রবীন্দ্রনাথ ও হাফেজ
Advertisements

রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানে রয়েছে এক অপূর্ব মরমী আধ্যাত্মিকতা। একথা স্বীকার না করে উপায় নেই। তার রচনা স্নিগ্ধ, গীতল ও গভীর। পূজা, প্রেম, প্রকৃতি ও মানবের এক চিরন্তন মিশেল ঘটিয়ে তিনি উভয় বাংলার বাঙালিকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন। এই আধ্যাত্মিক চেতনার উৎস হোল প্রধানত: প্রাচীন বৈদিক উপনিষদের শ্লোক, মধ্যযুগের ভক্তিবাদী সন্ত কবীরের দোহা, বৈষ্ণব কীর্তন, বিদ্যাপতির পদাবলী এবং লালন সাঁইয়ের বাউল ও গগন হরকরার লোকগান।

রবীন্দ্র চেতনার এইসব ঐতিহ্য সম্পর্কে গড়পরতা বাঙালি আমরা কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক চেতনার একটি অন্যতম উৎস যে পারসিক সুফি গজলের শ্রেষ্ঠ কবি হাফেজ সিরাজী – তা আমরা ক’জন জানি? অবশ্য রবীন্দ্রনাথ হাফেজের সুফি চেতনাকে তাঁর মতো করে ব্রাহ্ম একেশ্বরবাদী চেতনায় রূপান্তর করে নিয়েছিলেন। সেটা তো তাঁকে করতেই হবে, কারণ বড় কবি প্রভাবিত হলেও নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য কখনো বিসর্জন দেন না।

তথ্য ও প্রমাণ দিয়ে বেশ কয়েকজন গবেষক দেখিয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের অনেক কবিতাতে এবং ‘গীতবিতান’-এর অনেক গানে রয়েছে ইরানি কবি হাফেজের ‘দিওয়ান’-এর পরোক্ষ প্রভাব। এই ঋণ স্বীকারে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কোনো দ্বিধা ছিল না। তিনি ১৯৩২ সালে যখন ইরান সফর করেছিলেন তখন অকপটে হাফেজের প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন।

তিনি হাফেজের সমাধি পরিদর্শন করেছিলেন; সেখানে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ধ্যান করেছিলেন; সেখানে হাফেজের ‘দিওয়ান’ থেকে কিছু চরণ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হিশেবে তিনি একাকী আবৃত্তি করেছিলেন। তিনি তাঁর ইরান সফরকালে এই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ইসফাহানের একটি সংবাদপত্রে সাক্ষাতকার দেন; সেখানে তিনি বলেছিলেন: “The experience [has] gone deep into my heart…I had my first introduction to Hafez through my father, who used to recite his [Hafez’s] verses to me. They seemed to me like a greeting from a faraway poet who was yet near to me.” [১] [বাংলা অনুবাদ: এই অভিজ্ঞতা আমার হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করেছে…হাফেজের রচনা সম্পর্কে আমি প্রথম জানতে পারি আমার পিতার সূত্রে, যিনি তাঁর [হাফেজের] কবিতা আমাকে আবৃত্তি করে শোনাতেন। তাঁর কবিতা আমার কাছে মনে হত অনেক দূরদেশী কোন কবির শুভেচ্ছার মত যা তাঁকে আমার নিকটজন করে তুলত।]*

তিনি ইরান ভ্রমণ বিষয়ে ‘পারস্য যাত্রী’ শীর্ষক একটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখেছিলেন; যার ইংরেজী অনুবাদ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

“Sitting near the tomb a signal flashed through my mind, a signal from the bright and smiling eyes of the poet on a long past spring day. I had the distinct feeling that after a lapse of many centuries, across the span of many deaths and births, sitting near this tomb was another wayfarer who had made a bond with Hafez” [২] [বাংলা অনুবাদ: সমাধিসৌধের কাছে বসে থাকার সময় আমার মনে একটা বার্তা ঝলকে উঠল, এ যেন কোন এক সুদূর অতীত বসন্ত দিনে কবির উজ্জ্বল ও সহাস্য চোখ থেকে আসা এক বার্তা। আমার এমন একটি বিশেষ অনুভূতি হল যে মনে হল যে অনেক শতাব্দী পার হবার পরে, অনেক জন্ম ও মৃত্যুর পরিসর পেরিয়ে, এই সমাধিসৌধের কাছে যেন বসেছে এমন এক পথিক যার রয়েছে হাফেজের সঙ্গে সুনিবিড় বন্ধনের সম্পর্ক।]*

রবীন্দ্রনাথ ইরানে ভ্রমণকালে একটি বক্তৃতায় বলেন: “I am an Iranian and my ancestors emigrated from this land and went to India. I am therefore pleased to be returning to my homeland. I realize that the kindness shown to me here is because of this unity of race and culture. And the reason for this trip … is precisely to show the sense of unity and affection that I have for Iran.” [৩] [বাংলা অনুবাদ: আমি একজন ইরানী এবং আমার পূর্বপুরুষেরা এই ভূমি থেকে ভারতে অভিবাসনে গিয়েছিলেন। কাজেই আমার স্বভূমিতে ফেরত এসে আমি আনন্দিত। আমি বুঝতে পেরেছি যে আমার প্রতি যে সাদর সম্ভাষণ এখানে দেখানো হয়েছে তার কারণ হল এই বর্ণ ও কৃষ্টির ঐক্য। এবং আমার এই সফরের উদ্দেশ্য হল….ইরানের প্রতি আমার এই ঐক্য ও ভালবাসার অনুভূতির একান্ত প্রকাশ।]*

রেফারেন্স:
[১] Isfahan, April 25, 1932
[২] Rabindranath Tagore, Journey to Persia and Iraq, Translated by Surendranath Tagore and Sukhendu Ray, Kolkata, 2003
[৩] I. Sadiq, Yādegār-e ‘omr, 4 vols., Tehran, 1966, p. 158; Ettelā‘āt, May 4 and 7, 1932
*ইংরেজি উদ্ধৃতির বাংলা অনুবাদ লেখক কর্তৃক কৃত।
(পূর্বপ্রকাশিত, জানুয়ারী ১৫, ২০২০)

Advertisements