পাটের উৎপাদন কমেছে ৩ লাখ ২০ হাজার বেল
Advertisements

২০২০ সালের জুলাইয়ে পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। দীর্ঘদিন ধরে মুনাফাহীনতার কারণ দেখিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) নিয়ন্ত্রণাধীন সব পাটকল। এর পরই মোট উৎপাদন কমার পাশাপাশি পাটের উৎপাদনশীলতায় পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে পাট উৎপাদন কমেছে ৩ লাখ ২০ হাজার ১১৪ বেল। দারিদ্র্যপ্রবণ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগেই উৎপাদন কমেছে ২ লাখ ২৬ হাজার বেল।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাটের উৎপাদন ছিল ৮০ লাখ ৪৫ হাজার ১৯৭ বেল, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে কমে দাঁড়িয়েছে ৭৭ লাখ ২৫ হাজার ৮৩ বেল। অন্যদিকে এ সময়ের ব্যবধানে পাটের উৎপাদনশীলতা কমেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে হেক্টরপ্রতি পাটের উৎপাদনশীলতা ছিল ১১ দশমিক ৮৪ বেল, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে নেমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩২ বেল। দেশের আট বিভাগের মধ্যে পাট উৎপাদন সবচেয়ে বেশি কমেছে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে। দারিদ্র্যপ্রবণ এ দুটি বিভাগেই উৎপাদন কমেছে ২ লাখ ২৬ হাজার বেল। ফলে দেশের মোট উৎপাদন কমার প্রায় ৭০ শতাংশই এ দুটি বিভাগে। গত অর্থবছরে রংপুর বিভাগে পাট উৎপাদন কমেছে ১ লাখ ২১ হাজার ৭০৯ বেল এবং রাজশাহী বিভাগে কমেছে ১ লাখ ৪ হাজার ১২৭ বেল। এছাড়া তৃতীয় সর্বোচ্চ কমেছে খুলনা বিভাগে ৫৮ হাজার ৭৬১ বেল এবং ঢাকা বিভাগে কমেছে ৩৪ হাজার ৬৩৯ বেল।

২০২০ সালে বন্ধ ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল কীভাবে এসব পাটকল দ্রুত চালু করা যায়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে সরকার। তবে কবে নাগাদ সব মিল চালু হবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো ঘোষণা অসেনি। আবার দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রায়ত্ত এসব পাটকল বন্ধ থাকায় চিড় ধরেছে কৃষকের আস্থায়।

এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিজেএমসি সাময়িক বন্ধ করা মিলগুলো অবসায়নের পর সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ইজারা দেয়ার কার্যক্রম চলছে। এরই মধ্যে নরসিংদীর বাংলাদেশ জুট মিল এবং চট্টগ্রামের কেএফডি জুট মিলস ভাড়াভিত্তিক ইজারা দেয়ার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া আরো দুটি জুট মিল ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। অবশিষ্ট ১৩টি মিল ইজারা দেয়ার জন্য দ্বিতীয়বারের মতো ইওআই বা এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট আহ্বান করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে দ্রুতই আরো কিছু মিল চালু করা সম্ভব হবে। পুনরায় চালু করা মিলে অবসায়নকৃত শ্রমিকরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজের সুযোগ পাবেন। পাশাপাশি এসব মিলে নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃৃষ্টি হবে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, বৈশ্বিক রফতানি বাজারে বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের মধ্যে পাটের বাণিজ্য সুবিধা সবচেয়ে বেশি। যদি কোনো দেশের পণ্য বেশি বাণিজ্য সুবিধা দিয়ে থাকে, তাহলে সেই পণ্য দেশে উৎপাদনে জোর দেয়াটাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ও দক্ষতার পরিচায়ক। এ ধরনের বাণিজ্য সুবিধা পরিমাপে ব্যবহার করা হয় তুলনামূলক সুবিধা (আরসিএ) মান। আর সেই মানদণ্ডে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এখন পাট। ফলে পাটে আরসিএ মান বেশি থাকায় দেশে আরো বেশি পাটের উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে অধিক বাণিজ্য সুবিধা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, উৎপাদন কমে যাওয়া দেখে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যায়, পাটকল বন্ধের প্রাথমিক ধাক্কা পাট উৎপাদনে পড়েছে। পাটকল বন্ধের পর কৃষকরা মনে করতেই পারেন বাজারে চাহিদা ও দাম কমে যাবে। ফলে আবাদ এলাকা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোয় কম গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে বিশ্ববাজারে চাহিদা থাকায় গত বছর পাটের দাম বেশ ভালো ছিল। যদিও দেশের বাজারের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা কমে গেলে দামে আরো বড় পতন হবে। কেননা সরকারি খাতের চাহিদা না থাকায় শুধু বেসরকারি খাতের চাহিদার মাধ্যমে বাজার চাহিদা সর্বোচ্চ করা সম্ভব নাও হতে পারে। এতে কৃষক পাট আবাদে পুরোপুরি বিমুখ হতে পারেন। ফলে পাট আবাদে টেকসই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে দ্রুত বন্ধ পাটকল চালু রাখতে হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যমতে, উৎপাদিত পাটের ৮৫ ভাগই তোষা জাতের পাট। এ পাটবীজের চাহিদার প্রায় ৮৫-৯০ ভাগ ভারত থেকে আনতে হয়। সেখানে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে চার হাজার থেকে ছয় হাজার টন পাটবীজ আমদানি করতে হয়। দেশে পাটবীজ উৎপাদনের মূল সমস্যা হলো অন্য ফসলের তুলনায় কম লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা তুলনামূলকভাবে আবাদে কম আগ্রহী হন। উৎপাদনে কৃষকদের আগ্রহী করতে ও কৃষকরা যাতে চাষ করে লাভবান হন সেজন্য প্রণোদনা ও ভর্তুকির ব্যবস্থা করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। তবে বিদেশনির্ভরতা কমিয়ে পাটবীজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ প্রণয়ন করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে ২০২৫-২৬—এ পাঁচ বছরের মধ্যে দেশে ৪ হাজার ৫০০ টন পাটবীজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উচ্চমূল্যের রবি ফসলের পরিবর্তে পাটবীজ উৎপাদনে তেমন আগ্রহী হন না কৃষক। পাটের ভালো জাত না আসায় হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতাও প্রত্যাশা অনুসারে হচ্ছে না। তাছাড়া দেশের পাটের ব্যবহার বাড়াতেও উদ্যোগ সীমিত। দুই অর্থবছরে পাটের সর্বোচ্চ দাম থাকার পরও কৃষক আস্থায় নিতে পারছেন না। উচ্চদামের এ পরিস্থিতিও কৃষকদের আস্থা ফেরাতে পারেনি।

এ বিষয়ে আকিজ গ্রুপের চেয়ারম্যান সেখ নাসির উদ্দিন বলেন, বেসরকারি গত কয়েক দশক ধরেই পাট খাত ও কৃষকের উন্নয়নে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। পুরো পাট খাতের বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিসহায়তা প্রয়োজন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাট সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আকিজ জুট মিল সবসময়ই কৃষকের পাশে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। গত কয়েক বছরে আকিজ জুট মিলের সক্ষমতা বাড়ার কারণে চাহিদা বেড়েছে। ফলে বাজার থেকে বেশি পরিমাণে পাট কেনা হচ্ছে। নিজেদের উৎপাদন সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারে আকিজ জুট মিলের অবস্থান সুসংহত করার মাধ্যমে কৃষকের পাশে আরো সমৃদ্ধিশালীভাবে থাকব। দেশীয় বাজারে পাটপণ্যের বহুমুখী চাহিদা তৈরি ও রফতানি বাজার সমৃদ্ধ করতে পারলে পাট উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এছাড়া পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে আইনি উদ্যোগ নিলে পার্শ্ববর্তী দেশ ছাড়াও বাংলাদেশেই পাটপণ্যের ব্যাপক বাজার সম্প্রসারণ করা সম্ভব।

সূত্রঃ বণিক বার্তা

Advertisements