উপমহাদেশে ইংরেজ বিরোধী আজাদী সংগ্রাম শুরু হয় প্রকৃতপক্ষে ১৮০৩ সালে। সাইয়্যিদ আহমদ শহীদের নেতৃত্বে ১৮৩২ সালে তা প্রত্যক্ষরূপ ধারণ করে।
মুসলমানদের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালিত হতো শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তা ও দর্শনের আলোকে।
এই বিপ্লব সংগ্রাম কয়েকটি স্তরে বিভক্ত ছিলো-ক. শাহ ওয়ালিউল্লাহ থেকে ঐতিহাসিক বালাকোট পর্যন্ত, খ. বালাকোট থেকে ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম (সিপাহী বিপ্লব) এবং দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত,গ. ১৮৫৭ থেকে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা অর্জন বা দেশভাগ পর্যন্ত।
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের পর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বেনিয়ারা নড়েচড়ে বসে। ঔপনিবেশিক শাসন দীর্ঘমেয়াদী করতে রোমান শাসকদের মতো তারা ‘ডিভাইড এন্ড রুলস’ পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
এই প্ল্যানের আলোকে তারা কয়েকটি কর্মপন্থা হাতে নেয়-
ক. ইলিয়ট, ডওসন, এলফিনস্টোন এবং ব্রিগের মতো প্রশাসকদের দ্বারা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতবর্ষের মুসলিম শাসনামলের বিকৃত ইতিহাস রচনা শুরু করে।
খ. বঙ্কিমের মতো কিছু হিন্দু লেখকদের দ্বারা ইসলাম ধর্ম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে সাহিত্য রচনা শুরু করায়।
গ. রাজা রামমোহন রায়, অক্ষয় কুমার দত্ত, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসুদন দত্ত এবং অন্যান্য ব্যক্তিগণ হিন্দু জাতীয়তাবাদের জিগির তোলে, রাজনারায়ণ বসু ‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব’ নামে একটি গ্রন্থ লেখে এবং হিন্দু মেলার আয়োজন করে।
ঘ. স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্ব আলীগড় কেন্দ্রিক অনুগত মুসলিম বুদ্ধিজীবী তৈরী করে। আব্দুল লতিফ এবং সৈয়দ আমীর আলীর দ্বারা পাশ্চাত্যের মডেলে মুসলিম সাহিত্য ও ইতিহাস রচনা করে। (শান্তিময় রায়,ভারতের মুক্তি সংগ্রাম ও মুসলিম অবদান,পৃ.৩৫)
সুতরাং ১৮৬০ সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ইংরেজরা হিন্দু- মুসলিম অনুগত বু্দ্ধিজীবী তৈরী করে। তারাই পরবর্তীতে ‘হিন্দু মহাজন সভা’ ও ‘মুসলিম লীগ’ গঠন করে এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে ১৯৪৭ সালে দেশভাগকে অনিবার্য করে তোলে।
তবে ১৮৫৭ সালের পর শাহ ওয়ালিউল্লাহর আদর্শের সৈনিকেরা ব্রিটিশদের পাতা ফাঁদে পা রাখে নি। বরং তারা শামেলির ময়দান থেকে ফিরে গিয়ে বিপ্লব, সংগ্রাম ও স্বাধীনতা আন্দোলনের পন্থা ও পদ্ধতি পরিবর্তন করে।
অধ্যাপক শান্তিময় রায়ের ভাষায়- ‘শামেলি এবং দেওবন্দ বস্তুতপক্ষে একই চিত্রের দুটি দিক। তফাতটা কেবল অস্ত্র মাধ্যমের বর্তমান লেখনী ও রসনা তরবারি ও বল্লমের জায়গা নিয়েছে মাত্র; শামেলিতে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সংস্কৃতিক স্বাধীনতা লাভের জন্য স্বশস্ত্র অভ্যুত্থানের পথ গ্রহণ করা হয়েছে, আবার দেওবন্দে একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য শান্তিপূর্ণ উপায় অবলম্বন করা হয়েছে। দুটি পথ যদিও পরস্পর থেকে ভিন্ন, তথাপি উভয়ের লক্ষ্য ছিল অভিন্ন।’ (ভারতের মুক্তি সংগ্রাম ও মুসলিম অবদান,পৃ.৩৫)
শাহ ওয়ালিউল্লাহর দর্শন ও আদর্শের পাদপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দের যে সব সূর্য সন্তান ভারতের স্বাধীনতার জন্য ত্যাগ, কোরবানি করেছেন এবং জীবনবাজি রেখেছেন, স্বাধিকার সংগ্রামের সে সব বীর সেনানীর মধ্যে মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী অন্যতম।
দেওবন্দের এই রুহানি সন্তান দেশের আজাদী সংগ্রামের জন্য সুদীর্ঘ ২৫ বছর স্বেচ্ছায় নির্বাসিত জীবনযাপন করেন। শায়খুল হিন্দ তাকে যে দায়িত্ব অর্পন করেছিলেন তা তিনি অত্যন্ত বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে পালন করেছিলেন। যদিও এর পদে পদে ছিল বিপদ, ভয় আর জীবনাশঙ্কা।
মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী ১৮৭২ সালের ১০ মার্চে পাঞ্জাবের শিয়ালকোট জেলায় এক শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১২ বছর বয়সেই জনৈক মুসলিম সহপাঠীর থেকে ‘তুহফাতুল হিন্দ’ এবং শাহ ঈসমাইল শহীদের ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’ পাঠ করে তার অন্তরে ইসলামের প্রতি আগ্রহ তৈরী হয়।
১৬ বছর বয়সে তিনি মা বোন এবং পরিবার পরিজন সবকিছু ছেড়ে ইসলামের জন্য বেড়িয়ে পড়েন। সিন্ধু প্রদেশে এসে এক বুযুর্গের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত তার দরবারে থেকে আধ্যাত্মিক সাধনা করেন।
এরপর তিনি দ্বীনি শিক্ষার জন্য দারুল উলুম দেওবন্দে আসেন এবং শায়খুল হিন্দের কাছে তাফসীর, হাদীস,ফিকাহ্ এবং দর্শনে বূৎপত্তি অর্জন করেন। (বাংলা একাডেমি, মওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধীর রোজনামচা)
পড়ালেখা সমাপনীর পর মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী লাহোরে ফিরে গিয়ে অধ্যায়ন ও গবেষণায় লিপ্ত হোন। এর মধ্যে তিনি হাদীসের প্রসিদ্ধ ১০-১২টি গ্রন্থ মুখস্থ করেন এবং ইলমে হাদীস ও হানাফি ফিকাহ্ সম্পর্কে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন।
১৯০৯ সালে শায়খুল হিন্দ তাকে আবার দেওবন্দে ডেকে পাঠান এবং দেওবন্দের সমাপনী ছাত্রদের দ্বারা ‘জমিয়তুল আনসার’ সংগঠনের দায়িত্ব প্রদান করেন।
শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিতে ১৯১৩ সালে দিল্লীর ফতেহপুর মসজিদে ‘নাযযারাতুল মা’আরিফ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক শায়খুল হিন্দ ছাড়াও হাকিম আজমল খান এবং নওয়াব ভিকারুল মুলক ছিলেন।
এ সময় শায়খুল হিন্দ তাকে দিল্লীর অন্যান্য বিপ্লবী সংগঠক ড. আনসারী এবং তার মাধ্যমে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও মাওলানা মুহাম্মাদ আলীর সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেন। (মুহাম্মাদ সারওয়ার, মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী,লাহোর ১৯৬৪,পৃ.২৯)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময় দেওবন্দে শায়খুল হিন্দের বাসায় বিপ্লবীদের একটি মিটিং হয়।
মিটিংয়ে এ সিদ্ধান্ত হয় যে,১৯১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দিল্লীতে অভ্যুত্থান ঘটানো হবে এবং চুক্তি সাক্ষর করে তুর্কি ও আফগান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য উবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
এই সিদ্ধান্ত ইতিহাসে রেশমি রুমাল নামে খ্যাত হয়ে আছে। উবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে আফগানিস্তানে গিয়ে একটি সেনাবাহিনী গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ইংরেজ গোয়েন্দারা এসময় মাওলানা মুহাম্মাদ আলী, মাওলানা শওকত আলী এবং মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতার এড়িয়ে শায়খুল হিন্দ হেযাযের পথে এবং উবায়দুল্লাহ সিন্ধী কাবুলের পথে দুটি বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯১৫ সালে হিজরত করেন। (আবুল ফাতাহ মুহা: ইয়াহইয়া, দেওবন্দ আন্দোলন,পৃ.২০১)
মুহাম্মাদ আহমদ আলী, ফাতেহ মুহাম্মাদ এবং আব্দুল্লাহ এই তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে উবায়দুল্লাহ সিন্ধী বেলুচিস্তান ও ইয়াগিস্তান হয়ে কাবুল পৌছেন। সেখানে গিয়ে তিনি শায়খুল হিন্দের ছাত্রদের ও স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দের একত্র করেন।
আফগান বাদশাহ আমীর হাবিবুল্লাহ তাকে হিন্দুদের সঙ্গে নিয়ে এক প্লাটফর্মে কাজ করার নির্দেশ দেন। ১৯২২ সালে তিনি কংগ্রেসের কাবুল শাখা গঠন করেন এবং এটিই ছিল বহির্বিশ্বে কংগ্রেসের প্রথম শাখা।
সিন্ধী ছিলেন এই শাখার প্রথম প্রেসিডেন্ট। তুর্কি-জার্মান মিশনের প্রতিনিধি রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ ও বরকতুল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ‘অস্থায়ী ভারত সরকার’ গঠন করেন।
রাজা সাহেব রাষ্ট্রপতি, রবকতুল্লাহ প্রধানমন্ত্রী এবং উবায়দুল্লাহ সিন্ধী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বাচিত হোন। মাওলানা সিন্ধী ‘জুনদুল্লাহ’ নামে একটি সেনাবাহিনীও গঠন করেন। ইরান,জার্মান,রাশিয়া, তুরস্ক প্রভৃতি দেশে এই সরকারের প্রতিনিধি প্রেরণ করেন।
ঐতিহাসিক রেশমি রুমাল ইংরেজ গোয়েন্দাদের হাতে পরলে ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে আমীর হাবিবুল্লাহ তাকে বন্ধি করেন আর শায়খুল হিন্দকে মক্কার শরীফ সরকার গ্রেফতার করে। আমীর নাসরুল্লাহ খানের আমলে মুক্তি মিললেও আন্তর্জাতিক চাপে তাকে কাবুল ত্যাগ করতে হয়।
এরপর তিনি মস্কো হয়ে তুরস্কে গমন করেন। সাত মাস মস্কোতে অবস্থান করে কমিউনিজমের ওপর গবেষণা করেন। এরপর তিনি ইস্তাম্বুল হয়ে মক্কায় পৌঁছান।
মস্কো ও ইস্তাম্বুল সফরে তিনি কমিউনিজমের উত্থান এবং কামাল পাশা কর্তৃক ইসলামি খেলাফত ধ্বংস স্বচক্ষে দেখতে পান। মক্কায় দশ বারো বছর অবস্থান করে ইবন সৌদের শাসনামল দেখার সুযোগ হয়।
এসময় তিনি শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর রচনাবলি গভীরভাবে অধ্যায়ন করেন এবং ‘ইমাম ওয়ালিউল্লাহ কি হিকমত কা ইজমালি তা’আরুফ’, ‘হিজবু ইমাম ওয়ালিউল্লাহ দেহলবি কি ইজমালি তারিখ কা মুকাদ্দিমাহ’ গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন।
মক্কায় নির্বাসিত তুর্কি আলেম মূসা জারুল্লাহ্ উবায়দুল্লাহ সিন্ধীর তাফসির সংকলন করে প্রকাশ করেন। আততামহীদ লি আইম্মাতিত তাজদীদ এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহ রুকআত বা পত্রাদির একটি ভূমিকা লেখেন। (ই.ফা.বা.,ইসলামী বিশ্বকোষ,খন্ড-৫, পৃ.৬২৩)
মাওলানা সিন্ধী ১৯৩৯ সালে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘শাহ ওয়ালিউল্লাহ তার বৈপ্লবিক রাজনীতিতে জাহের ও বাতেনের রক্ষক ছিলেন আর শায়খুল হিন্দ ছিলেন রাহবার।’
বিশিষ্ট মুফাসসির মাওলানা আহমদ আলী লাহরী ও মাওলানা আব্দুল হাই ফারুকী মাওলানা সিন্ধীর নিকট তাফসীরের ইলম অর্জন করেছেন।
১৯৪৪ সালের ২২ আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলের এই বীর সেনানী ইন্তিকাল করেন। স্বাধীনতার এই মহান নেতাকে ভারত কী আজ মনে রাখবে?
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক