উপমহাদেশের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, বহু ভাষাবিদ, বিশিষ্ট শিক্ষক ও দার্শনিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ৫২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ । ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন । তাঁর আবাসস্থল ছিল পুরান ঢাকার বেগম বাজার। তাঁর কবর মুসা খাঁ মসযিদ এর সামনে অবস্থিত। যেটা শহিদুল্লাহ হলের সামনে ।
ভাষাতত্ত্বে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন উপমহাদেশের একজন স্বীকৃত ও সর্বজনমান্য পন্ডিত ব্যক্তি। প্রাচীন ও আধুনিক ভাষাসমূহের ইতিহাস, উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে তাঁর মতামতকে সকলে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ভাষাতত্ত্বের গবেষণায় তিনি শুধু উপমহাদেশেরই নয়, প্রাচ্য-গবেষকদের মধ্যেও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর গবেষণা ও মতামত বিশ্ব-বিদ্বজ্জন মহলে বিশেষভাবে সুপরিচিত ও সমাদৃত। ভাষার ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রচলিত মত মেনে নিয়েও যুক্তিসংগত কারণে তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। স্যার জন গ্রীয়ারসন, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং আরো অনেকের মতে, মধ্য-ভারতীয় আর্য ভাষার মধ্য স্তর মাগধী প্রাকৃত থেকে মাগধ অপভ্রংশ এবং তা থেকে প্রাচীন ‘বঙ্গকামরূপী’ ভাষার উদ্ভব। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষাগত বিবর্তন ও বৈয়াকরণিক লক্ষণাদি বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বাংলা ভাষার জন্ম মাগধী প্রাকৃত ও মাগধ অপভ্রংশ থেকে নয়, বরং প্রাকৃত স্তরে গৌড়ী প্রাকৃত নামে যে ভাষা প্রচলিত ছিল, সে গৌড়ী প্রাকৃত থেকে গৌড় অপভ্রংশ ভাষার জন্ম এবং তা থেকে কালক্রমে বঙ্গকামরূপী ভাষার উদ্ভব ঘটে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এ মত প্রায় সকলেই যুক্তি-যুক্ত বলে মনে করেন।
ইসলামকে অতিক্রম করে তিনি বাঙালিত্বকে মাথার মুকুট করতে চেয়েছিলেন । বাঙালিত্বের আড়ালে মুসলমানিত্বকে লঘু করা,রাজনীতি-সংস্কৃতির জায়গায় ইসলামকে কেন্দ্র থেকে প্রান্তে নিয়ে যাওয়া,বাঙালিত্বের আড়ালে কলকাতা কেন্দ্রিক বাবুদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে নিজেদের ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা-এসব কাজ ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর হাত ধরেই শুরু হয়েছে
বাংলা ভাষার ইতিহাস রচনায় ডক্টর শহীদুল্লাহর অবদান অসামান্য। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎপত্তি ও বিকাশে মুসলমানদের ঐতিহাসিক অবদান সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু হিন্দু ঐতিহাসিকগণ অনেকে এতকাল পর্যন্ত ইচ্ছাকৃতভাবে এ ইতিহাস বিকৃত করেছেন, সত্য চাপা দিয়েছেন এবং মুসলমানদের অবদানকে বিকৃত বা অবমূল্যায়িত করেছেন। ডক্টর শহীদুল্লাহ এক্ষেত্রে সত্যসন্ধ গবেষকের দৃষ্টি নিয়ে অনেক অজানা, ভুলে যাওয়া এবং বিকৃত তথ্যের সঠিক মূল্যায়ন ও যথাযথভাবে তা উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছেন।
ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বিখ্যাত ভাষাবিদ,প্রখ্যাত পণ্ডিত এবং খুব উচ্চ শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ধর্ম-চেতনা,সংস্কৃতি-চেতনা ও রাষ্ট্র চেতনার মধ্যে ভয়ঙ্কর পরস্পর বিরোধিতা কাজ করেছে । তিনি একদিকে মিলাদ পড়াতেন,তাবিজ-কবজে তার আগ্রহ ছিল,ছাত্রদের নামাজ-রোজার পরামর্শ দিতেন,ছাত্রীদের মাথায় কাপড় দিতে বলতেন,ছবি আঁকা ও তোলাকে নাজায়েজ হিসেবে মনে করতেন,ফুরফুরা পীরের তিনি খলিফা ছিলেন । অন্যদিকে তিনি বাঙালি মুসলমান ছেলে-মেয়েদের জন্য বাংলা নামের পক্ষপাতী ছিলেন । নিজের ছেলে তকিয়ুল্লাহ ও বশিরুল্লাহ(মুর্তজা বশীর)কমিউনিস্ট পার্টি করলেও তার কোনো নীতিগত প্রতিক্রিয়া ছিল না এবং সরদার ফজলুল করিম আমি সরদার বলছি গ্রন্থে লিখেছেন,কমিউনিস্ট পার্টির সাথে তাঁর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল ।
করোনা মহামরি, রাজনৈতিক ও দার্শনিক পর্যবেক্ষণ
এছাড়াও ইসলামকে অতিক্রম করে তিনি বাঙালিত্বকে মাথার মুকুট করতে চেয়েছিলেন । বাঙালিত্বের আড়ালে মুসলমানিত্বকে লঘু করা,রাজনীতি-সংস্কৃতির জায়গায় ইসলামকে কেন্দ্র থেকে প্রান্তে নিয়ে যাওয়া,বাঙালিত্বের আড়ালে কলকাতা কেন্দ্রিক বাবুদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে নিজেদের ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা-এসব কাজ ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর হাত ধরেই শুরু হয়েছে । এ কারণেই এদেশের বাংলা পূজারীরা ডক্টর শহীদুল্লাহকে নায়ক হিসেবে স্তব-বন্দনা করেন । নায়ক তিনি হতেই পারেন । কিন্তু তার মতো নায়কদের প্ররোচণার কারণেই বাঙালি মুসলমানের জাতিসত্তা আজ এক রক্তাক্ত বিভাজনের উপত্যকায় গড়াগড়ি খাচ্ছে ।
শিখা আন্দোলনের নেতা কাজী মোতাহার হোসেন,ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক,কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখের সাথে তিনিও ভাষা ও আঞ্চলিকতার আড়ালে মুসলিম জাতিসত্তাকে মোকাবিলা করার জন্য কংগ্রেসের পুরানো যুক্তিগুলোকেই ফিরিয়ে আনেন । পাকিস্তান হয়েছিল ভাষা ও নৃতাত্ত্বিকতা নির্বিশেষে সারা ভারতের মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আইডেন্টিটি ইসলামের ভিত্তিতে । ডক্টর শহীদুল্লাহ ও তার মতো পণ্ডিতরা বাঙালিত্বের আড়ালে যখন সারা ভারতের মুসলমানদের এই এজমালি ভ্রাতৃত্বকে অস্বীকার করলেন তখনই গোলযোগটা শুরু হলো।
একদা ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাঙালি মুসলমানের নাম বাংলায় রাখাতে আহ্বান করেন । এ কথা শুনে রবীন্দ্রশিষ্য কাজী আবদুল ওদুদ শহীদুল্লাহর বাংলা নাম”আচার্য বলিরাম” রাখার প্রস্তাব করেন ।
সহায়ক কিতাব সমূহ:
১.ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-বশীর আল হেলাল
২.আমি সরদার বলছি-সরদার ফজলুল করিম .
৩.ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ স্মারকগ্রন্হ-বাংলা একাডেমী
৪.আ মরি বাংলা ভাষা-ফাহমিদ-উর-রহমান ।