আওয়ামীলীগ একটি রাজনৈতিক দল। তবে গতো ১৩ বছরের আওয়ামীলীগকে প্রথাগত রাজনৈতিক দলের সাথে তুলনা করা চলে না। প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো উদাসীনতা ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার ফলভোগকারী আওয়ামীলীগ কতৃত্ববাদী এক রাজনৈতিক দলে পরিনত হয়েছে৷ আওয়ামী বিরোধী শক্তির ব্যর্থ আন্দোলনগুলো আওয়ামিলীগকে আরো বিরাট দানবে পরিনত করেছে৷
২০০৮ সালে ক্ষমতা আসার পর ধারাবাহিকভাবে কিছু ভয়ংকর রকমের ঘটনা ঘটতে থাকে। সেদিক বিবেচনা বলা চলে আওয়ামীলীগ দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতার আসার একটা নকশা করেই এসেছে৷ কথিত মতে তাতে বিদেশি শক্তির হাত রয়েছে। কেউ কেউ গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজতে উৎসাহ বোধ করেছেন। বিভিন্ন আলাপ আলোচনা ও রাজনৈতিক দলগুলো ঢালাও অভিযোগ করে আসছে যে, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ও মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগ সামরিকবাহিনী ও ধর্মীয় একটা শক্তিকে কোনঠাসা করে ফেলেছে৷ ২০১৩ সালের ভোটার বিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিরাজনীতিকরণের সূচনা হয়।
হেফাজতের শাপলা চত্ত্বরের ঘটনাকে অনেক বিশ্লেষক আওয়ামীলীগের বাঁচা মরার লড়াই হিসেবে দেখেছিলেন এবং সে আন্দোলন দমনও হয়েছিল অত্যন্ত কঠোরভাবে ৷ তারপর প্রথাগত রাজনৈতিক দলের বাইরে ইসলামপ্রিয় সাধারণ জনগোষ্ঠী ও অন্যান্য সংগঠনগুলো কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। একটা পর্যায়ে আওয়ামী সরকারের সাথে সমঝোতায় চলে আসে।
এদিকে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি অভিযোগ করে আসছে বেগম জিয়ারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় জড়িয়ে তাঁকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে ১/১১ সময়ের রাজনৈতিক মামলাগুলো আওয়ামী সরকার তুলে নিতে পারতো, যেভাবে শেখ হাসিনা ও অন্যান্যের মামলাগুলো তুলে নেয়া হয়েছিল।অনেকে মনে করছেন কারারুদ্ধ বেগম জিয়া ও নির্বাসিত তারেক রহমানকে দলের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার চূড়ান্ত আয়োজন প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দলের ভাঙ্গন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
উপরন্তু বেগম জিয়া ও তারেক জিয়ার শারিরীক অনুপস্থিতিতে বিএনপি দৃশ্যত কোন রাজনৈতিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে পারে নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন সহ প্রায় সকল আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে।
জনগণের একটা অংশকে ক্ষমতাসীন দল বিশ্বাস করাতে সামর্থ্য হয়েছে যে,আওয়ামীলীগের অবর্তমানে এই দুর্বল বিএনপি কোনভাবেই দেশ পরিচালনা করতে পারবে না। অতএব উন্নয়নের স্বার্থে আওয়ামীলীগের আপাত অপশাসন মেনে নেয়া উচিত।
নিকট ভবিষ্যতে জামায়াতে ইসলামী সহ হেফাজতে ইসলাম ও অন্যান্য ইসলামি দল ও সংগঠনগুলোর পক্ষে আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ইসলাম পন্থী এই অংশটা সরকার বিরোধী আন্দোলনের একটা মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারতো বলে পূর্বে অনেকের ধারনা ছিল। সময়ের ব্যবধানে সে বাস্তবতা পালটে গেছে।
দেশের ব্যাংকিং খাতে লুটপাট, শেয়ার বাজার ডাকাতি, অর্থ পাচার, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে মহা লুটপাটের সময়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল কার্যত কোন আন্দোলনের সূচনা করতে পারে নি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও বামজোটের একটা অংশ এসব বিষয়ে সরব ছিলেন কিন্তু বড় ধরনের কোন সফল আন্দোলন হয় নি৷
২০০৮ সালের পর থেকে অনুষ্ঠিত গুম, খুনের বিরুদ্ধে জনরোষ বেড়েছে, রাজনৈতিক দলগুলো ধারাবাহিকভাবে এর প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও কোন আন্দোলনের মুখে এসব বন্ধ হয় নি। সরকার দীর্ঘ সময় ধরে দেশী ও বিদেশী মিডিয়া, জাতিসংঘ ও আন্তজার্তিক মানবাধিকার সংস্থার সমালোচনার পথ ভিন্ন পথ বেছে নেয়। প্রথমে তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট নামে একটি আইনের মাধ্যমে বিরোধী মত দমনে সক্রিয় হয়। এই আইনের দরুন সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, গণমাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করা বা সরকারের স্বার্থ পরিপন্থী তথ্যভিত্তিক কোন প্রতিবেদন প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
সর্বোপরি বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমানের যে অবস্থা চলছে তাতে আগামী ২০২৩ সালের নির্বাচনে কি ঘটতে তা বড়মুখ করে বলা বেশ মুশকিল। ২০১৮ সালের মতো মধ্যরাতের নির্বাচন থেকে আওয়ামীলীগ সরকারকে বিরত রাখার মতো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে অবশিষ্ট নেই৷
বিএনপির যেটুকু সম্ভাবনা ছিল, যুক্তফ্রন্ট ও কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সে সম্বানার পূর্ণ মৃত্যু ঘটেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণ অধিকার পরিষদ নামক রাজনৈতিক দল ও জামায়াত ত্যাগী নেতাকর্মী ও অন্যান্য দলের নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে গড়ে উঠা আমার বাংলাদেশ পার্টি ও অন্যান্য ছোট দলগুলো আওয়ামী ছত্রছায়ায় বড়জোর বিরোধী দল হবার স্বপ্ন দেখে থাকতে পারে। তবে নবীন এ দলগুলো ২০২৩ সালের নির্বাচনে বড় কোন ভূমিকা রাখতে পারবে বলে রাজনৈতিক সচেতন মহল মনে করছে না।
ভোটবিহীন নির্বাচনের যে কালচার আওয়ামীলীগ তৈরি করেছে তা বর্তমান সময়ে সক্রিয় কোন রাজনৈতিক দল বা জোট পরিবর্তন করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
তবে কেউ কেউ মনে করছেন,নিকট ভবিষ্যতে বিএনপি থেকে বের হয়ে আসা একটা বিরট অংশ ও আওয়ামীলীগের বঞ্চিত একটা অংশ মিলে ও অন্যান্য ছোট মাঝারি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে নতুন একটি রাজনৈতিক দল বা শক্তির উত্থান ঘটতে পারে। এমনি নাটকীয়ভাবে তৈরি কোন শক্তি হয়তো আওয়ামীলীগের দীর্ঘ দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে সরকার গঠন করতে পারে। সত্য হলো,বর্তমানে বিরোধী রাজনীতির যে লেজেগোবরে অবস্থা তাতে নাটকীয় কোন পরিবর্তন ব্যতীত স্বাভাবিক বা ধারাবাহিক কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা কেউ দেখছে না।
বাংলাদেশ কার্যত রাজনীতি শূন্য, একদলীয় শাসন কতটুকু দীর্ঘ হবার পর ভেঙে পড়ে সে আশায় জনগণ প্রহর গুনছে। বাংলাদেশ দীর্ঘ মেয়াদী স্বৈরশাসনের কবলে পড়তে পারে বলে যে আশাংকা দীর্ঘদিনের, দৃশ্যত বাংলাদেশ সেদিকেই আগাচ্ছে।
লেখকঃ আইনজীবী,সম্পাদক ভাওয়াল বার্তা