ময়মনসিংহের ভালুকা এখন শিল্পের শহর। বেশ কয়েক বছর ধরে গড়ে উঠছে শত শত শিল্পকারখানা। শিল্পকারখানা গড়ে উঠাকে কেন্দ্র করে হাজী সালাউদ্দিন নামের এক ভূমিদস্যুর অবাধ বিচরণ বেড়েছে কয়েক দশক ধরে। একক আধিপত্য বিস্তারে উপজেলার হবিরবাড়ী ইউনিয়নসহ পুরো উপজেলাজুড়ে তিনি গড়ে তুলেছেন বিশাল বাহিনী। রয়েছে নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা ও টর্চার সেল। এভাবে পুুরো ভালুকায় অপরাধ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ তার হাতে। নিজের জমি বাঁচাতে গিয়ে সালাউদ্দিন বাহিনীর বলিরপাঁঠা হন দুজন জমি মালিক। সালাউদ্দিন বাহিনীর কাছে স্থানীয় এমপি, চেয়ারম্যান যেন হিসাবের বাইরে। সরকারের মন্ত্রী ও প্রভাবশালীদের নাম ব্যবহার করায় রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাহিরে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে-জমিদখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ এ বাহিনীর নানা অপকর্মে জিম্মি হয়ে পড়েছে হবিরবাড়ী এলাকার নয়াপাড়া, খন্দকারপাড়াসহ আশপাশের এলাকার লোকজন। এলাকার অর্ধশতাধিক পরিবারের শত বিঘা জমি জোর করে দখলে নিয়েছে সালাউদ্দিন বাহিনী। এ বাহিনীতে রয়েছে দুই শতাধিক ভাড়াটে মাস্তান ও সন্ত্রাসী। এদের অধিকাংশই ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও ও ত্রিশাল এলাকার চিহ্নিত অপরাধী বলে জানা গেছে। এ বাহিনীর নজর যার জমির ওপর পড়েছে, সেই জমি ও পরিবারকে নিঃস্ব করেছে। এ বাহিনীর কাছে শুধু সাধারণ মানুষই যে জিম্মি, তা নয়। জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও তাদের থাবা থেকে রেহাই পাননি! পুরো উপজেলায় তাদের অবাধ বিচরণ হলেও ভালুকার হবির বাড়ী ইউনিয়নে এ বাহিনীর তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। এভাবে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ী ইউনিয়নে চলছে এক সময়ের বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের কৃষক দলের নেতা সালাউদ্দিন বাহিনীর রামরাজত্ব। সালাউদ্দিন ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মোর্শেদ আলমের ভগ্নিপতি। তার আপন ভাই, ইঞ্জিনিয়ার মহিউদ্দিন। সাবেক জেলা আওয়ামী লীগের প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করায় দল তাকে বিগত উপজেলা নির্বাচনের সময় বহিষ্কার করে।
জানা গেছে, জমি দখল প্রধান টার্গেট হলেও এলাকার রাজনীতি, ঝুট, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, বখরা আদায় থেকে শুরু করে সামাজিক বিচার-আচার সবকিছুই তার কব্জায়। এসব করে সালাউদ্দিন এখন শত কোটি টাকার মালিক। গড়েছেন অভিজাত বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, জায়গা-জমিসহ বিপুল বিত্তবৈভব।
ভয়ংকর এই বাহিনীর নিজস্ব টর্চার সেল রয়েছে। জমির মালিকদের কাছ থেকে আপসে জমি লিখে নিতে সব রকম কলাকৌশলে ব্যর্থ হলে তাদের টর্চার সেলে নিয়ে করা হয় নির্মম নির্যাতন। চলে পাশবিক নির্যাতন। টর্চার সেলের অবস্থান নপাড়ায় তার পোলট্রি ফার্মে। এলাকায় কেউ তার কাজে বাধা সৃষ্টি করলে টর্চার সেলে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন করা হয়। টর্চার সেলে নির্যাতনের স্বীকার নুরুল আলম ওরফে নুরু যুগান্তরকে বলেন, আমার মূল্যবান সাড়ে ১০ শতাংশ জমি আমি বিনা টাকায় লিখিত না দেওয়ায় আমাকে টর্চার সেলে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন করে। পরে সাদা স্টাম্পে জোর করে স্বাক্ষর নিয়ে জমি লিখে নিয়েছে। বর্তমানে সেই জমি স্বপ্ন নামের একটি সুপারশপ কোম্পানিকে ভাড়া দিয়েছে। স্থানীয় ভুক্তভোগীরা যুগান্তরকে জানান, রাতের আঁধারে অবৈধ গুলির শব্দে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে জমি দখল ও বাড়িঘর উচ্ছেদ করে রাতারাতি সীমানা তৈরি করা এ বাহিনীর কাজ।
সালাউদ্দিন বাহিনী এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে জমি হারানোর সঠিক হিসাব নেই তবে বিগত দুই বছরে যাদের জমি এ বাহিনী দখল করেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো-জামির দিয়া এলাকার মুজিবুর রহমান, নুর মোহাম্মদ, মনির, মৃত হাসমত, বাইস্যা মিস্ত্রি, আবুল কাশেম। এছাড়া খন্দকার পাড়ার মোকাদ্দেস খন্দকার, হবির বাড়ীর সোহরাব ও মাস্টার বাড়ির আব্দুর রহমান, আলী আসাদ, হালিমা। তারা জমি হারিয়েও এ বাহিনীর আতঙ্কে রয়েছে। ভয়ে জীবন বাঁচাতে অনেকে এলাকাও ছেড়েছেন বলে জানা গেছেন। অভিযোগ আছে-হেলাল উদ্দিন, শামসুদ্দিন, নাজিম উদ্দিন, সেন্টু মিয়া, আজিদ মিয়া, একাব্বার, নবী হোসাইন, নুরু মিয়াসহ প্রায় ৩৫টি রাতের অন্ধকারে নিজস্ব বাহিনী দিয়ে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়েছে। অনেকে পৈতৃক শেষ সম্বল হারিয়ে দিশেহারা। অথচ তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।
এ ব্যাপারে হবির বাড়ী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য খলিল আহমদ জানান, বাহিনী প্রধান হাজী সালাউদ্দিন খুবই ভয়ংকর মানুষ, ঘোষণা দিয়ে লোকজনের জমি দখল করে নেন। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে টর্চার সেলে নিয়ে বাহিনীর লোক দিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। এজন্য সবাই আতঙ্কে থাকেন। চেয়ারম্যান এমপি কাউকে পাত্তা দেয় না সে।
ভুক্তভোগী ও এলাকাবাসী জানান, ওই এলাকায় জমি দখল নিয়ে বিরোধে এখন পর্যন্ত লাশ পড়েছে ২টি। সর্বশেষ প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় স্থানীয় জমির মালিক নুর আলমকে। সালাউদ্দিন বাহিনীর দখলবাজির বলি হন আলম। তারা জানান, সালাউদ্দিন এলাকার সরকারি, খাস ও অন্যের জমি জোরপূর্বক দখলে নিয়ে সনি নিবাস প্রজেক্ট গড়েছেন। প্রথমে তিনি ন্যায্য দামের চেয়ে অর্ধেক দামে জমি কেনার প্রস্তাব দিতেন। প্রস্তাবে সাড়া না দিলে হামলা, তারপর মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করতেন। তাতেও কাজ না হলে খুন করতেও দ্বিধা করতেন না সালাউদ্দিন। এসব অপকর্মের জন্য তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন ক্যাডার বাহিনী। এসব বিষয়ে পুলিশে অভিযোগ করলেও কোনো লাভ হয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত সালাউদ্দিন বাহিনীর প্রধান সালাউদ্দিন জানান, আমার নামে আনীত অভিযোগ সঠিক নয়। আমি কারও জমি দখল করিনি। আপনার টর্চার সেলে নির্যাতনের স্বীকার হয়ে মাজেদা বেগম নামের একজন মহিলা ও কাজলের বসতভিটা উচ্ছেদকালে কাজল ও তার স্ত্রী স্ট্রোক করে মারা গেল কেন? আর মাস্টারবাড়ি স্বপ্ন সুপার শপ নুরুর কাছ থেকে কত টাকায় কিনেছেন, এ জমির আসল মালিক কে এবং আপনার নিজস্ব বাহিনীতে কতজন সদস্য? আপনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কোন নেতার প্রভাব বিস্তার করে রাতে অস্ত্রের মহড়া নিয়ে জমি দখল করেন-এমন অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, সঠিক নয়। আমার নামে একটা পক্ষ ষড়যন্ত্র করছে। তাহলে আপনি এতো মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ কেন আপনাকে কখনো আটক করেনি? উত্তরে তিনি বলেন, আমি সব মামলায় জামিনে আছি।
সূত্রঃ যুগান্তর