ফেসবুকে পেজ ও গ্রুপ খুলে কেনা-বেচা হচ্ছে কিডনি
Advertisements

ফেসবুক গ্রুপ ও পেজে (এফ-কমার্স) চলছে জমজমাট কিডনি ব্যবসা। এসব গ্রুপে কিডনি বেচাকেনার পোস্ট দিচ্ছে সংঘবদ্ধ দালালচক্র। এদের টোপের শিকার হচ্ছেন গরিব অসহায় মানুষ। তাদের প্রলুব্ধ করে নামমাত্র মূল্যে কিডনি নিয়ে রোগীদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে চড়া দামে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে কিডনি বেচাকেনায় প্রায় এক ডজন এফ-কমার্সের তথ্য মিলেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কিডনি বিক্রয়কেন্দ্র, বাংলাদেশ কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট গ্রুপ, কিডনি ক্রয়-বিক্রয়, বাংলাদেশ কিডনি ও লিভার পেশেন্ট চিকিৎসাসেবা, বাংলাদেশ কিডনি লিভার চিকিৎসাসেবা, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট নেটওয়ার্ক, কিডনি লিভার ট্রান্সপ্লান্ট বাংলাদেশ, কিডনি ও লিভার ডোনার কুমিল্লা, কিডনি পেশেন্ট কেয়ার অ্যান্ড গাইডসহ এসব চক্র এফ-কমার্সে সক্রিয় রয়েছে। এফ-কমার্সে রক্তের গ্রুপ উল্লেখ করে দালালচক্র কিডনির ডোনার আহ্বান করছে। তারা ডোনারদের সঙ্গে দুই-আড়াই লাখ টাকায় চুক্তি করে। পাসপোর্ট আছে-এমন ডোনারদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। এরপর জাল কাগজপত্রে রোগীর স্বজন সাজিয়ে ডোনারকে ভারতে নিয়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়। দালালরা রোগীর কাছ থেকে আদায় করে ২০-২৫ লাখ টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে দাম আরও বেশি হয়। অথচ অনেক সময় ডোনারের চুক্তির পুরো টাকা দেয় না দালালচক্র। এভাবেই তারা ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া বাংলাদেশি রোগীদের কিডনির ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। অথচ আইনি দিক দিয়ে কিডনি বিক্রি অপরাধ। রোগীর স্বজন ছাড়া কেউ কিডনি দান করতে পারবেন না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানান, ঢাকায় খুব স্বল্প পরিসরে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হওয়ায় রোগীরা ভারতে যান। সেখানে অন্য দেশের চেয়ে তুলনামূলক খরচও অনেক কম হয়। ভারতের কলকাতা, মুম্বাই, হায়দারাবাদ, দিল্লি, বেঙ্গালুরু ও চেন্নাইয়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হয় বলে জানান তিনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. রফিকুল আলম বলেন, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে আমাদের দেশে সব আইনি বিধান অনুসরণ করা হয়। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আইন অনুযায়ী নিকটাত্মীয়কে কিডনিদাতা হিসাবে উপস্থাপন করার অনুরোধ করা হয়। প্রাথমিকভাবে কিডনিদাতা মনোনীত করা হয় দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্ক নিশ্চিত হওয়ার পর তার রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু টাইপিংয়ের মিল হলে।

র‌্যাবের লিগ্যাল মিডিয়া উইংয়ের প্রধান কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে কিডনিসহ মানবদেহের নানা অঙ্গের অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের সঙ্গে সক্রিয় দালালদের অনেককেই ধরা হয়েছে। তারা জড়িতদের নাম বলেছে। আমরা এ দালালচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ডিবি একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, কিডনি বেচাকেনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, কিডনি বেচাকেনার অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে আমরাও প্রচেষ্টা চালাব।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ফেসবুকে বাংলাদেশ কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট গ্রুপে যোগাযোগের একটি ফোন নম্বরও দেওয়া আছে। যুগান্তরের পক্ষ থেকে ওই নম্বরে কল করা হলে কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেওয়া হয়। এ গ্রুপে এমডি সাকলাইন নামে একজন পোস্ট দিয়ে কিডনি ও লিভার রোগীদের বলেছেন, একমাত্র আমরাই বিশ্বস্ততার সঙ্গে কম খরচে কলকাতা ও দিল্লিতে ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা করি। ডোনার ম্যানেজ, বাংলাদেশের পেপার, পাসপোর্ট, ভিসা, ইন্ডিয়ান পেপারসহ সব কাজের নিশ্চয়তা দিয়ে আগ্রহীদের যোগাযোগের আহ্বান জানানো হয় পোস্টে। এমডি সাকলাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ‘ভালো কাজ করছি, এতে দোষের কিছু নেই’ বলে তিনি সংযোগ কেটে দেন। এরপর আর কল ধরেননি।

রানা এসকে নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে কিডনি বিক্রয়কেন্দ্র নামের একটি গ্রুপে পোস্ট দিয়েছেন বাগেরহাটের মোল্লার হাটের মুশফিকুর রহমান। ও পজিটিভ কিডনির জন্য তিনি দাম চান ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। যুগান্তর থেকে রোগীর স্বজন পরিচয়ে ফোন করা হলে মুশফিকুর জানান, তিনি অনেক টাকা ঋণগ্রস্ত। এখন কিডনি বিক্রি ছাড়া উপায় নেই। একজন যোগাযোগ করেছিল-কথাবার্তায় বনিবনা হয়নি।

এমডি জুয়েল নামের আইডি থেকে কিডনি বিক্রয়কেন্দ্রে একটি পোস্টে এ পজিটিভ মুসলিম কিডনি ডোনার আহ্বান করা হয়েছে। এর কমেন্ট বক্সে মুজিবুর রহমান জনি নামে একজন লিখেছেন, পরিবারের সচ্ছলতার জন্য একটি কিডনি বিক্রি করতে চাই। প্লিজ হেল্প মি, কিডনি নিন, টাকা দিয়ে তিন কন্যার পিতাকে দায়দায়িত্ব পালনে সহায়তা করুন।

কিডনি পেশেন্ট কেয়ার অ্যান্ড গাইড নামের পেজে এক পোস্টে জরুরি ভিত্তিতে এ পজিটিভ এবং বি পজিটিভ ডোনার চেয়ে পাসপোর্ট আছে-এমন ডোনারদের ইনবক্সে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। একাধিকবার এ পেজে যোগাযোগ করলেও কেউ কথা বলতে রাজি হননি। কিডনি লিভার বিক্রয় বাংলাদেশ পেজে সরাসরি যোগাযোগের আহ্বান জানানো হয়েছে। দাবি করা হয়েছে-কলকাতা ও দিল্লিতে কন্ট্রাক্টে কাজের পাশাপাশি কিডনির ডোনার সংগ্রহ, রোগী ও ডোনারের পাসপোর্ট, ভিসা ও অন্যান্য সব রকম কাজ করে দেওয়ার কথা।

কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট নেটওয়ার্ক গ্রুপে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করে কিডনি ও লিভার রোগীদের অল্প খরচে ট্রান্সপ্লান্ট করাতে যোগাযোগের আহ্বান জানানো হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, অপারেশন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত তারা সশরীরে রোগীর পাশে থাকেন।

এদিকে দালালরা কিডনি নিয়ে ডোনারদের সঙ্গে প্রতারণাও করছে বলে অভিযোগ মিলেছে। জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার দুধাইল গ্রামের সুজাউল মণ্ডল ৫ বছর আগে ৪ লাখ টাকায় কিডনি বিক্রি করেছিলেন। চক্রের দালাল শাহরিয়ার ইমরান তাকে দুই লাখ টাকা দেন। বাকি দুই লাখ টাকা দেশে এসে দেওয়ার কথা থাকলেও এ টাকা তাকে দেওয়া হচ্ছিল না। এ অবস্থায় তিনি গত ১১ অক্টোবর কালাই থানায় মামলা করেন। মামলার পর জয়পুরহাট ও ঢাকায় অভিযান চালিয়ে শাহরিয়ার ইমরানসহ মেহেদী হাসান, সাইফুল ইসলাম, আব্দুল মান্নান ও তাজুল ইসলাম ওরফে তাজুকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। র‌্যাব জানিয়েছে, শাহরিয়ার বাংলাদেশ কিডনি ও লিভার পেশেন্ট চিকিৎসা সেবা, বাংলাদেশ কিডনি লিভার চিকিৎসা সেবা নামে দুটি গ্রুপের অ্যাডমিন।

সূত্র জানায়, কিডনিদাতারাই পরে দালালি শুরু করেন। আগের দালালরা তাদের বলে দেন, কিডনি বেচবে এমন লোক পেলে কমিশন দেওয়া হবে। অর্থের লোভে তারা লোকজনকে প্রলোভন দিয়ে কিডনি বেচতে উৎসাহিত করেন। আবার কিডনি বিক্রি নিয়েও প্রতারণা চলে। প্রতারকরা নানা নামে পেজ খুলে কিডনি বিক্রির বিজ্ঞাপন দেয়। এরপর রোগীর স্বজনরা যোগাযোগ করলে তাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানিয়েছে, কিডনির দালালদের একেকটি চক্রে ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য থাকে। তারা চার ভাগে বিভক্ত হয়ে কিডনি বেচাকেনার কাজ করে। প্রথম গ্রুপ ঢাকায় অবস্থান করে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। আর “তৃতীয় গ্রুপ চাহিদা অনুযায়ী প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব ও অভাবী মানুষ চিহ্নিত করে কিডনি ডোনার হতে প্রলুব করে। তৃতীয় গ্রুপটি ডোনারদের ঢাকায় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে রোগীর সঙ্গে ব্লাড ম্যাচিং ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে। এরপর পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ডোনারকে ভারতে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে। চক্রের সঙ্গে ভারতে অবস্থানকারী আরেকটি চক্র পারস্পরিক যোগসাজশে কিডনি ডোনারকে এয়ারপোর্ট অথবা স্থলবন্দরে রিসিভ করে। পরে অস্ত্রোপচারসহ যাবতীয় কার্যক্রম শেষে দাতা ও গ্রহীতাকে বৈধ-অবৈধ উপায়ে দেশে নিয়ে আসে।

সূত্রঃ যুগান্তর

Advertisements