মুসলিম ফৌজ মাক্কা থেকে আর মাত্র ১ দিনের দূরত্বে। কুরেশিরা ওদিকে আতঙ্কে দিন গুজার করছে। কখন যে মুসলিম ফৌজ আক্রমণ চালায় ঠিক নেই। ঠিক কতটুকু দূরে আছে তা-ও জানে না।
নবি ﷺ মার জাহরান নামে এক জায়গায় শেষবারের মতো তাঁবু খাটালেন। মাক্কায় ঢোকার আগে এই শেষ বিরতি। এরপর সোজা মাক্কায় ঢুকে যাবেন। সাহাবিদের নির্দেশ দিলেন, “আমরা এখানে তাঁবু গাড়ব। তোমাদের আলো জ্বালাও।”
১০ হাজার লোক একসাথে আলো জ্বালালে কী অবস্থা হবে চিন্তা করতে পারেন? মাক্কায় এখন আর আছেই বা কজন? বড়জোর ৬ ভাগের ১ ভাগ লোক। অনেকটা জনমানবশূন্যই বলা যায়। কুরেশিদের ৪ ভাগের ৩ ভাগ গোত্র এরই মধ্যে ইসলামে চলে এসেছে। যারা জোটে আছে তারা আর যাই হোক মুসলিমদের বিরুদ্ধে নামবে না। বাতাসের দিক সত্যিই এখন উলটো। সম্মান এখন পুরোটাই নবিজির পদতলে।
নবিজির চাচা আব্বাস বিন আবদুল-মুত্তালিব মাত্র কদিন হলো ইসলাম বরণ করেছেন। কুরেশিদের জন্য তাঁর মনে একটু দরদই হলো। তিনি নবিজির কাছে আর্জি করলেন, “আমাকে যেতে দেবে? দেখি আক্রমণ না করে বনিবনা হয় কি না?”
নবি ﷺ অনুমতি দিলেন।
যেতে যেতে আব্বাস রা. মনে মনে বলছিলেন, “নবি ﷺ যদি এত শক্তি নিয়ে মাক্কায় ঢোকেন কুরেশিদের কী যে দুর্গতি হবে! চিরকালের জন্য এরা শেষ।”
এসব চিন্তা করতে করতে তিনি যাচ্ছেন। দূরে অন্ধকারে তিনটা ছায়া একটু একটু করে অবয়ব পাচ্ছে। তিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে ঠাহরের চেষ্টা করলেন কারা এরা।
ছায়া তিনটা কুরেশিদের সবচে জ্যেষ্ঠ তিন সর্দারের। তার মধ্যে একজন আবু সুফিয়ান বিন হারব বিন উমাইয়া—সেই আবু সুফিয়ান। সাথে হাকিম বিন হিজাম আর বুদাইল বিন ওয়ার্কা। প্রতি রাতে তারা বের হয়ে দেখতেন মুসলিমরা কদ্দুর আছে। কতটুক এসেছে। আজ রাতে দেখেন একটা জায়গায় হাজার হাজার আলো। যেন আলোর দরিয়া। এত আলো একসাথে কাদের হতে পারে তারা ভেবে পেলেন না। মুসলিমরা এত বড় ফৌজ নিয়ে যে আসতে পারে তাদের মাথাতেই আসেনি।
বুদাইল খুশি খুশি হয়ে বললেন, “নিশ্চয় এরা বাকর গোত্র। আমাদের বাঁচাতে এসেছে।”
আবু সুফিয়ান বললেন, “ওদের এত সাহস নেই। আর ওরা এতজন হবেও না।”
তারা এরকম কথা বলছিলেন। হঠাৎ আব্বাস রা. হাঁক দিলেন, “আবুল-হানজালা?” হানজালা আবু সুফিয়ানের বড় ছেলের নাম।
আবু সুফিয়ান গলা শুনেই চিনলেন কার গলা। তিনি বললেন, “আবুল-ফাদ্ল? আপনি এখানে কী করছেন?” তিনি তো জানেন না আব্বাস মুসলিম হয়েছেন।
আব্বাস রা. বললেন, “তোমাদের কপাল পুড়ুক। এটা মুহাম্মাদের ফৌজ। কাল সে যদি জিতে যায়, তোমাদের আর বাঁচার আশা নেই।”
“আমি এখন কী করব? আমাকে কী করতে বলেন আপনি?”
“আমার সাথে আসুন। আমি নবিজির সামনে আপনার জন্য সুপারিশ করব।”
তাঁর সঙ্গে যাওয়া ছাড়া আবু সুফিয়ানের সামনে আর কোনো পথও নেই। আব্বাস রা. তাঁর খচ্চরের পেছনে আবু সুফিয়ানকে ওঠালেন। আসলে কিন্তু সেই খচ্চরটা খোদ নবিজির।
রাতের আঁধারে ১০ হাজার সৈন্যের বহরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন আব্বাস। আর তাঁর পিছে ইসলামের দুশমন আবু সুফিয়ান। এক এক করে সেনাব্যূহ পার হচ্ছেন। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করছেন, কে? আব্বাস রা. বলছেন, “আব্বাস। নবিজির খচ্চরে যাচ্ছি।”
নবিজির খচ্চরে যাচ্ছেন—কে আর কী বলবেন। নইলে এদের যে কেউ আবু সুফিয়ানকে সেদিন দেখামাত্র মেরে ফেলে। কিন্তু সামনে আব্বাস—তার ওপর নবিজির খচ্চরে, কেউ সাহস করছেন না আর কিছু বলতে।
যেতে যেতে সামনে পড়লেন উমার রা.। নবিজির নিরাপত্তায় আছেন তাঁরা। তিনিও আগন্তুক দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কে?” পরে চোখ দেখেই চিনতে পারলেন এ তো আবু সুফিয়ান। তাঁর চোখ চকচক করে উঠল, “আবু সুফিয়ান না? আল্লাহর দুশমন! আল-হামদু লিল্লাহ। আজ কোনো সন্ধি ছাড়াই আল্লাহ তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন!”
আব্বাস রা. বললেন, “দাঁড়াও উমার। উনি আমার নিরাপত্তায় আছেন।”
আপনাদের মনে আছে কি না—একজন মুসলিম যদি কারও জিম্মাদার হয় সে নিরাপদ। নবি সা. বলেছিলেন, যেকোনো মুসলিম চাইলে ব্যক্তিগতভাবে যে-কারও জিম্মাদার হতে পারে। এমনকী ছোট কোনো বাচ্চাও। এটা ইসলামের এক চিরায়ত বিধি।
কিন্তু উমার সুযোগটা কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চাইছেন না। তিনি তাঁদের সাথে নবিজির তাঁবুতে গেলেন।
রাত অনেক গভীর। কিন্তু আবু সুফিয়ানের মতো দুশমন এখন দরজায়। নবিজির তাঁবুতে ঢোকার অনুমতি তাঁদের দেয়া হলো।
তাঁবুতে ঢুকেই উমার রা. সাথে সাথে আবু সুফিয়ানকে কতল করার অনুমতি চাইলেন। তিনি নবিজিকে বললেন, “আল্লাহর রাসুল, এই তো আল্লাহর দুশমন। কোনো সন্ধি বা চুক্তি ছাড়াই আল্লাহ তাকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।”
আব্বাস রা. বললেন, “না। সে আমার জিম্মায়।”
দুজনেই দুজনের কথায় পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। নবিজি কিছুক্ষণ চুপ করে শুধু শুনতে লাগলেন। এক পর্যায়ে আব্বাস রা. বললেন, “থামো তো উমার। আল্লাহর কসম, ও যদি আদি গোত্রের হতো, তখন কিন্তু তুমি ওকে এভাবে মারতে চাইতে না। কিন্তু ও যে আবদু মানাফ গোত্রের। এজন্য খুব সাহস দেখাচ্ছ।
আপনাদের মনে আছে কি না—আবদু মানাফ গোত্রে হাশিম আর উমাইয়া, এই দুই গোত্র ছিল। তারা কাজিন সম্পর্কে।
চাচা আব্বাস রা. গোত্রীয় যুক্তিতে বিষয়টা দেখতে চাইলেন। স্বাভাবিক—তিনি নতুন মুসলিম। গোত্রীয় ধারার চিন্তা এখনো তাঁর মধ্যে কিছুটা থাকবে। তাঁর এ কথা শুনে উমার রা. থামলেন। শুধু বললেন, “সাবধান আব্বাস। আল্লাহর কসম, আমার বাবা জীবিত থাকলে ইসলাম বরণ করলে যতটা খুশি হতাম, আপনার ইসলাম বরণে তারচে বেশি খুশি হয়েছিলাম। কারণ, আমার বাবা ইসলাম বরণ করলে নবিজি যত খুশি হতেন, তারচে আপনার ইসলাম বরণ করায় তিনি বেশি খুশি হয়েছেন।”
সুবহান আল্লাহ! আবু বাকরের বাবা যেদিন ইসলাম বরণ করেন, সেদিন তিনিও কিন্তু একই কথা বলেছিলেন। আবু বাকর রা. বলেছিলেন, তাঁর বাবার বদলে যদি আবু তালিব ইসলাম বরণ করতেন! কারণ, আবু তালিব ইসলামে শামিল হলে নবি সা. বেশি খুশি হতেন।
যা হোক, দুজনের মধ্যে উত্তেজনা চরমে। নবি সা. চাচাকে বললেন, “চাচা, আবু সুফিয়ানকে নিয়ে আপনার তাঁবুতে যান। কাল সকালে উনাকে আমার কাছে নিয়ে আসবেন।”
আব্বাস রা. সারা রাত চেষ্টা করলেন আবু সুফিয়ান যেন ইসলাম বরণ করে। কিন্তু তার মনের দোনোমনা ভাব তখনও যায় না।
সকালে তাঁরা দুজন নবিজির সামনে এলেন। নবি সা. বললেন, “এখনও সময় হয়নি, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর স্বীকৃতি দেবেন?”
আবু সুফিয়ান বললেন, “আমার বাবা-মা তোমার জন্য কোরবান হোক। কী বলব—কী ভালো তুমি। কত দরদ তোমার। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করছ।”
মানে তিনি বলতে চাচ্ছেন, তিনি নিজে হলে কিন্তু অনুরূপ পরিস্থিতিতে এমনটা করতেন না। কিন্তু এখন তিনি বলছেন নবিজির জন্য নিজের আপন বাবা-মা কোরবান হোক—এর চে বড় তারিফ আর হয় না। কিন্তু শাহাদার ব্যাপারে বলছেন, “আল্লাহ ছাড়া যদি অন্য কোনো খোদা থাকত এতক্ষণে তারা নিশ্চয় আমাকে সাহায্য করত।”
এখান থেকে কী বুঝলেন? আসলে তাদের অনেকের মধ্যে মূর্তিপূজার ভূত এখনো সওয়ার। কুরেশি এই নেতা, চোখের সামনে নবিজিকে দেখছেন। ২৩ বছরে কত কিছুর সাক্ষী। অথচ এখনো লাত আর উজ্জাকে আল্লাহর পাশ থেকে সরাতে পারছেন না। ছোটবেলার ধর্মবিশ্বাস ছাড়া সত্যি কী যে কঠিন। এখনো মনে খটকা।
আব্বাস রা. আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। তিনি সাফ বলে দিলেন, “হয় মুসলিম হও নয় মরো।”
এতদিনের বন্ধু, এটুকু জোরাজুরির এখতিয়ার তাঁর আছে বই কী। দোনোমনা করতে করতেই আবু সুফিয়ান শাহাদা উচ্চারণ করলেন। কী কাহিনি—আল-হামদু লিল্লাহ!
বছরের পর বছর ধরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়ছেন। কত নির্যাতন চালিয়েছেন। কত হুমকি-ধামকি। আর এখন মুসলিম বাহিনী মাক্কায় ঢুকবে। এমন সময়ে কুরেশি এই সর্দার মুসলিম হলেন। আল্লাহর পরিকল্পনাটা দেখেছেন? দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পক্ষেও এমন কাহিনি সাজানো সম্ভব না।
একবার চিন্তা করুন। আব্বাস রা. বাদে অন্য কেউ যদি আবু সুফিয়ানকে এভাবে বাগে পেতেন জিন্দা রাখতেন? আর সময়টাও দেখুন। সব কিছু একদম খাপে খাপ। অন্য কোনো সাহাবি হলে আবু সুফিয়ানও এভাবে আস্থা রাখতে পারতেন না। আব্বাস রা. নবিজির খচ্চরে চড়ে কী সুন্দর মুসলিম শিবিরে ঢুকে গেলেন। সত্যি ভাই, আল্লাহ তাকদিরে এভাবে লিখে না রাখলে এটা অসম্ভব।
এত বছরের এত কাহিনির পর আবু সুফিয়ান অবশেষে মুসলিম।