হেলেনা জাহাঙ্গীর
Advertisements

নিজের উদ্দেশ্য হাসিলে যেকোনো পন্থা ব্যবহার করতেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। কখনো সখ্য তৈরি করে ব্ল্যাকমেইল করে আবার কখনো ব্যক্তিগত সাইবার টিম ব্যবহার করে আবার কখনোবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে ছবি তুলে তিনি নিজের টার্গেট পুরো করতেন। এসব করে অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি খ্যাতিও অর্জন করতে চেয়েছিলেন হেলেনা। তবে গ্রেফতারে পর আপাতত তিনি রিমান্ডে আছেন। জানা গেছে, উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফাঁদে ফেলতে প্রথমে টার্গেট করতেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। এরপর তার সাথে কৌশলে সখ্য গড়ে তুলতেন। সেই সখ্যের সুযোগ নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে তিনি এমন মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন দাবি করেছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের নামে মানুষকে জিম্মি করে চাঁদা আদায় এবং জয়যাত্রা টিভির মাধ্যমে দেশ-বিদেশে প্রতিনিধি নিয়োগের নামে বেতনের পরিবর্তে নিয়োগকৃতদের কাছ থেকে চাঁদা নিতেন আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপকমিটি থেকে অব্যাহতি পাওয়া হেলেনা জাহাঙ্গীর। তার রয়েছে নিজস্ব সাইবার টিমও। যারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার প্রচারণা চালাত। কেউ তাকে নিয়ে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করলে তাদের ঘায়েল করার দায়িত্ব ছিল ওই সাইবার টিমের।

ওই সাইবার টিমে রয়েছে ১৫-২০ জন। এদিকে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্লবী থানায় আরেকটি মামলা করা হয়েছে। গত শুক্রবার মধ্যরাতে র্যাব-৪ বাদি হয়ে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন এর ৩৫, ৫৫, ৭৩ ধারায় মামলাটি করে। হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, হেলেনা সুনির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির জন্য থেমে থাকেননি। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে তার। উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যাকেই প্রয়োজন হয়েছে তাকে তিনি ঘায়েল করেছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন এবং সেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছেন শুধুমাত্র উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। আমাদের মামলার কারণ এটাই। সে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন যা তাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে, জনগণের মধ্যেও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রথমে সখ্য তৈরি করে পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করতেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। এ বিষয়ে তথ্য আমরা পেয়েছি।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে জয়যাত্রা আইপি টেলিভিশনের কার্যক্রম শুরু করেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। জেলা-উপজেলা ছাড়াও অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন দেশে জয়যাত্রা টিভির প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। প্রতিনিধি হিসেবে যারা নিয়োগ পেতেন তারা বেতনভুক্ত না হয়ে উল্টো অফিসে তাদের টাকা দিতে হতো।

এ বিষয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জয়যাত্রা আইপি টেলিভিশন প্রতিষ্ঠার পর সেখানে ৭০ থেকে ৮০ জন যোগদান করেন। দীর্ঘদিন কাজ করার পরে ২০-২৫ জনকে ছাড়া বাকি সবাইকে বেতন না দিয়েই ছাঁটাই করেন হেলেনা। প্রতিনিধিদের কাছ থেকে কার্ডের বিনিময়ে নিয়মিত চাঁদা সংগ্রহ করতেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ অন্যান্য দেশেও জয়যাত্রার প্রতিনিধি ছিল, তাদের সবার কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নিতেন তিনি। দেশে-বিদেশে জয়যাত্রা টেলিভিশনের যত প্রতিনিধি রয়েছে, তা দেশের অন্য কোনো স্যাটেলাইট টেলিভিশনের নেই বলে দাবিও করেন হেলেনা।

কিছুদিন আগে জয়যাত্রা টেলিভিশনের একজন জেলা প্রতিনিধি চাঁদাবাজির সময় পুলিশের হাতে আটক হয়। আমরা মনে করছি, হেলেনার মতো তার প্রতিনিধিরাও চাঁদাবাজি করত। কী কারণে টাকা নিয়েছে এবং কী কাজে ব্যবহার করা হয়েছে- এ বিষয়ে হেলেনা জাহাঙ্গীর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি বলেও জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা। এসবের দায় অফিস স্টাফদের ওপর চাপিয়েছেন তিনি। তার বাসায় ও অফিস থেকে যে পরিমাণ ভাউচার পাওয়া গেছে তা এখনো পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলে জানান আল মঈন।

এক প্রশ্নের জবাবে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীরের স্বামী ১৯৯০ সাল থেকে গার্মেন্টে চাকরি করতেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে অন্যদের সঙ্গে পার্টনারশিপের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে এখন পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে তাদের পাঁচটি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া রাজধানীর গুলশান, উত্তরা ও মিরপুরে তাদের ১৬টি ফ্ল্যাট রয়েছে। পাশাপাশি আটটি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া ডজনখানেক ক্লাবের সদস্য তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে কখনো ছয়টি গাড়ি, কখনো আটটি গাড়ির কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। এসব বিষয়ে যারা তদন্ত করবেন তারা খতিয়ে দেখবেন।

শক্তিশালী সাইবার টিম : জানা গেছে, হেলেনা জাহাঙ্গীরের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ২০ লাখ ফলোয়ার আছে। তার পেজ ও জয়যাত্রা আইপি টেলিভিশনের পেজ মনিটরিংয়ের জন্য ছিল শক্তিশালী সাইবার টিম। হেলেনার পেজে অযাচিত ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য এলেই সাইবার টিম তাদের ঘায়েল করত।

এ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জয়যাত্রা টিভির অফিসে অভিযানের সময় র্যাব জানতে পারে হেলেনা জাহাঙ্গীর একটি শক্তিশালী সাইবার টিম পরিচালনা করতেন। এই টিমে ১৫-২০ জনের নাম পাওয়া গেছে। এই সাইবার টিম একাধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে হেলেনা জাহাঙ্গীরের নামে প্রচার-প্রচারণা চালাত। তারা নিজেরাই লাইক, শেয়ার ও হেলেনার পক্ষে পজিটিভ কমেন্ট করতেন। এমনকি হেলেনার বিরুদ্ধে যদি কেউ নেতিবাচক মন্তব্য করতেন তৎক্ষণাৎ সাইবার টিম তাদের অপমান করে ঘায়েল করতেন।

পল্লবী থানায় আরেকটি মামলা : আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটি থেকে সদ্য পদ হারানো হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্লবী থানায় আরেকটি মামলা করা হয়েছে। গতকাল রাতে এ খবর লেখা পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে র্যাব বাদি হয়ে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৫, ৫৫, ৭৩ ধারায় মামলাটি দায়ের করে।
র্যাব জানায়, এর আগে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এছাড়া বিশেষ ক্ষমতা আইন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের চারটি ধারায় আরো একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়াই মিরপুরে হেলেনা জাহাঙ্গীর জয়যাত্রা টেলিভিশন স্টেশন পরিচালনা করছিলেন। র্যাব-৪ এর অভিযানে সেটি সিলগালা করে এবং অবৈধ মালামাল জব্দ করা হয়। হেলেনা জাহাঙ্গীর টেলিভিশনটির কর্মী ও সাংবাদিক নিয়োগের নামে চাঁদাবাজি ও প্রতারণা করতেন। এ ধরনের একটি চাঁদাবাজি সংক্রান্ত ফোনালাপ ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। অভিযানে চাঁদাবাজি সংক্রান্ত নথিপত্রও জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব।

এর আগে গত শুক্রবার বিকেলে র্যাব সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, অপকৌশলের মাধ্যমে ‘মাদার তেরেসা’, ‘পল্লী মাতা’ ও ‘প্রবাসী মাতা’ হিসেবে পরিচিতি পেতে জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন হেলেনা। তার পৃষ্ঠপোষকতায় সঙ্ঘবদ্ধ চক্রটি এসব ভুয়া খেতাবের অপপ্রচার চালাত। তিনি বিভিন্ন দেশী সংস্থা ও ব্যক্তি থেকে জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের নামে অর্থ সংগ্রহ করতেন। যা মানবিক সহায়তায় ব্যবহারের চেয়ে নিজের খেতাবের প্রচার প্রচারণায় বেশি ব্যবহার করা হতো।

গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে তার গুলশান-২ এর ৩৬ নম্বর রোডের হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসভবনে অভিযান শুরু করে র্যাব। দীর্ঘ চার ঘণ্টা অভিযান শেষে রাত ১২টার দিকে তাকে আটক করে র্যাব সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন শুক্রবার সন্ধ্যায় গুলশান থানায় পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। বর্তমানে তিনি রিমান্ডে রয়েছেন।

Advertisements