ভারতীয় সিনেমা কার্টুনে ইতিহাস বিকৃতি
Advertisements

ভারতীয় কার্টুনের মধ্যে অন্যতম একটি চরিত্রের নাম ‘শিবা’। এই কার্টুনটি বাংলাদেশ এবং ভারতে এতোই জনপ্রিয় যে শিবা রীতিমত অনেক বাচ্চার স্বপ্নের নায়কের স্থান করে নিয়েছে। হিন্দি ভাষায় নির্মিত কার্টুনটিতে শিবাকে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে,কোমলমতি শিশুদের মনে শিবা একজন আদর্শ বীর,সমরনায়ক,সুকৌশলী হিসেবে গেঁথে গেছে। আসলেই কী ইতিহাসে শিবা(শিবাজী) একজন আদর্শ বীর, সমরনায়ক ছিলেন?

১৫৬৫ সালে দক্ষিণ ভারত দিল্লীর মুঘোল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূত হয়। সেই থেকে মারাঠাগণ দিল্লীর বিভিন্ন সুলতানদের অধীনে কাজ করতো। আলোচ্য শিবা(শিবাজী)’র ভোসলে পরিবার প্রথমে নিজাম শাহী সুলতান এবং পরে বিজাপুরের আদিল শাহী সুলতানের অধীনে চাকরি করে এবং বেশ প্রতিপত্তি অর্জন করে। যদিও পূর্বে তারা কৃষিকর্ম করেই জীবন ধারণ করতো।

বাদশাহ আলমগীরের রাজত্বকালে দাক্ষিণাত্যে এই মারাঠা বা বর্গী জাতির উত্থান হয়। যারা দস্যুবৃত্তিতে ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে। রাতের অন্ধকারে অগ্নিসংযোগ করে জনসাধারণের ধন-দৌলত, অর্থ-গহনা লুট করে পালিয়ে যেতো। কার্টুনে প্রদর্শিত ‘শিবা’ বা শিবাজী ছিলো এই মারাঠা বর্গী দস্যু বাহিণীর একজন দলনেতা। তাদের অত্যাচার, নির্মমতা এমন চরম পর্যায় পৌছে ছিলো যে,গ্রামীণ লোকগাথায় স্থান করে নিয়েছিলো। বাংলার মায়েরা তাদের বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে গাইতেন,’ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো,বর্গি এলো দেশে…’।

শিবাজী ও তার মারাঠা দস্যু বাহিনী বাদশাহ আলমগীরের সেনাপতি আফজাল খানের হাতে বার বার বন্দি হয়েছে আর সন্ধি করে ও মুচলেকা দিয়ে মুক্ত হয়ে পরে আবারও দস্যুবৃত্তি আর লুটতরাজে লিপ্ত হতো। অথচ আজ ভারতীয় কার্টুন দেখে মুসলিম পরিবারের অনেক শিশু এই দস্যু,বিশ্বাসঘাতক, ‘পাহাড়ী ইঁদুর’কে আদর্শ বীর মনে করে থাকে।

মারাঠা এই দস্যুকে সর্বপ্রথম ‘মহান’ করার চেষ্টা করেন বঙ্কিম চন্দ্র তার ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে। আর এই আন্দোলনকে উস্কে দেন শ্রী অরবিন্দ। যিনি বঙ্কিম চন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে একটি ‘গুপ্তসমিতি’ করেন। ঐ সমিতির নেতৃত্বে অরবিন্দ ছাড়া আরো ছিলেন লাল(লালা রাজপথ রায়),বাল(বালঙ্গাধর তিলক) আর পাল। প্রথম দিকে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর,জ্যোতিন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন, প্রনথনাথ মিত্র ও সরলা দেবী প্রমূখও এই সমিতির সদস্য ছিলেন।

তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন,’মারাঠা সাথে আজি হে বাঙ্গালী এককন্ঠে বলো,জয়তু শিবাজী'(সঞ্চয়িতা, ৩১২ পৃ.)।
আর এ আন্দোলনের পূর্ণতা আসে বালঙ্গাধর তিলকের হাত ধরে। তিনি ১৯০৪ খৃস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের রাজধানী বোম্বে(বর্তমানে মুম্বাই)তে ‘শিবাজী উৎসব’ পালন শুরু করেন। এই তিলকের হাতেই শুরু হয় ‘গণপতি পূজা’ আর ‘গোরক্ষিণী সভা’। (শ্রী সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, বাঙ্গালির রাষ্ট্রচিন্তা,২৬১-৬২)

ভারতীয় কার্টুন, নাটক-সিনেমাগুলোতে ইতিহাসকে মিথ্যার মিশ্রণে প্রলেপ দেওয়া হয়ে থাকে। মিথ্যা মিশ্রিত সেই ইতিহাসকে জীবন্ত করে তোলা হয়; হৃদয়গ্রাহী করে পেশ করা হয়। যার জ্বলন্ত উদাহরণ বলিউডের পদ্মাবত,রামলিলা-রাসলিলা,বাজিরাও মাস্তানি,যোধাবাঈ,আকবার দ্যা গ্রেট প্রভৃতি সিনেমা-সিরিয়াল। তামিল ‘মাগাদিরা’সহ অসংখ্য ইতিহাস নির্ভর সিনেমা,নাটক ও ধারবাহিকে সুকৌশলে ইতিহাস বিকৃতি ঘটানো হয়। সেখানে দেখানো হয় সুলতান মাহমুদ গজনবি, বাদশাহ আওরঙ্গজেব, শেরশাহসহ অন্যান্য মুসলিম শাসকগণ যাদের দ্বীনের উপর অবিচল আস্থা আর কুরআন-সুন্নাহর পাবন্দি ছিলো, তারা নাকি সকলেই অত্যাচারী শসক ছিলেন। ইসলাম নাকি তরবারির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করেছে। আর আকবরের মতো চরিত্রহীন শাসক( মৃত্যুর সময় যে পাচঁ শতকের অধিক পত্নী-উপপত্নী রেখে গেছেন) কে বলা হয় ‘মহামতি’ আর ‘দ্যা গ্রেট’। এভাবেই ইতিহাসের প্রহসন মঞ্চস্থ করা হয়।

অথচ এই সকল হিন্দি সিনেমা,নাটক,সিরিয়াল আমাদের দেশসহ অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলোতে দিনদিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সৌদি আরবসহ আরব দেশগুলোতে আরবিতে ডাবিং করে সম্প্রচার করা হচ্ছে। যা দেখে মুসলিম শিশুদের মন-মানসিকতা উপর গভীর প্রভাব পড়ছে। পরিবর্তন হচ্ছে তাদের আকিদা-বিশ্বাসে। অজান্তেই তাদের অনেকে বিশ্বাস করছে পৃথিবীর সব কাজকর্ম দেবতারা নিজ ক্ষমতায় আঞ্জাম দেয়। (নাউজুবিল্লাহ্)।

এই সমস্যার সমাধানে আমাদের শিশুদের সঠিক ইতিহাস জানার সুযোগ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। স্কুল,কলেজ,মাদরাসার সিলেবাসকে ঢেলে সাজাতে হবে।কবি বলেন,
‘হৃদয় বদলে যাবে শিক্ষা বদলে গেলে।’

আমাদের মনে রাখতে হবে হযরত ইয়াকুব আ. মৃত্যুর পূর্বে তাঁর সন্তানাদি ও নাতিদের একত্র করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,’আমার মৃত্যুর পর তোমরা কোন জাত ও সত্তার ইবাদত করবে?’ অথচ তিনি নিজে ছিলেন নবী আর তাঁর বংশ ছিলো মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ। রাসূল সা. বলেছেন,’আল-কারিম ইবনুল কারিম ইবনুল কারিম/ইউসূফ ইবন ইয়াকুব ইবন ইসহাক ইবন ইবরাহীম।’

ভারতবর্ষের ইতাহাস জানতে হলে আমাদের নির্মোহ, সঠিক ও নিরপেক্ষ ইতিহাসগ্রন্থগুলো পাঠ করতে হবে। ইংরেজ সরকারের ‘ডিভাইড এন্ড রুলস’ পলিসি বাস্তবায়নে যে সকল ইতিহাস লেখা হয়েছে বা যারা এর বাস্তবায়নে কাজ করেছেন তাদের ইতিহাসগ্রন্থগুলো সিলেবাসভুক্ত করা যাবে না। ভারতবর্ষে মুসলিম ইতিহাসের কিছু মৌলিক গ্রন্থ উল্লেখ করা হলো-

১. ‘তারিখে ফিরোজশাহি’, কাযি জিয়াউদ্দিন বারনি
(সিরাজ আফিফ লিখিত ‘তারিখ ফিরোজশাহি’ নামে ও একটি গ্রন্থ পাওয়া যায়।)
২.’তারিখে ফিরিশতা’,মুহাম্মাদ কাসিম বিজাপুরী
৩.’সিয়ারুল আউলিয়া’ আমির খোদ সাইয়্যিদ মুহাম্মাদ মুবারক (আওলিয়া কেরামের ইতিহাস হলেও সমসাময়িক সমাজ,রাজনীতি ও শাসকদের আলোচনা রয়েছে।)
৪.’মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ’,মোল্লা আব্দুল কাদির বাদায়ূনি
৫.মাআছিরুল কিরাম
৬.আইন-ই-আকবরি
৭.সিয়ারুল আখতার
৮.তাবকাতে নাসিরিয়া
৯.’আসারুস সানাদিদ’ স্যার সাইয়্যেদ আহমদ খান
১০.’তারিখে হিন্দুস্হান’,মৌলবি যাকিউল্লাহ দেহলবি
১১.’তারিখে হিন্দুস্থান’, সাইয়্যেদ হাশিম ফরিদাবাদী
১২. ‘নুজহাতুল খাওয়াতির’ সায়্যিদ আব্দুল হাই লখনবি
১৩.’তারিখে আহদে আকবরি’
১৪. তুযুক-ই-জাহাঙ্গীরী,বাদশাহ জাহাঙ্গীরের আত্নজীবনী
১৫. ইনশা-ই- আকবরি
১৬. যুবদাতুল মাকামাত
১৭.তারিখে মুবারকশাহি,ইয়াহইয়া ইবন আহমদ
১৮. ‘মা’আছিরুল উমারা’ খাফি খান
১৯. ‘তারিখে আদম’

এই গ্রন্থগুলো আরবি,ফারসি ভাষায় রচিত। যেহেতু তখন ভারতবর্ষের সরকারি ভাষা ছিলো ফারসি আর ইসলামিক ভাষা নিঃসন্দেহ আরবি। এই গ্রন্থগুলো অনুবাদ করে বাংলাভাষাভাষিদের জন্য সহজ করে দিতে হবে। কওমী মাদরাসাগুলোতে যেহেতু প্রাথমিক লেভেলে আরবি ভাষার পাশাপাশি উর্দু ও ফারসি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত তাই কওমী মাদরাসার আলেমগণ দ্বীনের এই খেদমতে ভূমিকা রাখতে পারেন।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

Advertisements