শিল্পের অন্যতম একটা প্রকৃয়া হচ্ছে, চিন্তাকে অনুভবে রূপ দেওয়া । বিজ্ঞানের কোন তত্ত্ব যখন অনুভবে রুপান্তরিত হয় তখনই তা প্রবেশ করবার যোগ্য হয় কাব্যের অন্দরে। জীবনানন্দের ” যে- নক্ষত্র মরে যায়, তাহার বুকের শীত/লাগিতেছে আমার শরীরে,” পঙক্তিটিতে নক্ষত্রের মৃত্যু বা শেলীর “Ode to the West wind” কবিতায় বীজের অংকুরোদগম, মেঘের জন্ম আর বজ্র-বিদ্যুতের উৎপত্তি ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে চিত্র আর উপমা-প্রতীকে অনুভববেদ্য ক’রে তোলা হয়েছে। আবার, কোন চিন্তাকে দৃশ্যমান ক’রে তোলার জন্যেও ব্যবহৃত হতে পারে ভিজুয়াল আর্ট, স্থাপত্যশিল্প বা ভাস্কর্যের নান্দনিকতা! চিন্তাকে অনুভবের বিহবলতায় উপনীত করবার জন্যেও শিল্পকে কাজে লাগানো হয়। যে শিল্প কোন বিশেষ চিন্তাকে চাড়িয়ে ও ছড়িয়ে দিতে চায় তাতে শৈল্পিক বা নান্দনিক বিবেচনা হয় উপলক্ষমাত্র, লক্ষ থাকে কোন এক চিন্তা, মত বা মতাদর্শের স্থিতি।
সোভিয়েত আমলে শুধু রাশিয়াতেই কমুনিস্ট শাসনের স্থপতি লেনিনের “স্টোন মেমোরিয়াল” ছিল প্রায় সাত হাজার। এই “মূর্তিমান” উপস্থিতি মতাদর্শ বিস্তার ও স্থিতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। নান্দনিক ব্যঞ্জনার বয়ান এখানে মতাদর্শের অনুসঙ্গী, শিল্পসৃষ্টি বা সৌন্দর্য পিপাসার সাথে এর সম্পর্ক ন্যূনতম বা ততটুকু যতটুকু মতাদর্শকে মোহনীয় করতে লাগে। চরম নাদান কেউ বা মতলববাজ ছাড়া আর কেউ এ কথা বলতে পারে না যে, শিল্প শুধু নন্দনভাবনা থেকেই উৎসারিত হয়। ক্ষমতাকাননও বহু শিল্পের জনয়িতা, এটা বুঝপাতা মাত্রই জানে।
জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী বা বিশ্ববীক্ষা(World view) শিল্পের উদ্ভবে ভূমিকা রাখে। প্যাগান বা পৌত্তলিক বিশ্ববীক্ষা থেকে জাত শিল্প, ইসলামি বিশ্ববীক্ষা থেকে জাত শিল্প থেকে ভিন্ন হবে বা হয়। ভোগবাদী-পুঁজিবাদী জীবনবীক্ষা বা লিবারেলিজমের দ্বীন থেকে উৎসারিত শিল্প বা নন্দন আখিরাত-বিশ্বাসী দ্বীন থেকে উদ্ভুত নন্দন থেকে ভিন্ন হয়। যদিও এগুলোর মধ্যে মাঝে মাঝে পয়েন্ট অব ইন্টারসেকশনও দেখা যেতে পারে। তবে, মূল কথা হচ্ছে, শিল্পের জন্মের পেছনে চিন্তাকাঠামোর ভূমিকা থাকে, প্রভাব থাকে মতাদর্শের। প্রাচীন ভারতীয় বা প্রাচীন গ্রিসীয় শিল্পে জীবনবীক্ষার উপস্থিতি যেমন দেখা যাবে, আধুনিক উত্তরাধুনিকদের মধ্যেও তা লক্ষ্যযোগ্য। ইসলামি জগতে যে শিল্প লক্ষণীয়,সেটি যে তার জীবনবীক্ষা থেকে উৎসারিত, তা না বললেও চলে। যার যার দ্বীন তার তার। লাকুম দ্বীনুকুম… …
শিল্পমাত্রই মতাদর্শের রিফ্লেকশন— সরাসরি এমন না হলেও মতাদর্শের ভেতরে থেকেও মতাদর্শের সাথে শিল্প এক ক্রিটিকাল ডিস্টেন্স রক্ষা করতে পারে বলে আলথুসারের ভাবনায় দেখি। আর্নেস্ট ফিশার তাঁর ” Art against ideology” তে জানান, “অথেনটিক আর্ট” ভাবাদর্শিক সীমাকে উতরে যায় এবং ভাবাদর্শ যা লুকিয়ে রাখে তা-কে সমুখে হাজির করে। যে-শিল্প ডমিনেন্ট মতাদর্শের উদ্দেশ্যকে সার্ভ করে তাকে পাশ্চাত্য শিল্পবিদরা যত না শিল্প, তারও বেশি রাজনীতি বলতে রাজী হন। ফরাসি তাত্ত্বিক জাঁক রানসিয়ে শিল্পের একটা ফাংশন হিসেবে “Rearrangement of perception” এর কথা বলেন, কিন্তু শিল্প যদি কোন নতুন পারসেপশন না ক’রে সাপ্রেসিভ কোন ব্যবস্থাকে রিএরেঞ্জ না ক’রে রিপ্রোডিউস করে তবে শিল্পের উদ্দেশ্যই ব্যহত হয়। তবে এতে একজিস্টিং ক্ষমতার মাকসাদ পূরণ হয়।
যেকোন হেজিমনির ভেতরেও একটা “ইনার ডাইনামিক” থাকে ব’লে রেমন্ড উইলিয়ামস জানাচ্ছেন, গ্রামসির “হেজিমনি” তত্ত্বকে কিছুটা প্রব্লেমেটাইজ করতে। বিদ্যমান যেকোন ব্যবস্থায় তিন ধরনের কালচার বা মতাদর্শ থাকে। যাকে তিনি ডমিনেন্ট (প্রবল/আধিপত্যশীল)কালচার , রেসিডিউয়াল( পুরানা চিন্তার ছিটেফোঁটা অবশেষ) কালচার এবং এমারজেন্ট( অনাগত/যা আসি আসি করছে) কালচার নামে ডাকেন।(Marxism and literature, chapter-8)। এদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে থাকে। একে রেমন্ড উইলিয়ামস Structure of feelings নাম দেন। এগুলো আসলে নানা ধরনের ওয়েজ অব থিংকিং। এমারজেন্ট কালচার বোঝা খুব জরুরি, এর মধ্য দিয়ে শিল্পের নতুন ফর্ম জন্মের সম্ভাবনা থাকে, এর মধ্যে প্রবল মতাদর্শকে নস্যাতের সম্ভাবনা থাকে। তাই, Condition of pre-emergence কে অর্থাৎ নতুন শিল্পের প্রাক-আবির্ভাব পরিস্থিতিকেও গভীরভাবে বোঝার জরুরতের কথা বলেন উইলিয়ামস। উইলিয়ামস ব্যাটার কথা শুনতেও পারি, নাও পারি আমরা।
আরেকটি কথা, তালাল আসাদের বরাতে বলি, অন্য আরো কেউও বলে থাকতে পারেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ধারণায় শুধু “বক্তা”র বলবার স্বাধীনতাকেই আমরা মূল্য দেই কিন্তু শ্রোতা শুনবে কিনা, শ্রোতা শুনতে ইচ্ছুক কিনা তা বিবেচনায় রাখা হয়না। একই কথা শিল্পের ক্ষেত্রেও বলা যায়, কোন শিল্পকর্ম তার ভোক্তারা উপভোগ করতে চায় কিনা, ভোক্তাদের ইচ্ছে আছে কিনা সেটাও বিবেচনায় রাখা যায়, অন্তত মাঝে মাঝে! শুধু মত যে দিবেন আর শিল্প যে করবেন তার বা তাদের স্বাধীনতা নিয়ে বললেই হবে, নাকি শ্রোতা ও ভোক্তারেও গুনতে হইবে!
অর্থাৎ, শিল্প বা নন্দনকে আপনারা যারা খুব নিরীহ ব্যাপার ব’লে মনে করেন তারা নিদারুণ ভুলে আছেন! ওয়াল আছর, ইন্নাল ইংসানা লাফি খুসর…