০১ আইরনি হইলেও সত্য যে, হাল-আমলে বাংলাদেশের নারীগণ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হইছে নারীবাদীদের হাতেই। (অন্যান্য দেশগুলার অবস্থা যে খুব ভিন্ন সেইটাও না, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত/উন্নয়নশীল দেশগুলার অবস্থাও একই।) যেকোন ইস্যুতে, যখনি সুযোগ আসে– অধিকার, এইজেন্সি বা প্রগতিশীলতার নাম নিয়া– এই নারীবাদীরা আমাদের মা-বোনদেরকে, তাদের অজ্ঞাতে কিংবা অননুমতিতে ব্যবহার কইরা নিজদের ব্যবসায়িক ও আদর্শিক ফায়দা লুটে। এইটাকে যদি আমরা নারী ব্যবসা বলতে পারি তাইলে এই নারীবাদীরা মূলত নারী-ব্যবসায়ী।নারীবাদী ডিসকোর্সের অন্যতম প্রধান একটা কনসেপ্ট হইলো এইজেন্সি। এই আলাপটা ঘুরপাক খায় নারীদের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে পরিণত করবার ক্ষমতা/সুযোগ আছে কিনা এই প্রশ্নে। অর্থ্যাৎ নারী তার ইচ্ছামত কোন কিছু করবার স্বাধীনতা বা ক্ষমতা রাখে কিনা সেই আলাপ। কিন্তু এইযে নারীদের এই স্বাধীনতা নাই, তারা নিগৃহীত– নারীবাদীদের এইসব ডমিন্যান্ট বয়ানে শুভঙ্করের যে ফাঁকিটা, বরং বলা ভালো তাদের মোনাফেকিটা, সবার চোখ এড়ায়া যায় সেইটা হইলো, এই যে নারীদের তথাকথিত এইজেন্সি যেইটা নিয়া তারা লাফায়, পুরা সমাজব্যবস্থাকে লাথি দিয়ে তছনছ কইরা দিতে চায়, সেই এইজেন্সি আসলে কিভাবে তৈরি হয় আর এর প্রবক্তারাই বা কারা? আর এর পেছনের উদ্দেশ্যগুলাই বা কী!
আপনি কি চিন্তা করে দেখছেন যে, পশ্চিমা লিবারেল এনজিও বা নারীবাদী সংস্থাগুলা, যারা মোটাদাগে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও বিশ্বব্যবস্থাকে সেবা দিয়ে যায়, তারা কেবল নারী স্বাধীনতা আর প্রগতির কথা কয়না, বরং একি সাথে সেই স্বাধীনতার আর প্রগতির সংজ্ঞাটাও তারাই নির্ধারণ করে দেয় (এবং অনেক ক্ষেত্রেই উল্টায়া দেয়)! সম্প্রতি বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সাফ চায়ম্পিয়নশীপ জেতা পরবর্তী ঘটনাগুলাতেও একই কাহিনী ঘটছে। এইখানে এই নারীরা কেবলমাত্র ব্যবহৃতই হয় নাই, বরং তাদের সাবজেক্টিভিটি আর এইজেন্সিকে বদলে দেওয়ার একটা ঘৃণ্য চেষ্টা করা হইছে এই নারীবাদী রাম-বামদের পক্ষ থেকে।
.
০২ অথচ গত পরশুর ঘটনাকে এই নারীবাদীরা যেভাবে সাজাইতে চাইছে, যেন এই মেয়েরা এই ইসলামী রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থাকে ভাইঙ্গা দিতে আর হুজুরদের পাছায় লাথি দিয়া সমাজ থেকে খেদায়া দিতে ফুটবল খেলতে নামছে। আর সাফ জেতার মাধ্যমে তারা এইটা অর্জন করছে, তাদের এইজেন্সির প্রকাশ ঘটাইছে। অথচ বাস্তব ঘটনা কিন্তু অন্যরকম। এই দলের কোন মেয়েই কিন্তু জীবনেও এসব কথা বলে নাই। হয়তো এই মেয়েগুলার ধর্ম বা রাজনীতি নিয়ে খুব সচেতন কোন অবস্থান ও চিন্তাও নাই। তারপরেও এইখানে সেই মেয়েদের উপর একটা উৎপাদিত এইজেন্সি আরোপিত হইছে– যেইটার মূলে আছে ইসলামবিদ্বেষ। এই ব্রাহ্মণ্যবাদী নারী প্রগতির বরকন্দাজরা যতই লাফাক, বাংলাদেশের গ্রামীণ রক্ষণশীল মূল্যবোধসম্পন্ন পরিবেশ থেকে উইঠা আসা কোন ছেলে/মেয়েই– তার ধর্মীয় শিক্ষা থাক বা না থাক অথবা সে নিজে পূর্ণভাবে ইসলাম পালন করুক বা না করুক– স্বাভবিকভাবে নিজ থেকে ধর্ম বা হুজুর-বিদ্বেষী হবে এই ঘটনার সম্ভাবনা হাজারে একটারও কম। কিন্তু তারা এইটারেই প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেছে। আর এইটা করতে গিয়া তারা এই মেয়েদের সাব্জেক্টিভিটিকে খারিজ তো করে দিছেই তার উপর একটা বহিরাগত এইজেন্সি আরোপ করছে। হয়তো খেয়াল করছেন, এই মেয়েরা ম্যাচ জেতার পর কিন্তু মাঠে সবাই মিলে সেজদা করছে। এই সেজদা– সেইটা কতটা যথোচিত তা নিয়া আলাপ করা যাইতে পারে অন্য জায়গায়– কিন্তু তাদের মুসলমানিত্বের ঘোষণা দেয়, (নট নেসেসারিলি ধার্মিকতার), হুজুর বিদ্বেষের না।
অথচ নারীবাদের এইদেশীয় ইসলামবিদ্বেষী বরকন্দাজরা সেইসব চাইপা গিয়া এই মেয়েদেরকে মোল্লা-বিদ্বেষ, প্রকারান্তরে ইসলাম-বিদ্বেষের সিম্বল হিসেবে হাজির করার কোশেশ করতেছে। এইটা করতে গিয়া তারা এই মেয়েদের চর্চিত এইজেন্সি খারিজ তো করছেই, সেইসাথে তাদেরকে নিজদের উদ্দেশ্য ব্যবহার করছে। এইটাই হইলো নারী ব্যবসা। আর এদের এইসব ইসলামবিদ্বেষের চর্চার এইটাই একমাত্র উদাহরণ না, বরং প্রত্যেকটা ঘটনাতেই তাদের ইসলাম-বিদ্বেষ চর্চার নজির মিলে– সেইটা হোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরলে ঢাবির ইজ্জত থাকে কিনা সেই কান্নাকাটিতে কিংবা কোন নারী নিজের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আর চিন্তা ব্যবহার কইরা ইসলামের জন্য চাকুরী ছাইড়া দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে নারীমুক্তির যে পরাজয় হয় সেই দুঃখে।
.
০৩ সমস্যা হইলো, বাংলাদেশে বিভিন্ন এনজিও আর নারীবাদী সংস্থাগুলা White Man’s Burden এর মতো “civilizing mission” আইসা আপনার মা-বোনদেরকে ‘বর্বর’, ‘ইতর’ অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে পশ্চিমাদের মতো ‘সভ্য’ নারী বানাইতে চায়। ব্যাপারটা যেন Muslim Women always need saving, কারণ মুসলমান হওয়ার কারণেই তারা অসভ্য বর্বর আর নিগৃহীত। (এইটার ফাঁফোকর নিয়া লিলা আবু-লুগদ লিখছিলেন Do Muslim Women Need Saving?) আর এইদেশের ইসলাম-বিদ্বেষী পশ্চিমাতাল একটা গোষ্ঠী এদের বরকন্দজ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু ‘সভ্য’ হওয়ার মাপকাঠিতে স্বাধীনতা, এইজেন্সি ইত্যাদি আলাপ থাকলেও দিনশেষে সেইটা মাপা হয় আপনি আপনার ট্র্যাডিশনকে কতটুকু বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাইতে পারতেছেন, ইসলামকে বাদ দিয়া কতটুকু পশ্চিমা মূল্যবোধকে ধারণ করতে পারতেছেন আর কতটুকু পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থাকে সেবা করতে পারতেছেন। অর্থ্যাৎ পশ্চিমা মূল্যবোধের চর্চা, ধর্মকে ছুড়ে ফেলা আর পুঁজিবাদকে সেবা দেওয়ার মাধ্যমেই কেবল আপনার এইজেন্সি চর্চা হয়, ( আপনার আসল ইচ্ছার বাস্তবায়নের মাধ্যমে না)।
ফলে আপনার হিজাব/নেকাব/পর্দা করার সিদ্ধান্ত, চাকুরি না করার সিদ্ধান্ত কিংবা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ইসলামকে মেনে চলার যে নিজস্ব সিদ্ধান্ত, আপনার নিজের র্যাশনালিটি আর উইলের যে সমন্বয়, সেইটা এই এই নারবাদীদের কাছে এইজেন্সি হিসেবে গণ্য হয়না। বরং সেইটা হয় পশ্চাৎপদতা। অর্থ্যাৎ আপনি পশ্চিমা-লিবারেল ধর্মের মূল্যবোধ মানলে এইজেন্সির চর্চা হবে, নয়তো হবেনা। আর এই এইজেন্সির ধারণাকেই সাবা মাহমুদ প্রশ্ন করছিলেন যে, এইজেন্সি খালি ট্র্যাডিশনকে বিরোধিতা/খারিজ করে দেয়ার মধ্যেই না, বরং ট্র্যাডিশনকে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমেও তো এইজেন্সির প্রকাশ করা যায়।
.
০৪ বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের মেয়েরা কিভাবে পুঁজিবাদী অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ব্যবহৃত হয় আর সেইখানে ব্র্যাকের মতো এনজিওদের ভূমিকা কী সেইটা নিয়া মিশেল মারফি অসাধারণ একটা কাজ করেছিলেন। বইটার নাম The Economization of Life । এইখানে তিনি দেইখাইছেন যে, পোস্ট-কলোয়নিয়াল সময়ে তৃতীয় বিশ্বে যে জনসংখ্যা নীতি আর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রচলন হয় সেইটার মূলে আসলে আছে একধরনের রেইসিস্ট বিশ্ববীক্ষা। যে বিশ্ববীক্ষায় “certain lives not worth living, certain lives not worth saving, and certain lives not worth being born at all”, যেন বিশ্বের অন্য প্রান্তের ‘সভ্য’ কিছু মানুষ আরো উন্নত জীবন যাপন করতে পারে। আর এই বিশ্ববীক্ষা বাস্তবায়নে মাঠ ঘাটে প্রধানত কাজ করে এইসকল এনজিওরা।
এই বিশবীক্ষায় আমাদের মা-বোনেরা কিভাবে “investible girls” হইয়া উঠে, মারফি সেইটাও দেখাইছেন। “Invest in a girl” অথবা নারীশিক্ষার মতো পশ্চিমাদের নিওলিবারেল ‘সিভিলাইজিং’ ক্যাম্পেইনগুলা মূলত উচ্চ-মুনাফার ব্যবসায়ী মডেল। এগুলা জন্মহারকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একদিকে যেমন একটা শ্রেণির মানুষের উন্নত জীবনকে নিশ্চিত করে তেমনি অন্যদিকে একদল সস্তা কিন্তু আপাত-শিক্ষিত নারী শ্রমিক তৈরির মাধ্যমে পুঁজিবাদী অর্থনীতির চাকাকেও সচল রাখে। আর উপরি হিসেবে এই করকন্দাজদের কপালে নারীদের “ত্রাণকর্তা” খেতাব তো জুটেই। বাংলাদেশে ব্র্যাক হইলো নারীদের নিপীড়ন ও ব্যবহার করার সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড। নামমাত্র মূল্যে নারী শ্রমিকদের দিয়া এরা কাজ করায়, আবার দিনশেষে নারী অধিকার নিয়ে প্রগতিশীল-পশ্চিমা বয়ান তৈরির পাশাপাশি লাইফস্টাইলও তৈরি করে এরা। ক্ষুদ্রঋণ দিয়া তারপর টিনের চাল খুইলা নিয়া আসার মতো নির্যাতনের আলাপ না হয় বাদই দিলাম।
.
০৫ এই এনজিও আর নারীবাদীরা এইসব নারীর ক্ষমাতায়ন বয়ান তৈরির মাধ্যমে অবশ্য আরেকটা কাজ করে, সেইটা হইলো দেশের সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের গুম-খুনের মতো জুলুম, নিপীড়ন, দুর্নীতি, বিচারহীনতা আর অবৈধ শাসনকে একধরনের মৌন বৈধতা দেয়। নারীর বা যেকোন ক্ষমতায়নের বয়ান দিনশেষে শাসকদলকেও একধরনের আপার হ্যান্ড দেয়, যেইটাকে তারা আরো বেশি জন-নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। একইসাথে এইটা পাবলিক ডিসকোর্সরেও প্রভাবিত করতে সক্ষম। অবশ্য এই কাজটা তারা প্রথম দিন থেকেই কইরা যাইতেছে।
.
০৬ আর ইস্যু যখন ফুটবল, বিশেষ করে নারী ফুটবল, তখন, পুঁজিবাদ ও বাজার ব্যবস্থার আলাপ স্বাভাবিকভাবেই অপরিহার্য। ফুটবল এখন যতটা না খেলা, তারচেয়ে বেশিও একটা পুঁজিবাদী/টাকার বাজার। আর অন্যান্য যেকোন স্পোর্টসের মতোই নারীদের ফুটবল পুঁজিবাদী বাজারের পাশাপাশি একটা নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করার একটা ভোগবাদী প্রজেক্ট আকারেই হাজির হইছে। এইটা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ অন্য কোনদিন।
.
০৭ নারী ফুটবলের এই জয় ‘মোল্লাতন্ত্র’ বা ইসলামপন্থার উপর আঘাত দূরে থাক, স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মুসলমান জনসাধারণের উপরেও কোন প্রভাব ফালাইতে পারে নাই। এখনো হয়তো বেশিরভাগ মানুষ জানেই না বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটবল খেলে। Keep seething, coomers!