাইনিজ পিপলস পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কনফারেন্সের (সিপিপিসিসি)’র একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গ্রেট হলে বৈঠক করে। এসময় প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে চীনের নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং তাদের সহযোগিতা কামনা করেন। সেই বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকটসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় ইস্যু, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবধান কমানো, অর্থবহভাবে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদ্যাপন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাড়ে ছয় বছর আগে মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও আজ অবধি মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ইস্যুটি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে উত্থাপন করেছেন। জবাবে সিপিসিসি চেয়ারম্যান বলেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করবো এবং এর একটি সমাধান খুঁজে পেতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনার সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতে ভূমিকা পালন করবো। ওয়াং হুনিং বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যাতে দ্রুত শুরু করা যায় এজন্য চীনের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই ব্রিফিংয়ে অর্থমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এম নাঈমুল ইসলাম খান এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের এখনই উপযুক্ত সময়: প্রধানমন্ত্রী
ওদিকে চীনা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে পারস্পরিক স্বার্থে বিশ্বের সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ ব্যবস্থার সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেইজিংয়ে ‘বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য, ব্যবসা এবং বিনিয়োগের সুযোগ’ শীর্ষক এক শীর্ষ সম্মেলনে বক্তৃতাকালে শেখ হাসিনা এ আহ্বান জানান। বলেন, এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগের সময় এবং আমি আত্মবিশ্বাসী যে হাতে হাত মিলিয়ে একসঙ্গে আমরা দুর্দান্ত কিছু অর্জন করতে পারি। বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস, বিআইডিএ, বিএসইসি এবং সিসিপিআইটি চায়না ওয়ার্ল্ড সামিট উইং ও শাংরি-লা সার্কেল, বেইজিং এই সম্মেলনের আয়োজন করে। প্রধানমন্ত্রী চীনা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের মূল খাতগুলো বিবেচনা করার জন্য উৎসাহিত করে বলেন, আমরা আমাদের অবকাঠামো, জ্বালানি ও লজিস্টিক খাতে আপনাদের বিনিয়োগকে স্বাগত জানাই। চীন সফরের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার সম্মেলনে যোগ দিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সম্ভাব্য খাত আইসিটি, পর্যটন, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ও উন্নয়ন খাতে বৃহত্তর পরিসরে বিনিয়োগের জন্য চীনা উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানান।
শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ ও চীনের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৬টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) বিনিময় হয়েছে। চীনের ভাইস মিনিস্টার অব কমার্স লি ফেই, চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওয়াং টংঝু, এইচএসবিসি চায়নার প্রেসিডেন্ট ও সিইও মার্ক ওয়াং, হুয়াওয়ের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সাইমন লিন, বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন, চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. জসিম উদ্দিন ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবায়াত-উল ইসলাম। বাংলাদেশ ও চীনের কয়েক শ ব্যবসায়ী নেতা, বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা এ সম্মেলনে যোগ দেন।
২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়তে এআইআইবির সহায়তা চান প্রধানমন্ত্রী
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ এবং ডিজিটাল দেশে রূপান্তর করতে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) কাছ থেকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এআইআইবি ভবিষ্যতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।” এআইআইবির প্রেসিডেন্ট জিন লিকুনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বেইজিংয়ে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করার সময় প্রধানমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। বৈঠক বিষয়ে গণমাধ্যমকে ব্রিফ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
সূত্রঃ মানবজমিন