মত প্রকাশের স্বাধীনতা
Advertisements

কেউ যদি আমার কাছে খুব ব্লাসফেমাস কোন কথা বলে আমি হয়তো কষ্ট পাবো, প্রতিবাদ করবো, বুদ্ধিবৃত্তিক জবাব দেবো, কিন্তু ভায়োলেন্স করবো না। কারণ আমার সেই কালচারাল সফিস্টিকেশন আছে, বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতাও সামান্য হলে আছে।

কিন্তু একজন স্বল্পশিক্ষিত ও সাধারণ প্রান্তিক মুসলমান, যার তেমন বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা নেই… যারা এখনো আপনার অভিজাত ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ ধারণার সাথেও পরিচিত নন, তাদের সামনে আপনি যখন তার বিশ্বাস ও আবেগের সবচেয়ে কেন্দ্রীয় চরিত্র নিয়ে প্রচণ্ড বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, তার প্রতিক্রিয়া কি হবে বলে আশা করেন…??

দেখুন আপনার বিদ্বেষের ভাষা কিন্তু আপাত অর্থে হলেও তার জন্যে খুব চ্যালেঞ্জিং, কারণ এর আপাত যৌক্তিক জবাব তার নেই, কিন্তু আপনার ক্রিটিক তাকে কনভিন্স ও নিশ্চিতভাবে করেনি। তাহলে এক্ষেত্রে তার পক্ষাঘাতগ্রস্ত আবেগ ভায়োলেন্সের ভাষা খুঁজে নেবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়..?

আপনার মত প্রকাশের স্বাধীনতার মূল্যবোধে আপনি বিশ্বাস করেন, এটি হয়তো আপনার একটি ন্যায্য অবস্থান। কিন্তু সমস্যা হলো আপনি একটি ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী ইউরোপীয় মূল্যবোধকে বাংলাদেশের সম্পূর্ণ একটি কালেক্টিভিস্ট সমাজের বাস্তবতা চিন্তা না করেই বেপরোয়া প্রয়োগ করতে চাচ্ছেন, যা আপনার এলিটিস্ট মগজ বুঝতেও নারাজ।

ইউরোপে মানুষ যা ইচ্ছা তা বলতে পারে, কিন্তু এদেশের মানুষ অসভ্য ও ব্যাকওয়ার্ড তাই ধর্ম নিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। এমন টাইপের জনপ্রিয় চিন্তা আসলে দুটো সমাজের ঐতিহাসিক বিবর্তন ও অভিজ্ঞতা, দুটো সমাজের দার্শনিক ভিত্তি এবং গ্রাউন্ড রিয়ালিটি না বুঝে করা অন্যায্য তুলনারই ফলাফল।

এনলাইটেনমেন্ট পরবর্তী ইউরোপে দীর্ঘ সাংস্কৃতিক মগজায়নের ফলে ধর্মকে বর্তমান ইউরোপে যেভাবে ধারণ করা হয়, আর আমরা যেভাবে ধারণ করি, দুটোর সেন্সিটিভিটি কখনোই একইরকম হবে না।

এছাড়া শিল্পবিপ্লব প্রসূত আর্থিক সক্ষমতা এখন ধর্মহীন ইউরোপীয়দের যতোখানি ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী করে তুলেছে, সেখানে ওদের ইশ্বরকে গালি দিলে কার কি আসে যায়…!? আমাদের কালচারালি সেকুলার হয়ে ওঠা আর্বান মিডলক্লাসকেও কিন্তু দেখবেন ব্লাসফেমি নিয়ে ওরা মোটাদাগে মাথা ঘামায় না, ওরা এফবিতে রেস্টুরেন্ট চেকইন নিয়েই ব্যস্ত। কারণ তাদের ইনডিভিজুয়ালিস্টিক জীবনে ধর্ম কোন ম্যাটার না, সিম্পল। ওদের জীবনের বাস্তবতা অনেকটা ইউরোপীয়দের মতোই। ওদের জন্য হয়তো মাসুদা ভাট্টিকে দুশ্চরিত্রা বলা আরো সেন্সিটিভ ইস্যু।

ওদিকে এদেশের বিশাল ধর্মপ্রাণ মানুষ কিন্তু একই রাষ্ট্রের ভেতর সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন বাস্তবতায় বাস করে। ওদের কাছে ধর্ম শুধু গুরুত্বপূর্ণই না, বরং ওদের আত্মপরিচয় ও সোশ্যাল ফ্রেব্রিকের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুহম্মদ নেই মানে ওদের জীবনের ১৬ আনাই নেই।
ইনফ্যাক্ট আধুনিক সভ্যতার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বিকৃতির অবর্তমানে স্টেট অব নেচারে যেকোন সমাজে তাদের বিশ্বাসই গুরুত্বপূর্ণ উপদান। যে বিশ্বাসের ফলেই পুলিশ ও রাষ্ট্রের অবর্তমানেও মানুষ রাতে ঘরের দরজা খুলে ঘুমাতো।

তো সংকটটা এখানেই। আপনি আপনার ইউরোপীয় বোধ মূল্যবোধ দিয়ে একটা ভিন্ন সোসাইটিকে ডিল করছেন। তাদের অফেন্ড করার পর কারো এক্সট্রিম প্রতিক্রিয়ায় কল্লা যাবার পর নিজেই আবার ভিক্টিমের ভেক ধরছেন। আপনি আসলে ভিক্টিম না, আপনি অফেন্ডার। একজন এলিটিস্ট অফেন্ডার। আপনার এই সিভিলাইজিং মিশন চিন্তা আসলে প্রকারান্তরে একটি কলোনিয়াল চিন্তা।

এমনকি এত ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী ইউরোপকেও নিজেদের সোশ্যাল ফ্রেব্রিক টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক প্রশ্নে এমন সেন্সিটিভ হতে হয়। সংবিধান, স্বাধীনতা ইতিহাস এমনকি হলোকাস্ট সেসবের একটি, যেজন্য রাষ্ট্রদোহীতা টাইপ অপরাধের জন্ম নিয়েছে।

Advertisements