শিক্ষা ও জীবন বিষয়ক ভাবনা
Advertisements

১.
এই পৃথিবীতে মানুষ যে অত্যাশ্চর্য তিলোত্তমা নগর গড়েছে বা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার জীবন ধারণের সহজতাকে প্রাণশীল করেছে অথবা প্রাণী জগতের ওপর তার নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করেছে, একারণেই মানুষ অন্য জীব হতে শ্রেষ্ঠ বিষয়টি তা নয়; মানুষ তার জন্ম বৈশিষ্ট্য’র কারনেই বিশিষ্ট। তার জন্ম প্রকাশেই সে অসাধারণ আর সেখানেই তার বিপর্যয়। প্রাণী জগতের প্রতিটি প্রাণী স্বরূপে ও স্বপ্রকৃতিতে জন্মগ্রহণ করে। প্রাণী হিসেবে জন্মেই সে তার স্বার্থক প্রকৃতিকে ধারণ করে প্রায় সম্পূর্ণ। তাই দেখতে পাওয়া যায় হাসের বাচ্চা জন্মের পরেই সাঁতার কাটে। সিংহ সারাজীবন সিংহ হয়ে জীবন পার করে। এটা নির্দিষ্ট ও চূড়ান্ত। মানুষ জন্মগ্রহণ করে অন্য প্রাণীর মতই, প্রাণী হিসেবে। মানুষ বলতে আমাদের চোখে যেই গুণ ও বৈশিষ্ট্য বুঝায়, তার সবটুকু সম্ভাবনা নিয়ে ও তার অসম্পূর্ণ প্রকাশে। মানুষের এই আলো, হাওয়া আর মাটির পৃথিবীতে যাত্রা শুরু। সৃষ্টিগতভাবে প্রতিটি প্রাণীই নিখুত ও সম্পূর্ণ। কেবলমাত্র মানুষ অসম্পূর্ণ আর এই অসম্পূর্ণতাই মানুষের মধ্যে সম্পূর্ণ হবার এক অভূতপূর্ব সম্ভাবনা রূপে বিরাজ করে। শিক্ষা মানুষের প্রকৃতিপ্রদত্ত অবস্থা ও তার পূর্ণ সম্ভাবনার মাঝের সেতু। শিক্ষা নামক সেতু অতিক্রম করেই কেবল মানুষ, ‘মানুষ’ ধারণার কাছাকাছি সম্ভাব্যতায় পৌঁছে যায়। এই শিক্ষা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো উপার্জনের রূপরেখা অর্জন করার শিক্ষা নয়। এই শিক্ষা মৃত্যু থেকে অমরতার দিকে যাত্রার শিক্ষা।

‘শিক্ষা’ শব্দের অর্থ দুটি, দুটিই তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজি ‘এডুকেশন’ শব্দটি এসেছে গ্রীক ‘এডুকেয়ার’ থেকে। যার মানে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা। অজ্ঞানতা হলো অন্ধকার, অজ্ঞানতা হলো পাপ। গ্রীক দর্শন থেকেই আমরা জানি যে, মানুষ ‘ভালো’ বা ভালো কাজ করে সার্বিক এক ভালোত্বের ধারণামাফিক। মানুষের অচৈতন্য, অসচেতনতা মানুষের মূর্খামি তার ভিতরে আঁধার তৈরি করে। সেই আঁধারে থাকে হীনমন্য, পরজীবি আর ঘৃণিত জান্তববোধ। মানুষ যখন ভালোত্বের ধারণা পায়, মানুষ যখন তার আত্মার সঙ্গে মিলিত হয়, তখন সেই অন্ধকুপের দেয়াল ধসে পড়ে। যত যুগ-যুগান্তরের কাদা পড়া স্যাঁতস্যাঁতে পরিত্যক্ত, সেখান থেকে মনে আলো আসে। মানুষ প্রফুল্ল হয়, উদ্যোগী হয়, শোভিত হয়, প্রেমশীল হয়। তখন মানুষের কর্মে-চিন্তায় এক কথায় যাপিত জীবনের পরতে পরতে শিক্ষার দীপ্ত শিখা উন্মুক্ত হয়। তাকে আমরা বলি জ্ঞান। কোরান মানুষকে শিক্ষা দিচ্ছে, ‘আল্লাহুম্মা রাব্বি যিদনি ইলমা’- ‘হে রব, আপনি আমাদের জ্ঞান দান করুন।’

উপনিষদ বলছে, ‘তমস মা জৌতির-গামায়া’– ‘হে প্রভু, আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে পরিচালিত করুন’। মানুষ কেবল তার দেহ কাঠামোর জন্যই মানুষ, এমনটি ভাবা ভুল। মানুষের মাঝে আছে সুপ্ত বহ্নি, তার মাঝে আছে প্রাণময় বীজ। সেই বহ্নিশিখাকে প্রদীপ্ত করা সেই বীজকে বৃক্ষে পরিণত করার নাম শিক্ষা।

‘শিক্ষার’ অন্য অর্থটি সংস্কৃত থেকে উদ্ভুত। তার মানে হল, ‘আত্ম খনন করা’ অথবা ‘ভেতর উন্মুক্ত করা’। প্রতিটি মানুষ ব্যক্তি হিসেবে স্বতন্ত্র্য আর এটি আবিষ্কার করাই শিক্ষার কাজ, মানুষকে নিজের ভেতরের আমিকে চিনতে সহায়তা করা। শিক্ষার কাজ আপনাকে আপনার সাথে মিলিয়ে দেওয়া। শিক্ষার কাজ প্রত্যেকের ভেতরে যেই সম্ভাবনা আছে তাকে খুঁড়ে তুলে সত্যি করে তোলা। নিজেকে জীবনের প্রস্তুত উদযাপনের সাথে পরিচয় করানোই শিক্ষার কাজ। শিক্ষার কাজ নিজেকে আবিষ্কার করে নিজের মধ্যে সার্বভৌম প্রতিষ্ঠা করা। তার কাজ নিজেকে চিনে অন্যকে ওই পথেই দেখা– আবিষ্কার করা, শিক্ষার কাজ মানুষকে তার যাত্রা পথে নির্ভীক করে তোলা, শিক্ষার কাজ ভেতরকে বাহিরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।

তুমি শুধু দৌঁড়াও। এক নিঃশ্বাসে, মাথা তুইলো না কারণ তোমার আকাশ নেই, তুমি শুধু শিখবে দৌঁড়ানোর যথাযথ কৌশল। যেখানে থেমে গেলেই তুমি পরাস্ত, তুমি ক্ষুধার্ত, নিঃসম্বল। তোমার খাবার অন্য কেউ খেয়ে যাবে। তোমার দিন নেই, রাত নেই। খাবার আর বিলাসের বিনিময়ে তোমার আত্মাকে বিক্রয়ের ব্যবসা তোমাকে শেখানো হবে এই বিদ্যাপীঠগুলোতে। কত দামে কত ভাবে তুমি বিকাতে পারো, তোমার আত্মার দাম বৃদ্ধির জন্য, তোমার উপযোগীতা বৃদ্ধির সব কৌশল তোমাকে শেখানো হবে

কিন্তু আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার এমন অসংখ্য কাজের কিছুই করে না। ঘুনে ধরা, জরাজীর্ণ প্রায় অন্ধকার এই শিক্ষার পথ মানুষকে নিছক অনুকরণকারী হতে বাধ্য করে। তুমি অন্যের মত হও, তুমি চেনা পথে হাটো, তুমি নির্ধারিত প্রশ্নগুলোই কেবল জানো। এই ব্যবস্থা মানুষকে বলে দেয়, তার নিজের বলে কিছু নেই। সে বড় এক গৎবাধা পথের অন্ধ পথিক। এই শিক্ষা ব্যবস্থা তোমাকে ভীরু করে তোলে, করে ফেলে লোভী। এ ব্যবস্থা তোমাকে বড় জোর তথ্য দিতে পারে তোমার ভালো রোজগারের, ভালো চাকরির। শিক্ষা কেবল ভয় দেখায়, যদি তুমি এই কাঠামোয় যথার্থ শিক্ষিত না হও, তুমি টিকবে না, তুমি হারিয়ে যাবে। তোমার চলার পথ হবে সহিংস। এই পথে শিক্ষার এই কাগজগুলো তূর্ণ-এর তীর। তুমি নিজে ছুঁড়বে ক্ষতবিক্ষত করবে অন্যকে, সেই সাথে নিজেকেও। শিক্ষা মানুষকে আরাম আর সুবিধার মায়া ছড়িয়ে দেয় সামনে, লালায়িত করে। এই নির্ধারিত মন অতিক্রম করলেই মিলবে অবারিত আরামের উপকরণ। আর মানুষ এই ফাঁদে ধরাও দেয়। সমাজ মানুষকে বিলাসের উপকরণ ঠিক দেবে, কিন্তু কেড়ে নেবে মানুষের ভেতরের মানুষকে। কেড়ে নেবেই না শুধু, তাকে জীবন্ত কফিনে বন্দী করে রাখবে। মানুষ স্বাচ্ছন্দ পাবে, আরাম পাবে কিন্তু হারাবে আত্মাকে-হারাবে অন্তরের শান্তি।

প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে শেখায় তুমি দুনিয়াকে তোমার মাপে তৈরি কর। কিন্তু এই মহৎ শিক্ষা দিয়ে পুঁজিবাদের দিন যাবে না। তার প্রয়োজন বোধ-বুদ্ধিহীন কিছু জৈবিক রোবট বর্তমানের বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, তৈরি করছে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, ব্যাংকার, শিক্ষক, সচিব, কর্মকর্তা, কর্মচারী, এমন বিচিত্র পেশাজীবী যন্ত্র। তারা প্রত্যহ শুধু জীবনের দীপ্তি আয়ু আর প্রাণ ক্ষয় করবে সভ্যতার চাকা ঠেলতে। তারা জীবন বুঝবে না। কেউ যদি সমাজের এই প্রচলিত জুতোয় পা না রাখে, সমাজ হয়ে পড়ে কঠোর। কারণ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে, রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে, অশিক্ষিতদের বড় প্রয়োজন। অশিক্ষিতরাই যুদ্ধের ‘গিনিপিগ’ হবে। ‘গুলি চালাও’ শুনে কেউ যদি গুলি না করে; তবে তো সমূহ বিপদ। তাই এই না বলতে পারার বোধটাই হত্যা করে ফেলা হয় এই শিক্ষা ব্যবস্থায়।

মূলত এই সব প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বর্বর তৈরির কৌশল ছাড়া কিছুই না। যেখানে সবাই সবার শত্রু। এখানে বড়জোর মস্তিষ্কহীন, হৃদয়হীন কৃতদাস ও মাঝারি মানে প্রভুভক্ত কেরানি তৈরি সম্ভব, এর বেশি নয়

মহৎ শিক্ষা মানুষকে বলে যত্নশীল হতে। তোমার মাঝে যেই সুরভিত উদ্যান তাতে জল মেঘ ও হাওয়ায় খেলা প্রতিটি দিন। জীবন প্রকৃত প্রস্তাবে কোন প্রতিযোগিতা না। এখানে কেউ কাউকে পেরোতে পারে না, যা তার প্রয়োজনও নেই। কারণ প্রত্যেকের অবস্থান নির্দিষ্ট, যাত্রাপথও আলাদা। তুমি শুধু কারো পথে বাধা হইয়ো না। তুমি শুধু উপভোগ করো– যেই অসীম সম্ভাবনা নিয়ে তোমার জীবন শুরু, তাকে। তুমি সংযোগ স্থাপন করো তোমার একান্ত নিভৃতের সাথে, সংযোগ স্থাপন করো এই বিশ্ব চরাচরে উদ্ভুত সব বিকাশের সাথে। তুমি সুন্দর সঙ্গীত, দর্শন, মানবিক বোধ, আর নৃত্যরত সেই সুদর্শন চিত্রলিপি ছড়ানো তার মাঝে নিঃশ্বাস নাও। তুমি সুখী ও অমর হবে।

হিংসুক যান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলে তুমি নাকি ছোট, তুমি পারবে না। তুমি বরং পেটের জন্য বাঁচো, ওখানে অনেক ক্ষুধা। এই বিদ্যালয়গুলোতে ক্ষুধা নিবৃত্ত করার কৌশলই তোমাকে শেখানো হবে। তুমি শুধু খাবে। ভালো খাবার কি করে কেড়ে খাবে, তা তোমাকে শেখানো হবে এখানে। তোমার মনের দুয়ারে আগে খিল দাও, নতমুখী হও তুমি। অন্যের ভালো-মন্দ, বাঁচা-মরায় তোমার কোন দায় নেই, এমনকি তোমার নিজের প্রতিও তোমার কোন অঙ্গীকার থাকবে না। তুমি শুধু দৌঁড়াও। এক নিঃশ্বাসে, মাথা তুইলো না কারণ তোমার আকাশ নেই, তুমি শুধু শিখবে দৌঁড়ানোর যথাযথ কৌশল। যেখানে থেমে গেলেই তুমি পরাস্ত, তুমি ক্ষুধার্ত, নিঃসম্বল। তোমার খাবার অন্য কেউ খেয়ে যাবে। তোমার দিন নেই, রাত নেই। খাবার আর বিলাসের বিনিময়ে তোমার আত্মাকে বিক্রয়ের ব্যবসা তোমাকে শেখানো হবে এই বিদ্যাপীঠগুলোতে। কত দামে কত ভাবে তুমি বিকাতে পারো, তোমার আত্মার দাম বৃদ্ধির জন্য, তোমার উপযোগীতা বৃদ্ধির সব কৌশল তোমাকে শেখানো হবে।

মূলত এই সব প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বর্বর তৈরির কৌশল ছাড়া কিছুই না। যেখানে সবাই সবার শত্রু। এখানে বড়জোর মস্তিষ্কহীন, হৃদয়হীন কৃতদাস ও মাঝারি মানে প্রভুভক্ত কেরানি তৈরি সম্ভব, এর বেশি নয়।

২.
কোন জাতিকে যদি শেকড়হীন, অর্ধমৃত ও অপাংক্তেও করে ফেলার ইচ্ছা নেয় কেউ, তবে সেই জাতিকে সেখানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কহীন শিক্ষা দিতে হবে। বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হীন অসৎ শিক্ষাব্যবস্থার জন্মই হয়েছে ইংরেজদের নেওয়া ‘ধান্দাবাজি’ শিক্ষা নীতির আলোকে। এই উপমহাদেশে ইংরেজরা আসার পূর্বে (এবং পরেও বিশেষত ১৮৫৭ সনের পূর্বে) শিক্ষার প্রধান মাধ্যম ছিল সংস্কৃত, আরবি, ফারসি ও উর্দু। চতুর ইংরেজ যখন কোম্পানির মাধ্যমে এদেশে আসন গাড়ল (অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ধরলে) তখন শাসন ব্যবস্থা সুসংহত করার মত স্থানীয় আইন তৈরি ছিল না। এদেশের মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের (শাসন ও শোষণের জন্য) নিমিত্তে ইংরেজ মোহামেডান কলেজ, হিন্দু কলেজ, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। যদিও প্রথম দিকে মুসলিম কাজী ও হিন্দু পন্ডিতদের নিয়ে শুধু আইন পর্যালোচনার জন্য এসব কলেজ তৈরি করা হয়েছিল। তথাপি এই কাজী ও পন্ডিতগণ ইংরেজি জানা থাকার কারণে অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাজ কাঠামোয় ‘সামাজিক বিশেষ শ্রেণী’ বলে গণ্য হতে থাকে, যতক্ষণ না ১৮১৩ সালে চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে কোম্পানির সম্প্রসারণ নীতি বাস্তবায়িত না হয়। এর মাঝে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে, নির্দিষ্ট করে বললে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে, এদেশে নামে খ্রিস্টান মিশনারীর ঢল। তারা এদেশের লোকদের বিশেষত হিন্দুদের ইংরেজি শিক্ষা দিত, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার আড়ালে। উদ্দেশ্য ছিল মূলত ধর্মান্তরিত করা। এই শিক্ষা ছিল আপন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি হীনমন্যতা ও ঘৃণা তৈরির সহায়ক। ততদিনে এই দেশে হিন্দু ও মুসলিম আইনে দেশ শাসনের প্রয়োজন ফুরালো ইংরেজদের। তারা পন্ডিত ও কাজীদের জন্য ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুয়ার বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু খুললেন বিকল্প দুয়ার। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ও কলকাতা হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠাও (১৮১৭ সালে) ছিল একই ইচ্ছেমূলক। ইচ্ছে ছিল এই দুই ধর্মীয় গোষ্ঠীর পুরোহিতদের ধর্মনিরপেক্ষ ইংরেজী শিক্ষা ও ইংরেজ সভ্যতার চাকচিক্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে এদের মাঝে অন্তত কিছু লোককে নিজেদের দলে টেনে আনা। কিছুটা হলেও ইংরেজদের এই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে আজ।

শিক্ষার অনেক গুণের মাঝে একটি হল, মানুষের মাঝে বিশ্বমানবের মনন তৈরি করা। বিশ্ববিদ্যালয় কথাটি বুঝি সে ধারণারই ফসল। অথচ আশ্চর্য, বছরের পর বছর ধরে ভঙ্গুর ক্ষয়ে যাওয়া একই কাঠামোয় ভঙ্গুরতর নৈতিক ও শিক্ষার উপকরণ সমেত এদেশের ছাত্রছাত্রীরা নিতান্ত নিরূপায় হয়ে শ্রেণীকক্ষে ঝিমায়। যারা আরো উপায়হীন হয়ে সজাগ থাকে, তারা নিতান্তই পেটের দায়েই তাই করেন

ইংরেজরা এদেশে আসার আগে কলকাতায় ও ভারতের অন্যান্য জায়গায় কিছু ইংরেজি জানা লোক ছিল। তারা এদেশীয় ব্যবসায়ীদের সাথে ইউরোপীয় বণিকদের ব্যবসার মধ্যস্থতা করতেন। ১৭৫৭ সালের পরে এই ইংরেজি জানার কদর বেড়ে যায়। ১৮১৩ সালে কোম্পানির সম্প্রসারণ নীতির ফলে বাণিজ্য কাঠামো আরো বড় হয় ফলে ইংরেজি জানা কর্মচারীদের আরো প্রয়োজন বাড়ে। ইংরেজরা এদেশীয়দের ততটুকুই ইংরেজি শেখাতেন যা দিয়ে দরকারি কাজ চালানো যায়। কলেজগুলোর পাঠ্য ও পরিবেশ তাই ছিল। খুব দুর্ভাগ্যক্রমে প্রায় আড়াইশ বছর পরে, যখন সাত দশকেরও বেশি সময় আগে ইংরেজরা এদেশ ছেড়েছে। এই অবস্থা খুব বেশি পাল্টায়নি। কিছু ইংরেজি জানা বিশেষত বলতে পারাকে এদেশের লোক আজও গর্বের সাথে দেখে। বিলাতি যে কোন কিছু অনুকরণকে দেশেদের লোক শ্রদ্ধার চোখে দেখে! সাদা চামড়া দেখলে এখনও অনেকের ‘জিব’ বের হয়ে যায়। এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও যেন সেই কোম্পানির ‘দেশীয় সেবকই’ তৈরি করে যাচ্ছে। এই শিক্ষা ব্যবস্থার প্রায় সম্পূর্ণটাই উপনিবেশীয় ভাবধারার আলোকে বিস্তৃত।

মহৎ শিক্ষা মানুষকে শিক্ষা দেয় বলিষ্ঠতার, তার মাঝে যে স্বাতন্ত্রবোধ তাকে করে তোলে মোহনীয় মৌচাক। মানুষ নিজে অমৃত ধরে সেই অমৃত দান করে চলে আজীবন। মহৎ শিক্ষা নিজের প্রতি তৈরি করে শ্রদ্ধা, যে শ্রদ্ধার নির্মাণে মানুষ অন্য মানুষকে খুজে চলে প্রতিনিয়ত।

এই মূল্যহীন নষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা মানুষকে ক্রমাগত আত্মদহনে নিমজ্জিত করে। মানুষ ছোট হয় প্রতিদিন। মানুষ হেরে যায় নিজের কাছে। আর হাপিয়ে ওঠে বসে থেকেও। নিজের লাভের জন্য সে ভিক্ষা প্রার্থী হয় অবলীলায়। একটু মোহের জন্য সে হামাগুড়ি দিয়ে হাটে। সে বাঁচে নিজের ছায়ার সাথে যুদ্ধ করে অন্তহীন।

শিক্ষার অনেক গুণের মাঝে একটি হল, মানুষের মাঝে বিশ্বমানবের মনন তৈরি করা। বিশ্ববিদ্যালয় কথাটি বুঝি সে ধারণারই ফসল। অথচ আশ্চর্য, বছরের পর বছর ধরে ভঙ্গুর ক্ষয়ে যাওয়া একই কাঠামোয় ভঙ্গুরতর নৈতিক ও শিক্ষার উপকরণ সমেত এদেশের ছাত্রছাত্রীরা নিতান্ত নিরূপায় হয়ে শ্রেণীকক্ষে ঝিমায়। যারা আরো উপায়হীন হয়ে সজাগ থাকে, তারা নিতান্তই পেটের দায়েই তাই করেন– যাতে ‘বিসিএস’টা উৎরানো যায়। আমি বলছি না বিশ্ব সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা তহবিল করে ছাত্রছাত্রীদের ভিনদেশে পাঠাবে। সে আশা এই দেশে এমনিতেই অশোভন। ইউরোপে এই চল আছে বলেই জানি। সেই দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে অবাধে ক্রেডিট ট্রান্সফারের ব্যবস্থা আছে। অনেকটা পণ্যের মত। এই মুক্ত বাজারের জোয়ারে শিক্ষা যদি পণ্যও হয়, তবে তাকে তো মানসম্মত পণ্য হওয়াই উচিত। অন্তত নিজ দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের সেমিস্টার ভিত্তিক মুক্ত চলনের ব্যবস্থা করা যেতেই পারে। এতে তারা খুব সহজে বিশ্ববিদ্যালয় ও আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক হেরফের বুঝবে। শিক্ষার কাজ যদি হতো কেবল বইমুখী আর তা পরীক্ষার খাতায় উগলানো, তবে কষ্ট করে ক্লাস হাজিরার প্রয়োজনই বা কি?

বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ দেশের আত্মার সাথে ছাত্রদের পরিচয় করানো। অন্তত সরলতম পথ বাতলানো। যাতে ছাত্র নিজেই নিজের গমনপথের নির্দেশ পায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ ব্যাপকতর। কেবল পাশ করে ভর্তি হওয়া ‘রেডিমেড’ সুযোগ প্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীদের কর্মযোগে হাওয়া যোগানো নয়। দেখা যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় সব শিশুই ভর্তি হয়। অতঃপর ক্রমে ঝরে পড়ে বিভিন্ন কারণে। সবাই মাধ্যমিকের গন্ডি পেরুতে পারে না। এই প্রাথমিক বা মাধ্যমিকে আটকে যাওয়াদের আমরা সমাজের শিক্ষার কাতারে ফেলবো কোথায়? তারা স্কুল ছেড়ে পুনরায় অশিক্ষিত থেকে যান।

ইউরোপের লোকেরা যারা হাইস্কুল ফেরত তাদের অবস্থা আমাদের দেশের মত না। এর মূলে আছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও চিন্তা। ইউরোপের বিভিন্ন গ্রামেও লাইব্রেরি আছে।

আমাদের দেশের লাইব্রেরি ব্যবস্থার কথা আলোচনা না করাই ভালো। পাশ্চাত্যের প্রাথমিক পাশ লোকেরাও (হয়তো গরিব চাষী বা শ্রমিক) অবসরে খবরের কাগজ পড়ে, মেয়েরা পড়ে প্রেয়ার বুক। যাই হোক, আপনি এখন প্রসঙ্গ আনতে পারেন এদেশের সংবাদপত্রের বা যোগাযোগের দুষ্প্রাপ্যতা। আমি তা কবুল করেও দোষ চাপাই এই অবোধ বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার ওপর। এদেশে এত লাইব্রেরি নেই। থাকলেও গ্রামের লোকের পাঠ উপযোগী দেশি ও বিদেশি অনুবাদের যোগান আমরা দিতে পারিনি।
৩.

যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি সংস্কৃতিবান, মার্জিত, উন্নত ও  আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা সিলেবাসসর্বস্ব চাপিয়ে দেয়া শিক্ষা দিয়ে মানুষকে যে দিকে পরিচালিত করানো যায়, সেদিকেই সে পরিচালিত হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষকে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন করতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন হয় প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব চিন্তা, বিচার-বিশ্লেষণ ও গবেষণা। স্বাভাবিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমকালীন শাসকদের দ্বারা প্রণীত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে একজন শাসক চাইলে শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তাদের ইচ্ছামত শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারে অথবা জাতিকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।

এক সময় বাংলাদেশি সমাজের আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও নিজস্ব সংস্কৃতি ছিল অনেক সমৃদ্ধশালী। এখানে মানুষের চিন্তাচেতনা, সততা, পরশ্রীকাতরতা, সহানুভুতিশীলতা ছিল আদর্শকেন্দ্রিক। এদেশে যুগে যুগে অনেক পর্যটক ভ্রমণ করতে এসে দেখেছেন বাংলার রূপ, মাটি ও মানুষ  এবং দেখেছেন মানুষের সহজ সরল জীবনযাপন পদ্ধতি। এসবে বিমুগ্ধ হয়ে তারা তাদের নিজ দেশে ফিরে লিখেছেন ঐতিহাসিক সব ভ্রমন কাহিনী। শিক্ষা ও সংস্কৃতি একটা জাতির প্রাণ। যাই হোক, আজ আমাদের বাংলাদেশের সমাজ শ্রীহীনতা, লক্ষ্যচ্যুত, হীনমন্যতার পেছনে কতগুলো যৌক্তিক কারণ বিদ্যমান রয়েছে। তার খানিকটা ব্রিটিশদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেও প্রভাবিত হয়েছে। বাঙালি জাতি ও জাতিসত্তা বিনষ্ট করা ও সম্পদের উপর ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব লুকায়িত ছিল। তার জলন্ত নজির হচ্ছে এই উপমহাদেশে তাদের প্রণীত শিক্ষানীতি চালুর প্রভাষক লর্ড মেকলের ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রদত্ত বক্তৃতা। লর্ড মেকলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বলেছিলেন যে– আমি উপমহাদেশে আনাচে কানাচে পরিভ্রমন করেছি কোথাও কোন চোর দেখিনি। পাইনি কোন মিথ্যাবাদী। দেশটি এত সমৃদ্ধ ও দেশবাসীর মূল্যবোধ এত উঁচু, জনগণ এত প্রভাবশালী যে এদেশকে বশীভুত করতে হলে এদেশের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক মেরুদণ্ডে আঘাত হানতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন তাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটানো। যদি এ দেশের মনে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা যায় যে– যা কিছু বিদেশি ও ইংরেজি তার সবকিছুতেই তাদের কল্যাণ আছে। তখনই তারা তাদের আত্মসম্মান ও নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর আস্থা হারিয়ে সত্যিকারের পরাধীন জাতিতে পরিণত হবে এবং আমরাও যথাযথভাবে তাদের উপর আমাদের শাসন কায়েম করতে সমর্থ হব।

ভোগবাদী পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আদর্শে সৃষ্ট শিক্ষা ব্যক্তিকে তার আত্মকেন্দ্রিক লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেন একমাত্র ভোগই তার জীবনের ব্রত। সেখানে ব্যক্তি তাৎক্ষণিক সুখভোগ চায়। ভোগের নেশায় মত্ত ব্যক্তি ভনভন করে ঘুরতে থাকে কিভাবে ভোগ উপকরণ সংগ্রহ করা যায়। সে কারণে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রবেশ করেছে। ক্ষমতাসীন সরকার দলীয় উপদেষ্টা, এমপি, মন্ত্রী-আমলাসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ের কর্মচারী সকল সরকারি বেসরকারি অফিস আদালতে দুর্নীতি, লুটপাট চলছে অহরহ

লর্ড মেকলের এ ধরনের বক্তৃতা প্রদানের পর ব্রিটিশ শাসকশ্রেণী তার বক্তৃতায় প্রভাবিত হয়ে সে অনুযায়ী তারা এই উপমহাদেশের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে ফেলল। সে সময় একদল ব্রিটিশপন্থি বুদ্ধিজীবী তাদের প্রণীত এই শিক্ষানীতিকে সমর্থন দিতে থাকে। একটা জাতিকে কিভাবে বশে এনে তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করা যায়, সে ধরনের ডিসকোর্স ছিল তাদের প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থায়। তাই আজ এদেশের মানুষের মনে-মগজে দাসত্বের ছাপ প্রতিফলিত হচ্ছে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী জাতি আজ ঠিকই মনে করছে যে পশ্চিমারাই বুঝি সবচেয়ে উন্নত। তাদের ভাষা তাদের সংস্কৃতি আধুনিকতার সঙ্গে মানানসই। আর আমরা অনুন্নত অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বের মানুষ। যদিও প্রথম বিশ্ব সুসজ্জিত হয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় জুলুম, অত্যাচার, শোষণ ও লুণ্ঠনের অর্থে। তবে কি উন্নয়নতত্ত্ব পরিবর্তন হয়ে আর্থিক উন্নয়নই অগ্রাধিকার পাচ্ছে, যেখানে মানবতা ভূলুণ্ঠিত। দৈহিক চাহিদা যেখানে মূখ্য, আত্মিক চাহিদা উপেক্ষিত। তবে কি পশু ও মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে যেখানে পশুর চাহিদাও শুধুমাত্র দৈহিক? এদেশের মানুষ আসলে ভুলে গেছে তাদের আত্মিক চাহিদার কথা। সেই জায়গাটি দখল করে নিয়েছে পশ্চিমা শিক্ষা ও সংস্কৃতি। ভোগের নেশায় মত্ত হয়ে ভুলে গেছে মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তার কি দায়িত্ব। আজ এদেশের শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সকল শ্রেণীর মানুষ মনে করে যে জীবনের সফলতা হচ্ছে পড়াশুনা করে একটা চাকরি পাওয়ার মধ্যে। কেউ যদি পড়াশুনা করে একটা চাকরি পাই তাহলেই সে সফল। তারা চিন্তা করে না যে পড়াশুনা জীবন গঠনের সাথে সম্পর্কিত। যতটা সময় তারা ব্যয় করে শুধু একটা চাকরি পাওয়ার জন্য ততটা সময় ব্যয় করেনা অর্থপূর্ণ জীবন গঠনের জন্য।

আজকাল পত্রিকায় মাঝে মধ্যে দেখা যায় একদল তরুণ মেধাবীর যখন সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় যদি তাদের কে প্রশ্ন করা হয় যে তোমার জীবনের লক্ষ্য কী? তখন বলতে শোনা যায়, প্রকৌশলী হওয়া, সফটওয়ার প্রকৌশলী হওয়া, ডাক্তার হওয়া, সফল ব্যবসায়ী হওয়া, ব্যারিস্টার হওয়া। কারণ এধরনের পেশায় টাকা বেশি। টাকাই এখানে মুখ্য। আজকাল উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও মার্কেট ওরিয়েন্টেড কোর্স গুলোকে প্রথম শ্রেণীতে রাখা হয়। সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনের মত কোর্সগুলোকে পরের সারিতে রাখা হয়। অথচ পশ্চিমা ও ইরানের মত দেশগুলোতে এই কোর্সগুলো এলিট কোর্স হিসেবে গণ্য করা হয়। এদেশের তরুণসমাজও এই বিষয়গুলোতে পড়াশুনা করতে আগ্রহী না। এছাড়া প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমাজ, রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়গুলি একেবারেই উপেক্ষিত, মার্কেট ওরিয়েন্টেড বিষয়গুলোই কেবল পড়ানো হচ্ছে। প্রফেশনাল কোর্সগুলোর নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক নেই। উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্পোরেট ফার্ম অথবা বহুজাতিক ফার্মগুলোর চাহিদা পূরণের জন্য একদল বস্তুবাদী গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রতিটি মানুষ কি সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীব নয়? তাহলে কেন তারা উচ্চশিক্ষায় সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনের মত বিষয়গুলো পড়বে না? প্রত্যেক শিক্ষিতের মৌলিক সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শন সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। কেন শিক্ষিতদের সমাজচিন্তা, রাষ্ট্রচিন্তা থেকে দূরে রাখা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও আমাদের দেশ সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনে ভীষণভাবে কবলিত। এর মাধ্যমে মানুষকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। ভোগবাদী পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আদর্শে সৃষ্ট শিক্ষা ব্যক্তিকে তার আত্মকেন্দ্রিক লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেন একমাত্র ভোগই তার জীবনের ব্রত। সেখানে ব্যক্তি তাৎক্ষণিক সুখভোগ চায়। ভোগের নেশায় মত্ত ব্যক্তি ভনভন করে ঘুরতে থাকে কিভাবে ভোগ উপকরণ সংগ্রহ করা যায়। সে কারণে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রবেশ করেছে। ক্ষমতাসীন সরকার দলীয় উপদেষ্টা, এমপি, মন্ত্রী-আমলাসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ের কর্মচারী সকল সরকারি বেসরকারি অফিস আদালতে দুর্নীতি, লুটপাট চলছে অহরহ।
৪.
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এদেশের যারা প্রধান চোর তারা কি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত নয়? যারা হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। যারা নিজের পরিবারের সুখের জন্য জাতীয় সুখ বিনষ্ট করতে দ্বিধাবোধ করে না। যারা বিদেশি প্রভুদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে এবং এই ঋণের টাকা সুদে আসলে পরিশোধ করতে গিয়ে গণমানুষের উপর ডিজেল, অকটেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোসহ অন্যান্য করের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন ভাবে চেতনাহীন এই জাতিকে মজলুম করে রেখেছে এই সকল অত্যাচারী শাসকশ্রেণী। আজ শাসকেরাই জোঁকের ন্যায় মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে। তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থায় কিসের সংকট যার ফলে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও প্রকৃত মানুষ হচ্ছে না?

আমাদের বাংলাদেশের সমাজে পিতামাতার সমতুল্য একজন শিক্ষককে গণ্য করা হয়। শিক্ষাগুরুর মর্যাদা এ সমাজে অনেক উঁচুতে। আগেরকার সমাজের ছাত্ররা শিক্ষাগুরুকে দেখলে বিনম্র স্বরে শ্রদ্ধা নিবেদন করত। শিক্ষাগুরুর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াত। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি এমন যে সম্মান তো দুরের কথা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের গড়া ছাত্ররাই শিক্ষকদের গায়ে হাত উঠাচ্ছে প্রতিনিয়ত। পরীক্ষার হলে ছাত্রের কোন প্রকার দুর্নীতিতে বাধা দিলে শিক্ষককে ছুরিকাঘাত করতে দ্বিধাবোধ করে না। রাজনৈতিক অথবা অন্য কোন কারনে এক বিদ্যার্থী আরেক বিদ্যার্থীকে অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তার জীবনর প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে । যে পাঠশালা থেকে বের হওয়ার কথা ছিল একদল সমাজসেবকের; সেই পাঠশালা থেকে বের হচ্ছে একদল সন্ত্রাস ও দুর্নীতিবাজ। ব্রিটিশদের কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষায় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী তৈরি হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু মানুষ হচ্ছে কয়জন?

বর্তমান প্রযুক্তি বিকাশের আগে এদেশের নারী জাতির এরকম অধঃপতন ছিল না। তারা শালীনতাবোধ বজায় রেখে সমাজে বসবাস করত। বর্তমানে আধুনিকতার নামে নারীদের হিজাব থেকে বের করে এনে বাণিজ্যিক পণ্যে রুপান্তর করা হচ্ছে। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে অবাধে চলছে নারীদের দেহ-বাণিজ্য। কোন কোন মহল থেকে নারীদের যৌন বাণিজ্যকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। নারীদের মালিকানা এখন শুধু তার স্বামীর নয়; কর্পোরেট ফার্মগুলোও নারীদের অর্ধেক মালিকানা দখল করে রেখেছে। গণমাধ্যমে নারীদের অশালীন পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করিয়ে আকর্ষণীয় করে প্রদর্শন করছে। বিবাহপূর্ব যুগল সম্পর্ককে আধুনিকতার নাম দিয়ে এই শিক্ষিত সমাজে অবাধে চলছে ব্যভিচার। আজকাল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও তাদের ছাত্রছাত্রীদের রোমান্টিক ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ার জন্য উৎসাহ দিয়ে থাকে যা কেবলই পাশ্চাত্য সভ্যতার নগ্ন অনুকরণ, এর সাথে আমাদের নিজস্ব সভ্যতার কোন যোগাযোগ নেই।

যদিও প্রগতিবাদীরা বলে থাকে যে মানুষ নিজেই নিজের মূল্যবোধ তৈরি করতে সক্ষম। মানুষ নৈতিক শিক্ষা পরিবার থেকে গ্রহণ করবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সমাজের দুর্নীতিবাজ ও দুশ্চরিত্রের মানুষগুলোও তো কোন না কোন সন্তানের পিতামাতা। তারা কিভাবে তাদের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দেবে? যেহেতু তারা নিজেরাই নৈতিকতাসম্পন্ন নয়। বর্তমান আধুনিক কালের সমাজ নাকি সভ্য হয়েছে। সে সংজ্ঞানুযায়ী আগে মানুষ অসভ্য ছিল। এখন সামান্য অর্থসম্পদের লোভে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে। গরিবের দারিদ্রকে পুঁজি করে চলছে শ্রমশোষণ। ইন্দ্রিয়ের সুখের জন্য চলছে অমানবিক নির্যাতন ও ধর্ষণ। এইসব কি কোন বর্বরতা নয়? সুতরাং বাঙালি জাতির মেরুদণ্ডে ব্রিটিশ শাসকশ্রেণী শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে যে জায়গাটিতে আঘাত করেছিল। সেই জায়গাটি পুনর্বহাল করতে হবে। তা না হলে সমাজে কোন উন্নতি আসবে না। উন্নয়নশীল সমাজে আধুনিকতাকে স্বাগত জানানো যায়। কিন্তু নিজস্ব গৌরবময় ভাষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও স্বাতন্ত্র্যতা ছাড়া জাতি আজকের বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।

 

Advertisements