বাংলাদেশ যদি এখন নতুন করে আর কোনো বিদেশি ঋণ নাও নেয়, তাহলে যা নিয়েছে তা সুদ ও আসলে শোধ করতে ২০৬২ সাল পর্যন্ত লেগে যাবে । আর গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
যতই দিন যাবে এই ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে। আর বাংলাদেশ নতুন করেও ঋণ নিচ্ছে। ফলে চাপ বাড়তেই থাকবে। বিশ্লেষকরা বলছেন,বিদেশি ঋণে বেশ কিছু প্রকল্প আছে যাতে অতিরিক্ত খরচ করা হয়েছে। ঋণ নিয়ে “লুটপাট” করা হয়েছে। তার মাশুল গুনতে হবে বাংলাদেশকে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, বিদায়ি অর্থবছরে(২০২২-২৩) আগের বছরের তুলনায় ৪৭ শতাংশ বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। আর গত ছয় বছরে পরিশোধের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থ বছরে ঋণের সুদ এবং আসল শোধ করতে হয়েছে ২৭৪ কোটি ডলার। ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে ২০১ কোটি ডলার। এক বছরে বেশি শোধ করতে হয়েছে ৭৩ কোটি ডলার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৩২৮ কোটি ডলার শোধ করতে হবে। ছয় বছর পর ২০২৯-৩০ অর্থ বছরে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৫১৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশ যদি আর নতুন কোনো ঋণ না নেয় তাহলে ২০৬২ সাল পর্যন্ত ঋণের সুদ এবং আসল পরিশোধ করতে হবে।
২০১২-১৩ অর্থ বছরে বাংলাদেশকে ১১০ কোটিডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিলো। ১০ বছরে ২০২১-২২ অর্থ বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২০১ কোটি ডলার। এদিকে ঋণের অর্থনৈতিক সহায়তা ছাড় কমছে। ঋণের প্রতিশ্রুতিও কমছে। তারপর বাংলাদেশের জন্য পাইপ লাইনে ৪০ হাজার কোটি ডলার আছে। তার মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি সহজ শর্তে ঋণ( সফট লোন)।
বর্তমানে বাংলাদেশের মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ সাত হাজার ২২৯ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় সাত লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকার বেশি । আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২০—২১ সাল পর্যন্ত এই হিসাব প্রকাশ করেছে গত ফেব্রুয়ারিতে। গত ৩০ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। যার প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ছাড় করেছে।
এর মধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের কাছে ঋণ এক হাজার ৮১৬ কোটি ডলার, এডিবি এক হাজার ৩২৮ কোটি ডলার, জাপান ৯২৩ কোটি ডলার, রাশিয়া ৫০৯ কেটি ডলার এবং চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে ৪৭৬ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক জুলাই মাসে তার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১৬.১৪ লাখ কোটি টাকা। দেশে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ৯৫ হাজার ১৯ টাকা। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ মোট জিডিপির ১৭ শতাংশ। আর সরকারের মোট ঋণের মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৪৩.৫ শতাংশ।
দেশে ঋণ-জিডিপির অনুপাত ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ২০১৪ সালে ঋণ-জিডিপির অনুপাত ছিল ২৮.৭ শতাংশ, যা এখন ৪২. ১ শতাংশ।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন,” আমরা বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য দীর্ঘ মেয়াদের তুলনায় স্বল্প মেয়াদে ঋণ নিয়েছি। এগুলোর সুদের হার বেশি এবং অল্প সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়। এর এগুলো রাশিয়া, জাপানসহ কয়েকটি দেশ থেকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে নেয়া হয়েছে।
এইসব ঋণে বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ-এর চেয়ে মনিটরিং কম। ফলে হয়তো সরকার সেদিকে ঝুঁকেছে। এখন যদি এইসব প্রকল্প থেকে রিটার্ন আসতে শুরু করে তাহলে চাপ সামলানো যাবে। নয়তো চাপটা অনেক বেশি হবে। এটা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ও রিজার্ভের ওপর আরো চাপ বাড়াবে।”
তিনি বলেন,” আমার বিবেচনায় এইসব ঋণ রিভিউ করা দরকার। এর শর্ত, প্রকল্প সব কিছু। পুরো প্রক্রিয়াই রিভিউ করা দকার। আর এই ধরনের ঋণ ভবিষ্যতে নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।”
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন,” ২০২৪—২৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশের ঋণের কিস্তি পরিশোধেরপরিমাণ চার বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ফলে ২০২৪-২৫ থেকে ২০২৯-৩০ অর্থ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধের বড় চাপে থাকবে।”
তিনি বলেন,” এই ঋণ নেয়া হয়েছে বড় বড় প্রকল্পে। সেখানে বাস্তবায়নের সময় বাড়ানো হয়েছে। ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। ঋণও বেশি নেয়া হয়েছে। এখানে লুটপাট হয়েছে বলে আমি মনে করি। প্রতিটি প্রকল্প থেকে বড় ধরনের মার্জিন কর্তা ব্যক্তিরা নিয়েছে। ফলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।”
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন,”রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণ নেয়া হয়েছে। এর উৎপাদন ক্ষমতা দুই হাজার ৪০০ মেগওয়াট। অথচ ভারতের তামিলনাড়ুতে ছয় বিলিয়ন ডলার দিয়ে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি প্রকল্প করা হয়েছে। এখান থেকেই আমাদের বিষয়টি বোঝা যায়। আর রাশিয়াও খরচ বেশি দেখিয়ে আমাদের এখান থেকে বেশি ডলার নিয়ে যাবে।”
সূত্রঃ ডয়চে ভেলে