২০২২ এর মেডিসিনে নোবেল পুরুষ্কার লাভ করেছেন সুইডিশ বিজ্ঞানী সাভান্তে পাবো। তাকে অভিনন্দন, তিনি নিয়ান্ডারথাল এর জিনোম সিকুয়েন্সিং এর জন্য নোবেল পাচ্ছেন এবং ১০ ই ডিসেম্বর নোবেল প্রাইজমানি তাকে তুলে দেয়া হবে। তবে সান্তো পাবোর এই নোবেল জয়ের পর তিনি যতটা ন খুশি হয়েছেন তার থেকেও বেশি খুশি হয়ে হাত পা ছুড়ে অনলাইন কাপাচ্ছে গোটাকয়েক ভুইফোড় বিজ্ঞান গ্রুপ, কিছু কথিত লেখক, নাস্তিক কমিউনিটি, তাদের দাবি সান্তো পাবোর এই নোবেল জয় বিবর্তন তাদের ভাষায় ম্যাক্রো ইভোলিউশন বা হিউম্যান ইভোলিউশন কে প্রমাণ করা হয়েছে বা এই গবেষণার মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়েছে। এবার আর মোল্লারা যাবে কোথায় এবার ও কি তারা বিবর্তন অস্বীকার করবে?
কথায় আছে না, যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া পড়শীর ঘুম নাই, তথাকথিত ভুইফোড় বিজ্ঞান গ্রুপ, গ্রুপের কিছু লেখক, কিছু বঙ্গীয় নাস্তিক কমিউনিটির সেই অবস্থা। চলুন দেখা যাক পাবো কি গবেষণা করলেন আর বিবর্তন ( ম্যাক্রো ইভোলিউশন) কতটা প্রমাণিত হলো
বেশিরভাগ আধুনিক পাঠ্যপুস্তক প্রজাতির সংজ্ঞা হিসেবে আর্নস্ট মেয়ারের ১৯৪২ সালের সংজ্ঞা ব্যবহার
করে, যা জৈবিক প্রজাতির ধারণা নামে পরিচিত । এটি একটি প্রজনন বা বিচ্ছিন্ন ধারণাও বলা হয়, তার মতে,
❝ যদি দুই জীবের অন্তঃপ্রজননের মাধ্যমে বংশধরের জন্ম হয় এবং সেই বংশধরের মাঝেও প্রজননের ক্ষমতা থাকে, তা হলে জীব দুটি একই প্রজাতির্ভুক্ত এবং তারা অন্যান্য গোষ্ঠীর থেকে প্রজনন বিচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। এটি হলো বায়োলজিক্যাল প্রজাতি ধারণা। ❞ (১)
প্রজাতির এই সংজ্ঞা অনুযায়ী হোমিনিন গোত্রের হোমো সেপিয়েন্স আর নিয়ান্ডারথাল মোটেও আলাদা প্রজাতি নয় বরং দুটোই একই প্রজাতি! গবেষণায় দেখা গেছে হোমো সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডারথাল নিজেদের মধ্যে ইন্টারব্রিডিং এ সক্ষম। (২) এছাড়াও হোমো সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডারথাল এর ইন্টারব্রিডিং এর মাধ্যমে উর্বর বংশধর আসা সম্ভব শুধু তাই নয় ডেনিসোভান, হাইডেলবার্গেনসিস এর সাথেও হোমো সেপিয়েন্স আন্তঃপ্রজনন সম্পন্ন হয়েছিলো,(৩) সেক্ষেত্রে বায়োলজিক্যাল স্পিসিস এর ডেফিনিশন অনুযায়ী এরা এক ই প্রজাতি আলাদা ভিন্ন কোনো প্রজাতি নয়।সুতরাং নিয়ান্ডারথাল এর জিনোম সিকুয়েন্সিং হিউম্যান ইভোলিউশন বা তথাকথিত ম্যাক্রো ইভোলিউশন কে প্রমাণ করে এমন টা দাবি করা হাস্যকর বৈ কি।
বিষয়টা বোঝার জন্য ধরা যাক যে একটি প্রজাতি প্রায় ৪০০,০০০ বছর আগে আফ্রিকা থেকে ইউরোপে স্থানান্তরিত হয় এবং পরবর্তী ৩২০,০০০ বছর ধরে তার পূর্বপুরুষের জনসংখ্যা থেকে প্রজননগতভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এটি শীতল আবহাওয়ার জন্য স্বতন্ত্র শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য এবং অভিযোজন বিকশিত করে। উপরন্তু, আদি পূর্বপুরুষের জনসংখ্যার অন্যান্য বংশধরেরা প্রায় ৮০,০০০ বছর আগে ইউরোপে চলে যাওয়ার পরেও, উভয় গোষ্ঠীর কঙ্কালগুলিতে মিশ্রিত বৈশিষ্ট্যের কোনও স্পষ্ট লক্ষণ দেখায় না। আধুনিক বিজ্ঞানীরা এই প্রাণীকে দুটি ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন। তারপরে, জেনেটিক বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে এই দুটি প্রজাতির সদস্যরা আন্তঃপ্রজনন করে এবং কার্যকর সন্তান উৎপাদন করে যা ইউরোপে জনবহুল এবং পূর্ব দিকে চীন এবং পাপুয়া নিউ গিনি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এবং বায়োলজিক্যাল স্পিসিস এর ডেফিনিশন অনুযায়ী এরা আসলে বিচ্ছিন্ন আলাদা কোনো প্রজাতি না বরং একই প্রজাতি। এই বিষয়টা ট্যাক্সোনোমিস্টদের জন্য শিক্ষার উপকরণ হিসেবে ভালো কাজে লাগতে পারে। তবে বিবর্তনবাদ ( ম্যাক্রো ইভোলিউশন) এর জন্য অবশ্যই এটা কোনো সতন্ত্র প্রমাণ নয়। (৪)
২০২২ এ মেডিসিনে নোবেল বিজয়ী সান্তো পাবো বর্তমান সময়ের মানুষের বিলুপ্ত আত্মীয় নিয়ানডার্থালের জিনোম সিকোয়েন্স করেছেন । তিনি পূর্বে অজানা হোমিনিন ডেনিসোভা-ও আবিষ্কারও করেছিলেন। গুরুত্বপূর্ণভাবে, Pääbo এও দেখেছেন যে প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে আফ্রিকা থেকে অভিবাসনের পর এই বিলুপ্ত হোমিনিন থেকে হোমো সেপিয়েন্সে জিন স্থানান্তর ঘটেছে। বর্তমান সময়ের মানুষের কাছে জিনের এই প্রাচীন প্রবাহের আজ শারীরবৃত্তীয় প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে, এর ফলে আমাদের ইমিউন সিস্টেম কোন সংক্রমণে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় তা বোঝা যাবে। মূলত পাবো নোবেল প্রাইজ পাচ্ছেন এজন্যই। মানুষের সাধারণ পূর্বপুরুষ এর প্রমাণ স্বরুপ তাকে নোবেল প্রাইজ দেয়া হচ্ছে না বহু কাঠখোট্টা পুড়িয়ে মানুষের ইমিউন সিস্টেম নিয়ে কাজের জন্যই তার নোবেল এছাড়াও ২০০৮ সালে, পাবো এবং তার দল সাইবেরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে ডেনিসোভা গুহায় একটি আঙুলের হাড় থেকে ৪০,০০০ বছরের পুরনো একটি খণ্ড আবিষ্কার করে। হাড়ের মধ্যে সংরক্ষিত ডিএনএ নিয়ে, পাবোর দল ক্রমানুসারে সিকুয়েন্সিং করেছিল। ফলাফলগুলি দেখিয়েছে : নিয়ান্ডারথাল এবং বর্তমান মানুষের সমস্ত পরিচিত ক্রমগুলির তুলনায় ডিএনএ ক্রমটি অনন্য ছিল। পাবো একটি পূর্বে অজানা হোমিনিন আবিষ্কার করেছিলেন, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ডেনিসোভা। বিশ্বের বিভিন্ন অংশের সমসাময়িক মানুষের ক্রমগুলির সাথে তুলনা করে দেখা গেছে যে ডেনিসোভা এবং হোমো সেপিয়েন্সের মধ্যেও জিন প্রবাহ ঘটেছে । এই সম্পর্কটি প্রথম মেলানেশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অংশের জনসংখ্যার মধ্যে দেখা গিয়েছিল, যেখানে ব্যক্তিরা ৬% পর্যন্ত ডেনিসোভা ডিএনএ বহন করে। আর বায়োলজিকাল স্পেসিস এর ডেফিনিশন অনুযায়ী আগেই আমরা দেখেছি এরা কেউই আলাদা কোনো প্রজাতি নয়।
সর্বশেষে, সান্তো পাবো নিয়ান্ডারথাল জিনোম সিকুয়েন্সিং এর মাধ্যমে হোমো সেপিয়েন্স এর সাথে তারা কতটা জিন ট্রান্সফার করে তা নির্ণয়ের মাধ্যমে প্রাচীন প্রজাতি থেকে হোমো সেপিয়েন্স এর ইমিউন সিস্টেম কোন সংক্রমণে কিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা নিয়ে কাজ করেছেন যার ফলস্বরূপ তিনি নোবেল প্রাইজ পাচ্ছেন। এছাড়াও গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে নিয়ান্ডারথাল সহ অনেক প্রাচীন গোষ্ঠী যারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে তারা আসলে ভিন্ন কোন প্রজাতি নয় বরং একই প্রজাতির উপপ্রজাতি বলা যায় কেননা তারা আন্তঃপ্রজনন এ সক্ষম যদিওবা তাদের মধ্যে পরিবেশগত কিছু পার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক। সর্বোপরি, সান্তো পাবোর এই গবেষণা শিম্পাঞ্জি বা তদ্রুপ কোনো প্রানী মানুষের সাধারণ পূর্বপুরুষ এটা প্রমাণ করে না, কথিত মানব বিবর্তন এর স্টেজ গুলো কেও প্রমাণ করে না। বরং প্রাচীন কালে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া একই গোত্রের ভিন্ন ইকোলজিকাল সিস্টেমে বেড়ে ওঠা মানুষের জিন প্রবাহ নিয়ে আলোচনা করে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের শারীরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে।
সুতরাং মেডিসিনে সুইডিশ বিজ্ঞানী সান্তো পাবোর নোবেল প্রাইজ বিবর্তন ( ম্যাক্রো ইভোলিউশন) প্রমাণ করেছে বা এর দ্বারা বিবর্তন কে আর তত্ত্ব বলা যাবেনা, নোবেল প্রাইজ মানুষ সতন্ত্র একজোড়া দম্পতি থেকে এসেছে এই ধারণাকে গুড়িয়ে দিয়েছে বলে আস্ফালন করা ফেসবুক বিজ্ঞানীদের সে আশায় গুড়ে বালি।
রেফারেন্সঃ
১.Mayr, Ernst (1942). Systematics and the Origin of Species. New York: Columbia University Press.
২.Ozgur Taskent, Yen Lung Lin, Ioannis Patramanis, Pavlos Pavlidis, Omer Gokcumen, Analysis of Haplotypic Variation and Deletion Polymorphisms Point to Multiple Archaic Introgression Events, Including from Altai Neanderthal Lineage, Genetics, Volume 215, Issue 2, 1 June 2020, Pages 497–509
৩. Ko, K.H. Hominin interbreeding and the evolution of human variation. J of Biol Res-Thessaloniki 23, 17 (2016)
৪. Our Neandertal Brethren: Why They Were Not a Separate Species, scientific american, August 1, 2010.
৫. Krings M, Stone A, Schmitz RW, Krainitzki H, Stoneking M, Pääbo S. Neandertal DNA sequences and the origin of modern humans. Cell. 1997:90:19-30.