নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে বিরোধী নেতাকর্মীদের হয়রানি-নির্যাতন ও জেলে আটকে রাখা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ নাকচ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। মন্ত্রীর দাবি বিরোধী দলের যাদের শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে তারা সবাই সন্ত্রাসী। ছবি, ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক কারণে একজনকেও হয়রানি করা হচ্ছে না। যারা সন্ত্রাসী, মানুষের বাড়িঘর জ্বালায়, সরকারি ও বেসরকারি সম্পদ বিশেষ করে বাস, ট্রেন, ট্রাক জ্বালাতে গিয়ে ধরা পড়ছে বিশেষ করে মানুষকে পোড়াচ্ছে, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।
যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে মন্ত্রী বলেন, যারা সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত রয়েছেন তাদের উচিত তা এখনই পরিহার করা। আমি তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাই। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখার আহ্বান জানিয়ে মঙ্গলবার বিবৃতি দিয়েছে ৬টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন। নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি বিশেষ করে নাগরিক সমাজের স্থান সংকুচিত হয়ে আসায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। রবার্ট এ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস-এর ওয়েবসাইটে প্রচারিত ৬ সংগঠনের যৌথ ওই বিবৃতিতে প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। সেই সঙ্গে অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক মামলা প্রত্যাহার, খেয়ালখুশিমতো আটক অধিকারকর্মী এবং বিরোধীদলীয় সদস্যদের মুক্তির দাবি জানানো হয়।
বাংলাদেশে মৃত্যু, নির্যাতনসহ ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর পূর্ণাঙ্গ এবং পক্ষপাতহীন তদন্তের দাবি জানিয়ে বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডাটা সুরক্ষা আইনের খসড়াকে পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানানো হয়।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ওই বিবৃতির বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিকরা। জবাবে মন্ত্রী বলেন, মানবাধিকারের দিক থেকে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ একটি আদর্শ দেশ। উন্নত দেশে শপিং মলে, ক্লাবে, স্কুলে যখন তখন মানুষ মারা হয়। বাংলাদেশে কোথাও মসজিদে, শপিং মলে বা ক্লাবে প্রকাশ্যে আক্রমণ করে মানুষ মেরে ফেলার ঘটনা নেই। বাংলাদেশে বিনা বিচারে কাউকে মেরে ফেলা হয় না। এ সময় তিনি গাজায় ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ টানেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে অন্যদের মানবাধিকারের শিক্ষা নেয়া দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পশ্চিমারা যাদের বিরোধী দল বলছে, সরকার তাদের সন্ত্রাসী বলছে? এর উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এটি সত্যি নয়। যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে, তাদের সন্ত্রাসী বলেছি। কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আটক করার ইচ্ছা আমাদের নেই। গত ৫ বছরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন টিমের কোনো ব্যর্থতা চোখে পড়ে কিনা? জানতে চাইলে ড. মোমেন বলেন, আমাদের অনেক সাফল্য রয়েছে, যা আমি বলতে পারি। কোনো ব্যর্থতা রয়েছে বলে আমার জানা নেই। এ সময় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করতে না পারা কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মন্ত্রণালয় তথা সরকারের ব্যর্থতা নয়? এমন সম্পূরক প্রশ্নে ড. মোমেন বলেন, না, এটা ঠিক ব্যর্থতা নয়। রোহিঙ্গারা যেকোনো সময় ফেরত যাবে বলে আশা রাখি। মন্ত্রী বলেন, এখানে একটি কথা বলে রাখি, শুধু বাংলাদেশ বা মিয়ানমার চাইলেই রোহিঙ্গারা ফেরত যাবে না, অন্যান্য বহু প্রতিষ্ঠান, বিদেশি বন্ধু, যারা বন্ধু হিসেবে আমাদের পরামর্শ দেয়, তাদের অনেকই চায় না এ অবস্থায় রোহিঙ্গারা ফেরত যাক। তারা এ-ও বলে, বাংলাদেশে ১৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যা রয়েছে, সেখানে বাড়তি এক মিলিয়ন থাকলে সমস্যা কি? তাদের কেউ কেউ রোহিঙ্গাদের দক্ষতা উন্নয়ন করে মূলস্রোতে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দিচ্ছেন বলেও উল্লেখ করেন মন্ত্রী।
রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে চায় জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, একবার যাওয়ার উদ্যোগ নেয়া হলো। তখন বিদেশিরা বললো, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে পাঠায়েন না, তাদের (রোহিঙ্গাদের) আমরা (বিদেশিরা) নিয়ে যাব। এরপর অল্প কয়েকজন রোহিঙ্গা নিয়েছে। এজন্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ধীরগতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিতে মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন করলে ড. মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। সম্প্রতি ঘানায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের পাশে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ যৌথভাবে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর বেশ খুশি। আর সম্পর্কে যে অস্বস্তির কথা বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনায় তোলা হয়নি। আমরা চাই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, যুক্তরাষ্ট্রও এটাই চায়। অবাধ ও সুষ্ঠুর সঙ্গে ওয়াশিংটন যুক্ত করেছে সহিংসতামুক্ত। তবে আমরা সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারি না। কারণ এটা নির্ভর করে আমাদের সংস্কৃতি, সকল দল ও নেতৃত্বের আন্তরিকতা ও ইচ্ছার ওপর। যুক্তরাষ্ট্র বন্ধু বলে উপদেশ দেয়। উপদেশ ভালো হলে আমরা গ্রহণ করি। বাস্তবসম্মত না হলে আমরা উপদেশ গ্রহণ করি না, আর এর জন্য যুক্তরাষ্ট্র রাগ করে না।
নির্বাচনের আগে বোয়িং উড়োজাহাজ নিয়ে পিটার হাস্-এর দৌড়ঝাঁপের খবর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রস্তাবটি অনেক দিন আগের। বাংলাদেশ বোয়িং কিনতে চাইছে, কারণ আমাদের চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ তার বিমানের বহরে কিছু বৈচিত্র্য আনতে চায়, তাই ১০টি এয়ারবাসও কিনবো। ১০টি এয়ারবাস কেনার খবর বের হলে তারা সস্তায় বোয়িং বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনাবেচার সঙ্গে নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য কোনো বিষয় জড়িত কিনা? এমন প্রশ্নে ড. মোমেন বলেন, কেনাবেচা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ নিয়ে সব দেশেরই অনুরোধ থাকে। আর অনুরোধকে আমরা কখনো চাপ মনে করি না। ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে টানাপড়েন প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, না, এখন আর আমাদের মধ্যে কোনো টানাপড়েন নেই।