ভূমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগরে তুরস্কের পরিকল্পনা ও গ্রীসের বিরোধিতা
Advertisements

এজিয়ান সাগর ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের সাম্প্রতিক কার্যক্রম শুধু তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং তুরস্ক এর মধ্য দিয়ে এজিয়ান সাগর ও ভূমধ্যসাগরে নিজের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করতে চায় এবং সেইসাথে এই দুই সাগরে গ্রীসের অধীনে থাকা সাবেক অটোমান সাম্রাজ্যের দ্বীপগুলো নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায় এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সমুদ্রে ১২ নটিক্যাল রাজনৈতিক সীমা এবং ২০০ নটিক্যাল অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা ও নিশ্চিত করতে চায়। তুরস্কের জন্য যে এসব হাসিল করা এতো সহজ কাজ না, সেটা সিরিয়া ও লিবিয়াসহ বিভিন্ন ফ্রন্টে জড়িয়ে পড়া ও করোনাকালীন অর্থনৈতিক দুরাবস্থার মধ্যে থাকা তুরস্ক ভালভাবেই জানে কিন্তু তারপরেও এই খেলায় তুরস্ক নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে উন্নত, আধুনিক তুরস্ক গড়া ও উদীয়মান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজের আবির্ভূত হওয়ার বাসনা এবং এরদোয়ানের উচ্চাবিলাসীপরিকল্পনার কারণে।

১ম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানরা হেরে গেলে বৃটিশরা অটোমানদের অধীনে থাকা এজিয়ান সাগর ও ভূমধ্যসাগরের ছোট বড় প্রায় ১৫০ টির মতো দ্বীপের মধ্যে ২-৩টি বাদে বাকি প্রায় সবগুলো দ্বীপ সম্পূর্ণ অন্যায্যভাবে গ্রীসকে দিয়ে দেয়। এমনকি তুরস্কের উপকূলের ২ কিলোমিটার এর মধ্যকার দ্বীপ ও গ্রীসকে দিয়ে দেয়। সিয়র্স ও কাস্তেলোরিজিও দ্বীপ বা মেথিস এমনই দুটি দ্বীপ। তুরস্কের মূল ভূখণ্ড থেকে সিয়র্স দ্বীপের দূরত্ব মাত্র ১ কিলোমিটার এবং কাস্তেলোরিজিও দ্বীপ ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। অথচ এসব দ্বীপ গ্রীসের মূল ভূখণ্ড থেকে শতশত মাইপ দূরে। এছাড়াও রোডস, ক্রিট, স্যামোসসহ গ্রীসের দখলে থাকা অসংখ্য দ্বীপ রয়েছে তুর্কি উপকূলের নিকটে।

আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা অনুযায়ী প্রতিটি দেশ তার মূল ভূখণ্ড থেকে সমুদ্রে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত রাজনৈতিক সীমা পায় এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা পায় অথচ অবৈধভাবে গ্রীসের অধীনে থাকা এসব দ্বীপের কারণে তুরস্ক ২-৩ নটিক্যাল মাইলের বেশি রাজনৈতিক সমুদ্রসীমা পাচ্ছেনা, এবং অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমাও নিশ্চিত করতে পারছেনা, যা একটি রাষ্ট্রের প্রতি স্পষ্ট জুলুম। ১৯২৩ সালে চাপিয়ে দেয়া লুজানে চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ককে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সবদিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে রাখে। দিন পাল্টেছে। তুরস্ক এখন এসব জুলুমের অবসান চায় এবং নিজের অধিকার আদায় করে নিতে চায়। কিন্তু এজিয়ান সাগর ও ভূমধ্যসাগরে তুরস্ককে কোনো সুবিধা দিতে চায়না গ্রীস ও তার মিত্র আফ্রিকা লুটেপুটে খাওয়া ফ্রান্স। তুরস্কের বিরুদ্ধে গ্রীসকে সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করছে ভাড়াটে ফ্রান্স, গ্রীসের সাথে নৌমহড়া করছে।

ভূমধ্যসাগরে রাফায়েল যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন করেছে। ফ্রান্স কোনভাবেই ইউরোপের দৌড়গোড়ায়, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্কের উত্থান মেনে নিতে পারছে না। তার সাম্প্রতিক নজির আমরা লিবিয়া, ভূমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগরে ফ্রান্সের কর্মকাণ্ডে দেখতে পাই। এই ইস্যুতে গ্রীস, ফ্রান্সের সাথে যোগ দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন ইসরায়েল নামে খ্যাত সংযুক্ত আরব আমিরাত। আমিরাত গ্রীসের সমর্থনে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ও পাঠিয়েছে গ্রীসে। তুরস্ক চাচ্ছে ২০২৩ সালে লুজানে চুক্তির মেয়াদ শেষে গ্রীসের অধীনে থাকা সাবেক অটোমান সাম্রাজ্যের এই দ্বীপগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে। সেজন্য তুরস্ক গ্রীস ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আলোচনায় বসার আহবান জানায়, যাতে করে তুরস্ক দ্বীপগুলো ও সমুদ্রসীমা নিয়ে দরকষাকষির সুযোগ পায়। একথা গ্রীস, ফ্রান্স কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভালো করেই জানে যে আলোচনায় বসলে অনেক দ্বীপই তুরস্ককে হস্তান্তর করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অনুযায়ী তুরস্কের দাবিকৃত সমুদ্রসীমা ও মেনে নিতে হবে।

সেজন্য তারা আলোচনায় না বসে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক তুরস্কের উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু এরদোয়ান ও দমে যাওয়ার পাত্র নন। তুরস্ক বলছে, আলোচনায় না বসলে তুরস্ক জানে কিভাবে শক্তি প্রয়োগ করে নিজের অধিকার আদায় করে নিতে হয়। তুর্কি ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াদ আক্তে আরও এক ধাপ সামনে গিয়ে বলেন, তুরস্ক এজিয়ান সাগরে অবেৈধভাবে দখলকৃত গ্রীসের দ্বীপগুলো দরকার হলে নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করবে, যুদ্ধ করে হলেও। আর তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগ্লু বলেন, তুরস্ককে ভূমিতে আটকে রাখার এই অবৈধ মানচিত্র দরকার হলে তুর্কি জনতা ছিঁড়ে ফেলবে। ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগোলের মধ্যে আমি কোন যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখিনা। কারণ, ন্যাটোর ২য় বৃহত্তম সামরিক শক্তি তুরস্ককে হারালে ন্যাটো দূর্বল হয়ে যাবে। তখন তুরস্ক আরও বেশি রাশিয়া ও চীনের দিকে ঝুকে পড়বে। এটা যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি বা ন্যাটোর অন্য সদস্যরাও চাইবেনা।

তবে সীমিত আকারের ছোটো খাটো কনফ্লিক্ট, বলপ্রয়োগনীতি ও হুমকি ধামকি দিয়ে তুরস্ক গ্রীসকে আলোচনার টেবিলে আসতে বাধ্য করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। কারণ, আলোচনার টেবিল বা ছোটো খাটো কনফ্লিক্ট সবজায়গায় তুরস্ক সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। এক্ষেত্রে তুরস্ক কাতার, ইতালি, আজারবাইজান ও স্পেনকে পাশে পাবে।

শেষ পর্যন্ত এরদোয়ান কি পারবেন অটোমান সাম্রাজ্যের দ্বীপগুলো পুনরুদ্ধার করতে এবং সমুদ্রে তুরস্কের ন্যায্য হিস্যা আদায় করে নিতে? নাকি চারদিক থেকে অপেক্ষায় থাকা শত্রুদের অব্যাহত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে টালমাটাল হয়ে পড়বে এরদোয়ানের ক্ষমতার মসনদ? সেটা জানার জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

লেখকঃ শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

Advertisements