তুরাগ নদের গাবতলী ও আমিনবাজার এলাকা দখলমুক্ত করার পাশাপাশি সৌন্দর্যবর্ধনে বছরপাঁচেক আগে বাস্তবায়িত হয় প্রায় ৩৬ কোটি টাকার প্রকল্প। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও দখলদারদের দৌরাত্ম্যে ফের নদের পার দখল হতে শুরু করেছে। অযত্নে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে ওয়াকওয়ে, বন্ধ হচ্ছে না দূষণ।
ঢাকার গাবতলী ও আমিনবাজার এলাকায় তুরাগ নদের তীর রক্ষায় এবং ফোরশোর ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ওয়াকওয়ে, কিউ ওয়ালসহ চার ধরনের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ওয়াকওয়ের পাশে রোপণ করা হয় সৌন্দর্যবর্ধক বৃক্ষ।
কিন্তু সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তুরাগ নদের তীরে ওয়াকওয়ে ঘেঁষে নতুন করে দখল শুরু হয়েছে। অস্থায়ী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ফোরশোর ভূমিতে।
গাবতলী ব্রিজের নিচ থেকে দক্ষিণ দিকে ৫ মিনিট হাঁটলেই দেখা যাবে ফোরশোর ভূমির বিশাল এলাকাজুড়ে বাঁশের বাজার। স্থানীয় বাঁশ ব্যবসায়ী মো. শাকিল জানান, তিন প্রজন্ম ধরে শত বছরের ব্যবসা তাদের। শতবর্ষ ধরে ঠিক এ জায়গাতেই অর্থাৎ ফোরশোর জমিতেই তাদের ব্যবসা। বিআইডব্লিউটিএর উচ্ছেদ অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইতেই বলেন, কিছু ব্যবসায়িক পাওনা আছে, টাকাগুলো তুলতে পারলেই এখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেব।
ফোরশোর ভূমির যে পাশে বাঁশের ব্যবসা করছেন শাকিল, এর উল্টোপাশে ওয়াকওয়ে ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ট্রাকস্ট্যান্ড। প্রায় আধা কিলোমিটারজুড়ে এ অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ডের কারণে ভেঙে গেছে ওয়াকওয়ের রেলিং, সীমানা পিলার। স্থানীয় বাসিন্দা মো. আকরাম শেখ বলেন, সম্প্রতি এখানে ট্রাকস্ট্যান্ড হয়েছে। এখান থেকে নিয়মিত চাঁদা নেয়া হয়। ফলে ট্রাকস্ট্যান্ডটি স্থায়ী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই করছেন স্থানীয়রা।
বিআইডব্লিউটিএর পাশাপাশি সিটি করপোরেশনেরও ফোরশোর ভূমি এবং নির্মিত ভৌত অবকাঠামো তদারকির দায়িত্ব আছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মুজিব সরোয়ার মাসুম বণিক বার্তাকে বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে বিআইডব্লিউটিএর সম্পদ দেখভালের কোনো নির্দেশনা আমাদের দেয়া হয়নি। তবে ওয়াকওয়ে ও ফোরশোর ভূমিতে কোনো নাগরিক সমস্যা থাকলে তা সমাধান করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
গাবতলী ব্রিজের নিচ থেকে উত্তর দিকে ১ মিনিটের দূরত্বে কয়লাঘাট। কয়লাঘাটের এ অংশে উচ্চ আদালতের ‘স্টে-অর্ডার’ থাকার কারণে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়নি। সেখানে কয়লা শ্রমিকরা কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করেছেন।
একই চিত্র দেখা গেছে আমিনবাজারের ওয়াকওয়েতেও। সেখানে বালি ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে জেটি বানিয়ে ফোরশোর ভূমিকেই বালি রাখার জন্য ব্যবহার করছেন। আমিনবাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের সামনের ওয়াকওয়ে বিপজ্জনকভাবে নদের দিকে সরে গেছে। দড়ি দিয়ে রেলিংয়ের সঙ্গে কোনোরকম টানা দিয়ে রক্ষা করা হয়েছে ওয়াকওয়ে।
বালি ও কয়লা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার থেকে তারা ঘাট ইজারা নিয়েছেন। এ ইজারায় নদীর পরিবেশ দূষণ এবং ফোরশোর ভূমি অবৈধভাবে ব্যবহার না করার শর্ত থাকলেও তা কেউই মানছে না।
এদিকে কয়লা, বালি শ্রমিক, দখলদার ও স্থানীয়দের অসচেতনতা এবং নানা কর্মকাণ্ডে দূষিত হচ্ছে নদ। কিন্তু নদী দূষণের দায় নিতে রাজি নয় বিআইডব্লিউটিএ। বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, নদীদূষণের বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তর দেখে। নদীদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে উল্লেখ করে দপ্তরটির সহকারী পরিচালক (মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট শাখা) ইয়াসমিন আক্তার বণিক বার্তাকে বলেন, নদীদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যেসব শিল্পের বর্জ্য নদীকে দূষিত করছে, আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করি এবং অপরাধ বুঝে মালিকদের কারাদণ্ডও দিয়ে থাকি। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা ও পরিচালন) মো. দেলাওয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ফোরশোর ভূমি দখল হচ্ছে এবং ভৌত অবকাঠামো নষ্টের খবর আমিও শুনেছি। তবে ঠিক কোন কোন জায়গায় এটা হচ্ছে, এ মুহূর্তে সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। বিষয়টি নিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলব।
অপরদিকে গাবতলী অংশের ফোরশোর ভূমি এবং ওয়াকওয়ের আশপাশে অল্প কিছু গাছ দেখা গেলেও সেগুলো সম্প্রতি লাগানো হয়েছে। ২০১১-১৫ সালের প্রকল্পের আওতায় লাগানো বৃক্ষগুলোর অস্তিত্ব এখন আর নেই। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০২০-এও বলা হয়েছে, বৃক্ষরোপণ এবং ওয়াকওয়েতে হাঁটতে আসা মানুষজনের বিশ্রামের জন্য বেঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নির্মিত অবকাঠামোগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং আলোকস্বল্পতার কারণে ওয়াকওয়েতে রাতে চলাফেরা করতে মানুষজন ভয় পায়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, মাদকসেবীদের আড্ডাও বসেও এসব অবকাঠামোতে।
তবে মিরপুর দারুস সালাম থানার ওসি মো. তোফায়েল বলছেন, নিয়মিত অভিযানের কারণে এখন আর আগের মতো সেখানে মাদকের আড্ডা বসে না।
ফোরশোর ভূমি থেকে মাটি কেটে ইটভাটায় নিয়ে যেতেও দেখা গেছে। কয়েকটি ট্রলারভর্তি মাটি দেখে এগিয়ে গেলে ট্রলারের কোনো শ্রমিক প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান গবেষক স্বপন কুমার দাশ বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকাসহ দেশের অনেক নদীই দখলদারদের লোভের ছোবলে হারিয়ে যাচ্ছে। এজন্য অবশ্য কর্তৃপক্ষের দুর্বল তদারকিকেই দায়ী করব। ‘নদী রক্ষা অধিকার’ নামে একটি কমিশন আছে। আছে বিআইডব্লিউটিএর মতো শক্তিশালী সংস্থা। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন যদি জোরদার উদ্যোগ নিয়ে একত্রে মাঠে নামতে পারে আর ধারাবাহিক নজরদারি বজায় রাখে, তাহলে দখলদাররা যত ক্ষমতাশালীই হোক না কেন ফোরশোর ভূমি দখলমুক্ত হবেই।
সূত্রঃ বণিক বার্তা