মানুষ সামাজিক জীব। কেননা মানুষ একা থাকতে পারে না। তাই নিঃসঙ্গতা সব সময়ই কষ্টের। সমাজ পরিবর্তনের প্রতিটি ধাপেই মানুষ এগিয়েছে উন্নততর জীবনের প্রত্যাশায়। নিজের প্রয়োজনে গড়ে তুলেছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ণ সাফল্য ও চিকিৎসায় প্রযুক্তির উন্নতিতে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে অনেক। আবার মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সম্পদ অর্জন ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে। আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কাছে বলি হচ্ছে মানবতা। ফলে মানুষ হতাশা ও নিঃসঙ্গতায় নিমজ্জিত হচ্ছে।
যে কোনো একটি পরিবারে মানুষ জন্মলাভ করে এবং বড় হয়ে ওঠে। আর যৌবনে নিজেরা পরিবার গড়ে বার্ধক্যে ‘শূন্য বাসায়’ বসবাস করেন। কারণ ছেলেমেয়েরা নিজের কাজে ব্যস্ত সময় পার করে। অন্যদিকে প্রবীণ বয়সে মানুষ সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই জীবন কাটানো খুব কষ্টের। এছাড়া ছেলেমেয়ে না থাকলে প্রবীণদের সংকট বেশি দেখা দেয়। এ সময় আর্থিক সহযোগিতা, ভরণ-পোষণ, চিকিৎসা, সেবা-যত্ন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রবীণ জীবনের শেষের দিনগুলো, বিশেষ করে বয়স ৭০ বছরের পর থেকেই অনেক সমস্যা শুরু হয়। প্রথম আসে আর্থিক সমস্যা। এরপরই আসে নিঃসঙ্গতা। নিঃসঙ্গতা থেকে প্রবীণরা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনতে চান না কেউ। সংসার-সমাজে প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। তাই তারা সামাজিক ও পরিবারিকভাবে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন। তখন ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে।
বর্তমান বিশ্বে মানসিক উদ্বেগ ও চাপ, হতাশা ও বিমর্ষতা, সামাজিক ভীতি, খাদ্যে অনাগ্রহ, নিজেকে শেষ করে দেয়ার মনোভাব এবং চরম একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতা বেড়ে গেছে। মানুষ হচ্ছে অতিমাত্রায় সামাজিক প্রাণী। একই সঙ্গে অতিমাত্রায় অনুভূতিপ্রবণ। সময় যত গড়াচ্ছে ততই এ সমস্যা প্রকট হচ্ছে। সমাজে সৃষ্ট হওয়া শূন্যস্থান ক্রমেই দখল করছে ভোগবাদ। ফলে বিচ্ছিন্নতা বা একাকিত্বের শিকার হচ্ছে মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো মানুষকে যেমন একসঙ্গে গাঁটছড়ায় বাঁধছে তেমনি জনবিচ্ছিন্নও করে ফেলছে। বর্তমান সামাজিক অবস্থানটি পরিমাণগতভাবে মাপা হচ্ছে। এখানেও অসম প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ যেন নিজের বিরুদ্ধেই নিজে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া।
মানুষকে যদি শারীরিক ব্যথা ও বিচ্ছেদের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলা হয় তাহলে প্রথমটিকেই বেছে নেয়। তারা বিচ্ছেদের চেয়ে শারীরিক আঘাতটিকে কম কষ্টকর বলে মনে করে। শারীরিক ব্যথা ওষুধে ভালো হয়। এ কারণে মানুষ সব সময়ই সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চায়। ওই বিষয়টিই যখন অসম্ভব হয়ে পড়ে তখনই মানুষ নিঃসঙ্গতায় ভোগে। আর এতে বিষন্নতা, আত্মহত্যা, উদ্বেগ, অনিদ্রা, ভয়-ভীতি উদ্রেককারী চিন্তা ইত্যাদি সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা নিঃসঙ্গতার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। নিঃসঙ্গতার সঙ্গে ডিমেনশিয়া, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদয়যন্ত্রের রোগ, স্ট্রোক, রোগ প্রতিরোধ শক্তি হ্রাস পাওয়া, এমনকি দুর্ঘটনা প্রবণতার মতো রোগেরও গভীর সম্পর্ক রয়েছে। নিঃসঙ্গতা মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী হরমোন কার্টিসোল নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। তাই এসব থেকে দূরে থাকতে হলে হতাশা ও নিঃসঙ্গতা পরিত্যাগ করতে হবে। আর যা যা করা দরকার তা-ই করা উচিত।
প্রবীণদের দায়িত্ব অনেকে নিতে চান না। অবসাদের চোরাবালিতে বয়স্কদের একাকী থাকা মানেই পাগল হওয়ার উপক্রম। তার জীবনে একটা চাপা দুঃখ অবচেতন মনে এনে দেয় বিষন্নতা। গভীর অসুখ দানা বাঁধে তার বুকের ভেতর। তাই তো তাদের প্রয়োজন বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের। পারিবারিক বন্ধন ছাড়া একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা দূর করা প্রায় অসম্ভব।
হই চই আর আনন্দের ভেতর দিন কাটানো মানুষ ভুলে যাচ্ছে। দেশজুড়ে হাজার হাজার বৃদ্ধ-বৃদ্ধা প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছেন। এর মূলে হয়তো গভীর কোনো কারণ আছে। অন্যদিকে প্রচণ্ডগতিতে প্রযুক্তির প্রয়োগে বয়স্করা বড় বেশি পিছিয়ে আছেন। তাই একাকিত্বের যন্ত্রণায় জীবনে ভালোভাবে বেঁচে থাকার আগ্রহটা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে তাদের। প্রযুক্তির কল্যাণে উঠতি ছেলেমেয়েরা যে যেমনভাবে পারে জীবনকে উপভোগ করছে। তারা যদি একটু সময় বের করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সঙ্গে সময় কাটায় তাহলে এতে উভয়েরই ভালো হয়।
নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য প্রবীণরা নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলাধুলা, গল্প করা, অভিযোগ শোনা, দাবি-দাওয়া মেটানোর চেষ্টা করেন। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকতে চেষ্টা করেন। যাদের এ সুযোগ থাকে না তারা ধর্মীয় কাজ, সামাজিক কাজ করে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করেন। এখন সময় এসেছে প্রবীণ জীবনের নিঃসঙ্গতা কাটাতে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয়া। প্রবীণদের নিঃসঙ্গতা কাটাতে ডে-কেয়ার সেন্টার, প্রবীণ ক্লাব, প্রবীণ হোটেল, বিনোদন ক্লাব তৈরি করতে হবে। তাদের কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়ে তা প্রয়োগ করতে পারলে সমাজের প্রভূত উন্নয়ন সম্ভব। এছাড়া সামাজিক অনাচার প্রতিরোধে প্রবীণদের সামনের কাতারে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দিলে তা আরো ভালো উপকারে আসবে।
অন্যদিকে ঝগড়া-বিবাদ, সম্পদের মালিকানা বণ্টন, বৈবাহিক সংকট নিরসনে প্রবীণদের দায়িত্ব প্রদান একটি উত্তম পন্থা হতে পারে। তারা যত বেশি কাজকর্মে থাকবেন ততই দূরে থাকবে বিষন্নতা। এছাড়া হতাশা ও নিঃসঙ্গতা কাটাতে শারীরিক, মানসিক প্রতিবন্ধীদের উপযোগী বিনোদন অনুষ্ঠান, গান-বাজনা, চলচ্চিত্র তৈরি করতে হবে বেশি করে। সর্বোপরি প্রবীণদের সঙ্গদানে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই।