Dum Dum Jail in India
Advertisements

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার ইমাম মেহেদী হাসান ডলার, একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও ধর্মপ্রাণ মানুষ। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন এবং সততার সঙ্গে জীবনযাপন করেন। কিন্তু তার এই ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনযাত্রাই তাকে এক নির্মম ষড়যন্ত্রের শিকার বানায়। র‌্যাব এবং ভারতের স্পেশাল টাস্কফোর্সের যৌথ গুম এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে, তার জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে মানবিকতার একটি বিশাল অংশ।

২০২১ সালের ৬ নভেম্বর। আসরের নামাজের পর ফিশারি থেকে বাড়ি ফেরার পথে ছনকান্দা রোডের বটতলা এলাকায় ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা। সাদা পোশাকধারী তিন ব্যক্তি, যারা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দেয়, মেহেদীকে জোরপূর্বক একটি প্রাইভেটকারে তুলে নেয়। সেই মুহূর্ত থেকেই তার জীবনে শুরু হয় অন্ধকারময় অধ্যায়।

মেহেদী বলেন, ‘গাড়িতে তুলে প্রথমেই আমার হাত আর চোখ শক্ত করে বেঁধে ফেলা হয়। প্রায় তিন-চার ঘণ্টা গাড়ি চলার পর আমাকে একটি ছোট্ট, স্যাঁতসেঁতে ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘরটি ছিল বাথরুমের চেয়েও ছোট। সেখানে দিনের পর দিন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আটকে রাখা হতো। শুধু খাবার খাওয়া কিংবা বাথরুমে যাওয়ার সময় সাময়িকভাবে হাত খোলা হতো। এমনকি নামাজ পড়তে চাইলেও আমাকে হাত আর চোখ বাঁধা অবস্থায় থাকতে বাধ্য করা হতো।’

মেহেদী প্রতিদিন শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। তার সঙ্গে আরও ৮-৯ জন বন্দি ছিলেন, যারা ইশারায় একে অপরের সঙ্গে কথা বলতেন। তাদের অবস্থান ছিল র‌্যাব-১ এর হেডকোয়ার্টারে।

তিনি বলেন, ‘গুমখানায় প্রতিটি দিন ছিল যন্ত্রণার অসহনীয় অধ্যায়। মাঝে মাঝে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে ভয় দেখানো হতো, শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো এবং জঙ্গি হিসেবে স্বীকারোক্তি দিতে চাপ দেওয়া হতো।’

নির্যাতনের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে শীতের সময় এক টুকরা কম্বল পর্যন্ত দেওয়া হতো না। তিনি ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে রাত কাটিয়েছেন। ঘুমানোর সুযোগ ছিল না। অজু করার বা গোসলের সময় সীমাবদ্ধ ছিল মাত্র পাঁচ মিনিট।

১৭৪ দিনের নির্মম নির্যাতনের পর র‌্যাব সদস্যরা একদিন তাকে গাড়িতে তুলে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের দিকে নিয়ে যায়। গন্তব্যে পৌঁছে তাকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের স্পেশাল টাস্কফোর্সের (এসটিএফ) হাতে তুলে দেওয়া হয়। সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় মেহেদী বুঝতেই পারছিলেন না, তার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে।

এসটিএফ তাকে বনগাঁ থানায় হস্তান্তর করে। বনগাঁ থানার পুলিশ তাকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে মামলা দেয়।

মেহেদী বলেন, ‘আমি কখনোই ভারতের মাটি স্পর্শ করিনি, তবু আমাকে সে দেশের আইন অনুযায়ী অপরাধী বানানো হলো।’ এরপর তাকে বনগাঁ জেল থেকে দমদম জেলে পাঠানো হয়। সেখানে চার মাস কারাবাসের প্রতিটি দিন ছিল চরম অমানবিক।

চার মাস পর মেহেদী দমদম জেল থেকে মুক্তি পান। ভারতীয় প্রশাসন এবং বিএসএফ সদস্যরা তাকে মেহেরপুর মুজিবনগর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পুশব্যাক করে। সীমান্ত পেরোনোর পর তিনি তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট, দীর্ঘ ১০ মাসের বিভীষিকা শেষে তিনি নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন।

মেহেদী বলেন, ‘এই নির্মম অভিজ্ঞতা আমার জীবন থেকে শুধু সময় নয়, মানবিকতার একটি বিশাল অংশও ছিনিয়ে নিয়েছে।’

Advertisements