আলেমদের মধ্যে অনেকে বলেন সুন্নি ইসলামের প্রধানতম চারটি মাযহাবের মধ্যে কোনো একটিকে মানতেই হবে। কেউ আবার বলেন মাযহাব নয়, মানতে হবে ‘সহিহ’ মতটি। একেক তরফের একেক রকম এই বয়ানে আমরা যারা সাধারণ মুসলিম তারা পড়ে যাই দ্বিধার মধ্যে। মাযহাব মানতেই হবে? নাকি, না মানলেও চলবে? এই দুইয়ের মাঝামাঝি কোনো সমাধানও বা আছে কি? বিষয়টি নিয়ে আমরা যারা খানিকটা হলেও খটকার মধ্যে আছি তাদের জন্যই আজকের এই আলোচনা। তাহলে শুরু করা যাক।
যেসব কারণে আলেমদের মধ্যে মতপার্থক্য হতে পারে:
মুসলিম মাত্রই বিশ্বাস করেন যে, কুরআন এবং প্রিয় নবী (ﷺ)-এর প্রদর্শিত পন্থা হলো ইসলামের যাবতীয় বিধিবিধানের প্রধানতম উৎস। হানাফি বা হাম্বলি, সালাফি বা সুফি প্রত্যেকেই এই বিষয়ে একমত।
তবে, উৎস একই হলেও পাঠ ও পঠনের ভিন্নতার কারণে কুরআনের একই আয়াতের একাধিক অর্থ হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে হাফস ও ওয়ারশ কিরাতের স্বতন্ত্রতার কথা বলা যেতে পারে। কোনো একটি সর্বনাম কোন বিশেষ্যের সাথে সম্বন্ধিত হবে তার উপর ভিত্তি করেও অর্থের ভিন্নতা আসতে পারে। কোনো একটি বাক্যের কোথায় থামতে হবে আর কোথায় থামা যাবে না তার ভিত্তিতেও উপসংহার ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। একটি শব্দের একাধিক অর্থের মধ্যে কোনটি কোনো একটি নির্দিষ্ট আয়াতের ক্ষেত্রে অধিকতর প্রযোজ্য হবে তা নিয়েও গবেষকদের মধ্যে মতের ভিন্নতা আসতে পারে।
হাদিসের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জটিল। কোনো একটি বর্ণনার বর্ণনাসূত্রের নির্ভরতা বা অনির্ভরতা নির্ণয় করতে গিয়ে মুহাদ্দিসদের মধ্যে মতপার্থক্য হতে পারে। আবার, কোনো একটি হাদিসের বর্ণনাসূত্রটি নির্ভরযোগ্য বলে প্রতীয়মান হলেও সেখানে যে বক্তব্যটি উদ্ধৃত করা হয়েছে তা পুরোপুরি সঠিক না-ও হতে পারে। সাহাবীরা হাদিসটির উপর কীভাবে আমল করেছেন তার ভিত্তিতেও একাধিক মত আসতে পারে।
এসব কারণে, একই উৎস থেকে আহরিত হলেও কোনো একটি বিষয়ে একাধিক উপসংহারে পৌঁছানো অসম্ভব কিছু নয়। সাহাবীদের সময় থেকেই এই মতপার্থক্য চলে আসছে।
তাহলে, সবই কি মানুষের মত?
না। ইসলামের মৌলিক কাঠামোগত যেসব বিধান আছে সেসব বিষয়ে গোটা উম্মতের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নেই।
ফজর, যোহর, আসর, মাগরিব ও এশা – দিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয। ফজরের ফরয নামায দুই রাকাত, মাগরিবের ফরয নামায তিন রাকাত আর যোহর, আসর ও এশার ফরয নামায চার রাকাত। পবিত্রতা সহকারে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে তাকবির বলে নামায শুরু করতে হয়। এরপর কুরআন থেকে কিছু অংশ তিলাওয়াত করতে হয়। রুকুতে যেতে হয়। আবার উঠে দাঁড়াতে হয়। সেখান থেকে সিজদায় যেতে হয়। দুই সিজদার মাঝখানে বসতে হয়। প্রথম রাকাতের শেষে আবারও উঠে দাঁড়াতে হয় আর দ্বিতীয় রাকাতের শেষে তাশাহহুদ পড়ার জন্য বসতে হয়। তাসলিম দিয়ে নামায শেষ করতে হয়। নামাযের মৌলিক এই কাঠামোতে কারও মধ্যে কোনো মতপার্থক্য আছে কি? নেই। এর ফলেই তো যেকোনো মাযহাব বা মাসলাকের যেকোনো মুসলিম মক্কায় মসজিদুল হারামে গিয়ে একই ইমামের পিছনে সহজেই নামায আদায় করতে পারেন।
ইসলামের বাদবাকি যেসব মৌলিক বিধিবিধান আছে তার ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য।
আলেমদের মধ্যে এই যে ভিন্ন ভিন্ন মত আমরা দেখি তা মূলত ইসলামের একেকটি বিধিবিধানের শাখাপ্রশাখাগত বিস্তারিত আলোচনায় যখন যাওয়া হয় তখন হয়।
মতভিন্নতামূলক বিষয়ে কার মত সবচেয়ে সঠিক?
সাহাবী, তাবেয়ী, তাবা-তাবেয়ী ও প্রসিদ্ধ মুজতাহিদ ইমামরা যেসব বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন সেখানে এদের মধ্যে একটিমাত্র মত একমাত্র সঠিক আর বাকি সবই বেঠিক – বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এমনটি বলার কোনো অবকাশ নেই।
হ্যাঁ, কারও আছে কোনো একটি মতকে অপেক্ষাকৃত সঠিক বলে মনে হতে পারে। আরেকজনের কাছে আরেকটি মত শুদ্ধতর লাগতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত বৈধ উসুল বা পন্থা ব্যবহার করে একটি উপসংহারে পৌঁছানো হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের উভয়েই নিজ নিজ অবস্থানে সঠিক আছেন।
আমাদের করণীয়:
আমরা যারা এই লেখাটি পড়ছি তারা কেউই কুরআন ও হাদিস থেকে সরাসরি বিধিবিধান আহরণ করার যোগ্যতা রাখি না। ফলে, এসব বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো না কোনো আলেমের মতের শরণাপন্ন আমাদেরকে হতেই হবে।
কোন ধারার আলেমদের কথা শুনব?
গত প্রায় বারো শতাব্দী ধরে সুন্নি মুসলিমরা হানাফি, মালিকি, শাফিঈ বা হাম্বলি – এই চারটি মাযহাবের মধ্যে কোনো একটি মেনে আসছেন। নানাবিধ কারণে পৃথিবীর একেক প্রান্তে একেকটি মাযহাবের প্রসার ঘটেছে। সেই সূত্রে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে হানাফি মাযহাব বিস্তৃতি লাভ করেছে।
এর পাশাপাশি, ইবনে হাযম বা ইবনে তায়মিয়ার মতো স্বতন্ত্র চিন্তকেরাও সময়ে সময়ে ছিলেন। গত দুই শতাব্দীর কিছু বেশি সময় ধরে সালাফি বা আহলে হাদিস ঘরানাটিও প্রসার লাভ করেছে।
ধরে নিচ্ছি, যিনি মাযহাব মানেন তিনি তার নিজ মাযহাব মেনেই চলবেন। আর যিনি সালাফি বা আহলে হাদিস বলে নিজেকে পরিচয় দেন তিনি সেই পথের উপরেই থাকবেন। এই উভয় ঘরানার যেটির অনুসারীই আপনি হয়ে থাকুন না কেন, নিজে নিজে পন্ডিতি না করে আপনার নিজ ঘরানার নির্ভরযোগ্য আলেমদের মত আপনি মেনে চলবেন – এতটুকুই প্রত্যাশা।
সেই সাথে, আপনি যে পথের পথিকই হয়ে থাকুন না কেন, অন্য আরেকটি পথ আর তার পথিককে সম্মান করুন। দলান্ধতা পরিহার করে চলুন। মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সহায়তা করুন।
আপনি সালাফি বা আহলে হাদিস ঘরানার অনুসারী হয়ে থাকলে লেখাটির অবশিষ্ট অংশ আপনার জন্য প্রাসঙ্গিক না-ও হতে পারে। তবে, মাযহাবের অনুসারীদের জন্য বাদবাকি এই আলোচনাটুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কোন মাযহাব মানবো?
হানাফি, মালিকি, শাফিঈ ও হাম্বলি – এই চারটি মাযহাবের মধ্যে যেকোনো একটি মানলেই চলে। তবে, যে দেশে যে মাযহাবের চল বেশি সেই দেশে সেই মাযহাব মেনে চলাই উত্তম। এতে করে সেখানকার বৃহত্তর মুসলিম সমাজের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা সহজতর হয়।
শুরু থেকেই বাঙালি মুসলিম সমাজে যেহেতু হানাফি মাযহাব প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে তাই আমাদের জন্য মোটা দাগে হানাফি মাযহাবের গন্ডির মধ্যে থাকতে পারলেই ভালো।
ধর্মীয় প্রতিটি বিষয়ে কেবলমাত্র একটি মাযহাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে?
ধরা যাক, কোনো একটি বিষয়ে হানাফি মাযহাবের মতটি অপেক্ষাকৃত সহজ, আবার আরেকটি বিষয়ে একটু কঠিন। কঠিন সেই বিষয়টি দেখা যাবে অন্য আরেকটি মাযহাবে সহজ উপায়ে করা যায়।
আমরা কেউই যেহেতু প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত নই তাই বেছে নেওয়ার সুযোগ পেলে প্রায় প্রতিটি বিষয়ে সহজতর মতটি মানার দিকেই আমাদের ঝোঁক বেশি থাকবে। এভাবে বাছবিচার ব্যতিরেকে সহজতা বেছে নেওয়ার পথ উন্মুক্ত করে দিলে তা প্রকারান্তরে প্রবৃত্তির দাসত্বকেই উৎসাহিত করবে।
পক্ষান্তরে, আগাগোড়া একটিমাত্র মাযহাব মেনে চললে বিষয়ভেদে সহজ ও কঠিন সবরকম মতই মেনে চলা হবে, যা প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত থাকতে আমাদেরকে সাহায্য করবে।
অন্য মাযহাবের কোনো সহজ মতই কি মানা যাবে না?
খামখেয়ালিপনা হলে তো যাবেই না। তবে, আপনি যে মাযহাব মেনে চলছেন সেখানকার কোনো একটি মত মেনে চলা যদি বাস্তবিক অর্থেই আপনার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে থাকে এবং অন্য আরেকটি মাযহাবের সহজ একটি মত মেনে চললে যদি প্রকৃত অর্থেই আপনার সেই কষ্টটি লাঘব হয় তাহলে শর্তসাপেক্ষে সেই মতটি মানা যেতে পারে বলে আলেমদের একটি মত রয়েছে।
সহজ কথায় এই শর্তসমূহ হলো:
ক. সহজতার খাতিরে সহজতা তালাশ করা যাবে না। বাস্তব কোনো কষ্ট বা অসুবিধা লাঘব করার নিমিত্তেই তা হতে হবে।
খ. ভিন্ন যে মাযহাব থেকে মতটি নেওয়া হচ্ছে সেই মাযহাব অনুযায়ী উল্লেখ্য কাজটি আগাগোড়া শুদ্ধ হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ: অন্য মাযহাব থেকে নামাযের অপেক্ষাকৃত সহজ একটি হুকুম গ্রহণ করলে সেই মাযহাব অনুযায়ী নামাযের শর্তাবলী (যেমন ওযু-গোসল-তায়াম্মুম, পাক-নাপাকের বিধান ইত্যাদি) এবং নামাযের ফরয-ওয়াজিব কাজসমূহ সঠিকভাবে পূরণ হতে হবে।
চার মাযহাবের কোনো একটি মাযহাব অনুযায়ী কোনো একটি কাজ আগাগোড়া শুদ্ধ না হলে কাজটি না আপনার মাযহাব অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য হবে, না হবে ভিন্ন সেই মাযহাব অনুযায়ী। অতএব, কষ্ট বা অসুবিধা লাঘব করার জন্য অন্য মাযহাব থেকে সহজ একটি মত বেছে নিলেই হবে না। কাজটি করার আগে ওই বিষয়ে সেই মাযহাবের পরিপূর্ণ বিধিবিধানও ভালোভাবে জেনে নিতে হবে।
আশা করি, আপনাদের অনেকের মনে এতদিন ধরে এই বিষয়ে যে দ্বিধা ছিল তার অবসানে আজকের সংক্ষিপ্ত এই আলোচনাটি কিছুটা হলেও চিন্তার খোরাক জোগাতে পেরেছে।