বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠার পেছনে যে মহীয়সী নারীর নেপথ্য ভূমিকা আমরা দেখি, তিনি শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর দুটি গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’র উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে রয়েছেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী ‘রেণু’। বৃহৎ সংসারের হাল ধরার পাশাপাশি অর্থসহ রাজনীতিতে নানাভাবে সহযোগিতা করে কীভাবে অনুপ্রেরণাদাত্রী হিসেবে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ভূমিকা পালন করেছেন, সে এক বিস্ময়। জেলবন্দি বঙ্গবন্ধুর কাছে জরুরি খবর, কর্মীদের কাছে নেতার নির্দেশনা পৌঁছে দেওয়াসহ বহুমুখী ভূমিকা পালন করেছেন ‘বঙ্গমাতা’।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ঘটনাপর্ব ১৯৪৩ থেকে ১৯৫৫। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লেখার প্রেরণা হিসেবেই বঙ্গবন্ধু সহধর্মিণীর কথা বলেছেন- “আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।’ আমার স্ত্রী- যার ডাকনাম রেণু- আমাকে কয়টা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।”
বঙ্গবন্ধু জীবনী লিখতেই বংশপরিচয় পর্বে আবার রেণুর প্রসঙ্গ। ‘আমার দাদার চাচা এবং রেণুর দাদার বাবা কলকাতা থেকে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে চলে আসেন বাড়িতে। …রেণুর দাদা আমার দাদার চাচাতো ভাই। তিনি তাঁর জীবনী লিখে রেখে গিয়েছিলেন সুন্দর বাংলা ভাষায়। রেণুও তার কয়েকটা পাতা পেয়েছিল যখন তার দাদা সমস্ত সম্পত্তি রেণু ও তার বোনকে লিখে দিয়ে যান তখন। রেণুর বাবা মানে আমার শ্বশুর ও চাচা তাঁর বাবার সামনেই মারা যান। মুসলিম আইন অনুযায়ী রেণু তার সম্পত্তি পায় না। রেণুর কোনো চাচা না থাকার জন্য তার দাদা সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান। আমাদের বংশের অনেক ইতিহাস পাওয়া যেত যদি তাঁর জীবনীটা পেতাম। রেণু অনেক খুঁজেছে, পায় নাই।’
কৈশোরেই কীভাবে শেখ মুজিব ও ফজিলাতুন্নেছার বিয়ে হয়, এ ব্যাপারে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বলা হয়েছে- “একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয়, তখন আমার বয়স ১২-১৩ বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাবো।’ রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর সে আমার মায়ের কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়। রেণুর বড় বোনেরও আমার আরেক চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিবাহ হয়। এরা আমার শ্বশুরবাড়িতে থাকল, কারণ আমার ও রেণুর বাড়ির দরকার নাই। রেণুদের ঘর আমাদের ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুহাত ব্যবধান।”
বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে সমর্থন দিয়েছেন, তা নানাভাবেই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এসেছে। রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জে মুসলিম লীগের এক কনফারেন্স করেন। তিনি লিখেছেন, ‘অতিথিদের খাবার বন্দোবস্ত করার জন্য আমার মা ও স্ত্রী গ্রামের বাড়ি থেকে গোপালগঞ্জের বাড়িতে এসেছে। তিন দিন হলো আমার শরীরও খারাপ হয়ে পড়েছে অত্যধিক পরিশ্রমে। বিকেলে ভয়ানক জ্বর হলো। …রেণু কয়েক দিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়। জ্বর একটু ভালো হলো। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী।’
সময়ে সময়ে বঙ্গবন্ধুর অর্থের প্রয়োজন হলে কীভাবে ফজিলাতুন্নেছা হাত বাড়িয়ে দিতেন, এমনকি তিনি নিজে বেশিদূর লেখাপড়া না করলেও বঙ্গবন্ধুর শিক্ষায় কতটা যত্নবান ছিলেন তাও আমরা দেখি- ‘আব্বা ছাড়াও মায়ের কাছ থেকেও আমি টাকা নিতে পারতাম। আর সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত, বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনোদিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত, আমার জন্যই রাখত।’
রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধু তখন ঢাকা জেলে বন্দি। জেলখানায়ও স্বামীকে টাকার কথা লিখেছেন রেণু। বঙ্গবন্ধুর বরাতে, ‘রেণু তখন হাচিনাকে নিয়ে বাড়িতেই থাকে। হাচিনা তখন একটু হাঁটতে শিখছে। রেণুর চিঠি জেলেই পেয়েছিলাম। কিছু টাকাও আব্বা পাঠিয়েছিলেন। রেণু জানত, আমি সিগারেট খাই। টাকাপয়সা নাও থাকতে পারে। টাকার দরকার হলে লিখতে বলেছিল।’
বঙ্গবন্ধু তার স্ত্রীর কষ্ট নিজেও বুঝতেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করে রাখত, যাতে আমার কষ্ট না হয়।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘রেণু তো নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।’
১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের সময় কারাগারে বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। অনশনে ছিলেন তিনি। ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। বাড়ি পৌঁছার পর রেণু বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে যা বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষায়- “তোমার চিঠি পেয়ে আমি বুঝেছিলাম, তুমি কিছু একটা করে ফেলবা। আমি তোমাকে দেখবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাকে বলব নিয়ে যেতে, আব্বাকে বলতে পারি না লজ্জায়। নাসের ভাই বাড়ি নাই। যখন খবর পেলাম খবরের কাগজে, তখন লজ্জা-শরম ত্যাগ করে আব্বাকে বললাম… রওয়ানা করলাম ঢাকায়, সোজা আমাদের বড় নৌকায় তিনজন মাল্লা নিয়ে। কেন তুমি অনশন করতে গিয়েছিলে? কিছু একটা হলে কী উপায় হতো? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা নিয়ে কী করে বাঁচতাম? হাসিনা, কামালের অবস্থা কী হতো? তুমি বলবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তো হতো না? মানুষ কি শুধু খাওয়া-পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়? আর মরে গেলে দেশের কাজই বা কীভাবে করতা?’ আমি তাকে কিছুই বললাম না। তাকে বলতে দিলাম, কারণ মনের কথা প্রকাশ করতে পারলে ব্যথাটা কিছু কমে যায়। রেণু খুব চাপা, আজ যেন কথার বাঁধ ভেঙে গেছে। শুধু বললাম, উপায় ছিল না।”
বঙ্গবন্ধুর জন্য সর্বাবস্থায় নিজেকে যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত রাখতেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার পরের ঘটনা কীভাবে সামলান এই সংগ্রামী নারী, তা বঙ্গবন্ধুর জবানিতে- “বাসায় এসে দেখলাম, রেণু এখনও ভাল করে সংসার পাততে পারে নাই। তাকে বললাম,চ্ ‘আর বোধ হয় দরকার হবে না। কারণ মন্ত্রিত্ব ভেঙে দিবে, আর আমাকেও গ্রেপ্তার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধ হয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা, ঢাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ হবে, তা বোধ হয় হল না। নিজের হাতের টাকা-পয়সাগুলিও খরচ করে ফেলেছি।’ রেণু ভাবতে লাগল, আমি গোসল করে ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম করছিলাম। বেলা তিনটায় টেলিফোন এল, কেন্দ্রীয় সরকার ৯২(ক) ধারা জারি করেছে। মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করা হয়েছে।”
আমরা দেখি, ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল জেল-জীবনচিত্র স্থান পেয়েছে। এই গ্রন্থেও বঙ্গবন্ধু তার সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রসঙ্গ এনেছেন বারবার। বঙ্গবন্ধুর জেলে থাকার সময়কালে তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে জেলে আসতেন স্ত্রী। ১৫ জুন ১৯৬৬ তারিখে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “সাড়ে চারটায় জেলের লোক এসে বলল- চলুন, আপনার দেখা আসিয়াছে, আপনার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে বসে আছে জেল অফিসে। তাড়াতাড়ি রওয়ানা করলাম। দূর থেকে দেখি রাসেল, রেহানা ও হাচিনা চেয়ে আছে আমার রাস্তার দিকে। ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না- যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করছে। জেলগেট দিয়ে একটা মালবোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল, আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে আব্বার বাড়ি। এখন ওর ধারণা হয়েছে, এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়। ছোট মেয়েটার শুধু একটা আবদার। সে আমার কাছে থাকবে। আর কেমন করে কোথায় থাকি, তা দেখবে। …কে বুঝবে আমাদের মতো রাজনৈতিক বন্দিদের বুকের ব্যথা। আমার ছেলেমেয়েদের তো থাকা-খাওয়ার চিন্তা করতে হবে না। এমন অনেক লোক আছে, যাদের স্ত্রীদের ভিক্ষা করে, পরের বাড়ি খেটে, এমনকি ইজ্জত দিয়েও সংসার চালাতে হয়েছে। জীবনে অনেক রাজবন্দির স্ত্রী বা ছেলেমেয়ের চিঠি পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। সে-করুণ কাহিনী কল্পনা করতেও ভয় হয়।”
২৬ জুন ১৯৬৬ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেলখানায় দেখা করতে আসেননি বটে, তাকে স্মরণ করেছেন বঙ্গবন্ধু এভাবে- ‘আজ তো রবিবার। কয়েদিরা কাপড় পরিস্কার করবে। ঠিক করেছি, স্যারিডন সহজে খাব না। মেট ও পাহারা কাহাকেও কিছু বললাম না। প্রায় দশটার দিকে আরাম লাগছিল। বাইরে থাকতে মাথাব্যথায় অনেক সময় কষ্ট পেতাম। স্যারিডন দু-তিনটা খেয়ে চুপ করে থাকতাম। আধা ঘণ্টা পরেই ভালো হয়ে যেতাম। আবার কাজে নেমে পড়তাম। রেণু স্যারিডন খাইতে দিতে চাইত না। ভীষণ আপত্তি করত। বলত, হার্ট দুর্বল হয়ে যাবে। আমি বলতাম, আমার হার্ট নাই, অনেক পূর্বেই শেষ হয়ে গেছে। বাইরে তার কথা শুনি নাই। কিন্তু জেলে ভিতর তার নিষেধ না শুনে পারলাম না।’
বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচা শেষ হয় ১৯৬৮ সালের ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। ওই বছরের ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ছাড়া পেলেও সেনাবাহিনী পুনরায় তাকে আটক করে। এ সময়ও তার রোজনামচায় দুঃসহ বন্দিজীবন ও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় উঠে এসেছে।
জাতির পিতার জবানিতেই স্পষ্ট- শেখ মুজিব থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠার পেছনে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই মহীয়সী নারীর জন্মদিনে আমরা জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
গ্রন্থনা: মাহফুজুর রহমান মানিক