শাইখ মুহাম্মদ আকরাম নদভী ফিতরাত শব্দটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন Nature হিসেবে, অর্থাৎ প্রকৃতি। এখানে প্রকৃতি অর্থ Environment নয়, বরং মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য বুঝানো হচ্ছে। ইসলামে মানুষের এই প্রকৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামকে ফিতরাতি ধর্মও বলা হয়ে থাকে, যার মানে হচ্ছে এই ধর্মে কোন আর্টিফিশিয়াল ইনফ্লুয়েন্স নেই, যেগুলো অন্যান্য সকল ধর্মে ঢুকে পড়েছে।
ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য তথা প্রকৃতির সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল। এই ইসলামের আকিদা ও বিধান বুঝতে মানুষের কষ্টও কম হয়। যার ফিতরাত নষ্ট হয়ে যায়নি, সে স্বাভাবিকভাবেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে। আল্লাহর রাসুল ﷺ বলেছেন যে প্রত্যেক মানুষই ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে। পরবর্তিতে পারিবারিক কিংবা পারিপার্শিক ইনফ্লুয়েন্সের কারণে সে প্যাগান বা মুর্তিপুজারি হয়ে যায় ও শিরক করে বসে।
এই ফিতরাতের উপর জন্মের কারণ হলো আল্লাহ তা’আলা আমাদের কাছে covenant বা ওয়াদা নিয়েছিলেন পৃথিবীতে আমাদের জন্মের আগে, রুহের জগতে। তিনি পিতা আদম আঃ-এর ভেতর থেকে সকল মানুষের রুহ বের করে তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তাদের রব সম্পর্কে। আমাদের রুহ তখন আল্লাহর সামনেই শাহাদাহ দিয়েছিলাম। এই ঘটনার ইশারা কুরআনেও আছে।
ফিতরাত বা প্রকৃতির কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। মানুষের প্রকৃতি হলো সে হবে সামাজিক। স্বাভাবিকভাবেই সে সমাজ সৃষ্টি করবে ও একে অন্যের উপর ডিপেন্ড করবে। সে স্বাভাবিকভাবেই অতি প্রয়োজন ছাড়া কারো ক্ষতি করতে চাইবে না, ভদ্র ব্যবহার করবে। স্বাভাবিকভাবেই সে বয়স্কদের সম্মান করেবে। ভাষা সৃষ্টি করে ভাবের আদান-প্রদান করবে। সে ভাষা হবে অত্যন্ত কমপ্লেক্স, অন্যান্য প্রাণীদের মতো না। অন্যান্য প্রাণীরা শুধু বর্তমানে বাঁচে। কিন্তু মানুষ ভবিষ্যতের জন্য বাঁচবে, সে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করবে। সে অতীত মনে রাখবে, অতীত থেকে শিক্ষা নেবে।
মানুষের প্রকৃতি হলো সে কৃতজ্ঞ থাকতে চায়, প্রশংসা করতে চায়। কেউ তার কোন উপকার করলে সে তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেই। সে যত বড় যালিমই হোক না কেন, উপকারীর প্রতি তার অন্তর এক প্রকার নরম হবে। ধন্যবাদ দিলে মানুষ সবসময়ই ভালো বোধ করবে। ধন্যবাদ পেতেও সে পছন্দ করবে।
মানুষের প্রকৃতি হলো সে জন্মের পরপরই মায়ের দুধ খেতে চাইবে, মায়ের কাছেই নিজেকে সেইফ মনে করবে। মা সামনে থেকে চলে গেলে তাকে যতো খেলনাই দেয়া হোক, যতো কিছুই করা হোক, সে মাকেই চাইবে। মনে রাখবেন,একটি বাচ্চার কাছে মায়ের দুধ যতোটুকু প্রিয় আর প্রয়োজনীয়, সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করা মানুষের প্রকৃতির কাছে তার চাইতেও বেশী প্রিয়।এজন্যই খাঁটি প্রকৃতির তথা খাঁটি ফিতরাতি মানুষের কাছে স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ দরকার পড়ে না। সে জানেই যে স্রষ্টা একজন আছেন। সে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ প্রাকৃতিকভাবেই। সে শুধু জানতে চায় কীভাবে স্রস্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।
এজন্য কুরআন খুললেই আমরা সর্বপ্রথম যা দেখি তা হলো “আলহামদুলিল্লাহ”। পিতা আদম আঃ-এর সর্বপ্রথম উচ্চারণ হলো “আলহামদুলিল্লাহ”। আলহামদুলিল্লাহ মানেই তো হলো সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা একমাত্র আল্লাহরই।একজন ফিতরাতি মানুষকে তো প্রমাণ দেবার প্রয়োজনই নেই যে আল্লাহ আছেন, সৃষ্টিকর্তা আছেন। তাকে শুধু মনে করিয়ে দেয়া লাগে সৃষ্টিকর্তার মহিমা ও অপার অনুগ্রহ যেন সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে। যখন কাউকে দেখেন তার মা’র প্রতি বেয়াদবি করতে, তখন ওই মহিলা যে তার মা এটা কি তাকে প্রমাণ দেন? না, এই প্রমাণ কোন উন্মাদও দিবে না। তাকে শুধু বারবার বলবেন, “আরে, তিনি তো তোমার মা! কীভাবে বেয়াদবি করলে? তিনি তোমার মা!” এটাই বার বার বলবেন, তাকে মনে করিয়ে দেবেন যে তিনি তার মা। ওকে মাতৃত্বের প্রমাণ দিবেন না। ওকে মনে করিয়ে দিবে, তার প্রতি তার মায়ের কতো ভালোবাসা, কতো অনুগ্রহ ছিল। মা তার জন্য কতো কি করেছেন, কতো আদর করেছেন, কতো কষ্ট সহ্য করেছেন। এসব “মনে করিয়ে” দেবেন।
কুরআন খুলে দেখুন, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে দেখুন, কোথাও কি আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ পেশ করা আছে? না, নেই। কুরআনের পাতায় পাতায়, লাইনে লাইনে শুধু আল্লাহর মহিমা, তাঁর অনুগ্রহ “মনে করিয়ে” দেয়া হয়েছে। ‘তিনিই আল্লাহ’, ‘অতএব তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে?’ মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে বার বার করে তাঁর পরিচয়, তিনি কি কি করেছেন, কি কি করেন আর কি কি করবেন।
ভাবুন তো ‘যিকর’শব্দটি কুরআনের কতোবার পড়েছেন? যিকর মানে হলো মনে করা, স্মরণ করা। খোদ কুরআনকেই ‘যিকর’ বলা হয়েছে। আর নির্দেশ দেয়া হয়েছে নবীজি ﷺ-কে “ফাযাক্কির ইন্নামা আনতা মুযাক্কির”, তাদের মনে করিয়ে দিন, আপনি তো মুযাক্কির।
কি স্মরণ করিয়ে দিতে বলা হচ্ছে? কুরআন আমাদের কি মনে করিয়ে দিতে চায়? এটাই যে সবকিছুই আল্লাহর, সবকিছুই আল্লাহ করেন। আমাদের প্রতি সকল অনুগ্রহ তাঁরই। আমাদের প্রকৃতিকেই ডাকছেন আল্লাহ।
কুরআন আমাদের ফিতরাতকেই জাগ্রত করার চেষ্টা করছে। সেই ফিতরাত হলো সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ, সবকিছু তাঁরই অনুগ্রহ, আমাদের সকল কৃতজ্ঞতা তাঁর প্রতিই নিবেদিত। আলহামদুলিল্লাহ।