এমন না যে তালাকের কোনো নিয়মই আপনি জানেন না। বরং, যা জানেন, তা খণ্ডিত ও একপাক্ষিক। এক অর্থে, পুরুষতান্ত্রিক। এই লেখাটা পড়লেই আপনি সেটা বুঝতে পারবেন।
আমি আলেম নই। কিন্তু একজন ঈমানদার মুসলমান। তালাক সংক্রান্ত বিষয়ে পড়াশোনা করে যা বুঝেছি তা শেয়ার করার জন্য এই পোস্ট। ইসলামের যারা ‘কপিরাইট’ নিয়ে, সৌল এজেন্ট হয়ে বসে আছেন তাদের সাথে কোনো প্রকার দ্বন্দ্বে যাওয়ার যোগ্যতা, ইচ্ছা বা প্রয়োজন, এর কোনোটাই আমার নাই।
বরং এ বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণসমূহ শেয়ার করার জন্য যাদের সাথে ওয়াদা করেছিলাম তাদের জন্য এই লেখা। এতে আমি তালাক নিয়ে কোনো গবেষণা করি নাই। তালাকের সাথে সংশ্লিষ্ট সবগুলো বিষয়কে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরাও এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং, সমকালীন বাস্তবতার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কিছু বিশ্রুত শরয়ী দিক তুলে ধরা এবং সেই সূত্রে পাঠকদের মধ্যে এ বিষয়ে একটা প্রপার রিয়েলাইজেশান গড়ে তোলাই আমার এই লেখার উদ্দেশ্য।
অতীব জরুরী ক্ষেত্রে এখানে অল্প কিছু রেফারেন্স ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া, পুরো আলোচনাটি ইসলামী শরীয়াহর মূলনীতি ও কাণ্ডজ্ঞানভিত্তিক। হিস্টরিক্যাল এন্ড রেফারেন্সিয়্যাল এপ্রোচে কথা বলা হলো এ ধরনের আলোচনার ট্রাডিশনাল ট্রেন্ড। এটি আমার অপছন্দ। আমি বরং যে কোনো তাত্ত্বিক বিষয়ে আলোচনার জন্য বিষয়ভিত্তিক পদ্ধতি বা থিমেটিক এপ্রোচকে ফলো করি। এখানেও এর প্রতিফলন ঘটেছে।
১। হালাল কাজসমূহের মধ্যে তালাক দান হলো নিকৃষ্ট। অথচ প্রফেট মুহাম্মদ (সা.) নিজেই তালাক দিয়েছিলেন
“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি রাসূলে কারীম (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, মহিয়ান গরিয়ান আল্লাহ তায়ালার নিকট সমস্ত হালাল কাজের মধ্যে ঘৃণ্যতম কাজ হচ্ছে তালাক।”
(আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ)
অথচ, আমরা জানি না, রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেই তালাক দিয়েছেন। যদিও ইদ্দতের মধ্যেই তিনি তা আবার ফিরিয়ে নিয়েছেন।
“হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (সা.) হযরত হাফসাকে (রা.) তালাক দিয়েছেন। পরে তাকে ফিরিয়ে নিয়েছেন।”
(হাদীস শরীফ, মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬৮)
রাসূল মুহাম্মদের (সা.) আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তাঁর স্ত্রীগণ তাঁর ওপর নানা ধরনের প্রেশার ক্রিয়েট করতো। এক পর্যায়ে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে তিনি তাদের সবাইকে বরাবর এক মাসের জন্য বয়কট করে আলাদাভাবে বসবাস করতে থাকেন। এরপর এ বিষয়ে কোরআনের আয়াত নাযিল হয়। তাতে বলা হয়,
“হে নবী, তোমার স্ত্রীদেরকে বলো, ‘তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও চাকচিক্য চাও তাহলে এসো আমি তোমাদের ভোগের ব্যবস্থা করে দেই এবং উত্তম পন্থায় তোমাদেরকে মুক্ত করে (তালাক দিয়ে) দেই। আর যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে চাও এবং আখিরাতে (সুখের) নিবাস প্রত্যাশা করো তাহলে আল্লাহ তোমাদের মধ্যে সৎকর্মপরায়ণদের জন্য এক বড় পুরস্কার (জান্নাত) প্রস্তুত করে রেখেছেন।”
(সূরা আহযাব, আয়াত ২৮-২৯)
সুস্থ সমাজ মানেই সুস্থ যৌন সম্পর্ক-ব্যবস্থা তথা সহজ বিবাহপ্রথা। আর সহজ বিবাহপ্রথার অপরিহার্য অংশ হলো সহজ, স্বচ্ছ ও ন্যায়ভিত্তিক বিবাহ-বিচ্ছেদের ব্যবস্থা সমাজে কায়েম থাকা। যখন তখন স্বেচ্ছাচার ও নিবর্তনমূলক তালাক চর্চা যেমন ক্ষতিকর; তেমনি করে ‘বিয়ে একবারই তো হয়’ এমন মনে করে ‘জনম জনম ধরে কাঁদিব, তবু ভাঙ্গিবো না এই বন্ধন কোনোক্রমে’ টাইপের মন-মানসিকতা ও সামাজিক রীতিও খুব খারাপ। অমানবিক।
২. তালাক কেবল স্বামী দিতে পারে
স্ত্রী তালাক দিতে পারে না। তবে চাইতে পারে। যে কোনো সময় এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে। কী কারণে সে তালাক চাচ্ছে তা উল্লেখ করাই যথেষ্ট। প্রমাণ করার কোনো বাধ্যবাধকতা নাই। যদিও আমাদের দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী স্ত্রী কেন তালাক চাচ্ছে সেই বিষয়টি আদালতে প্রমাণ করতে হয়।
এই তালাক চাওয়াটা হতে পারে পরিবারের অভিভাবকদের কাছে। কিংবা সমাজের মুরুব্বীদের কাছে। কিংবা কোনো আদালত বা ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে। অথবা, পর্যায়ক্রমে এদের সবার কাছে।
স্বামী চাইলে স্বীয় স্ত্রীকে তালাক দেয়ার জন্য তেমন নির্ভরযোগ্য কাউকে ক্ষমতা অর্পণ করতে পারে। যেমন করে যে কোনো নারী বা পুরুষ যে কাউকে উপযুক্ত কারো সাথে তার আকদ-নিকাহ সম্পন্ন করার জন্য পাওয়ার-অব-এটর্নি হিসেবে নিযুক্ত করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পাত্র বা পাত্রীর পরিবর্তে উক্ত ব্যক্তি ইজাব দেয়া বা কবুল করার মাধ্যমে উক্ত বিয়ে সম্পন্ন হবে। এটি বিয়ের মোহরানা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও হতে পারে।
ইসলামী শরীয়াহর এই অনুমোদনকে ব্যবহার করে তালাক সংক্রান্ত ইসলামী শরীয়তের মূল কাঠামোকে আমাদের দেশে উল্টিয়ে দেয়া হয়েছে।
সেদিন দেখলাম, রিচার্ড ডকিন্সের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কেউ একজন দাবি করেছেন, তিনি বিজ্ঞানের প্রামাণ্যতায় বিশ্বাস করেন না। কী আশ্চর্য কথা ….! লেনিনের রচনাবলীতে কতবার গড শব্দটির উল্লেখ আছে, সেই হিসেবটা বের করে কেউ একজন দাবি করলো, লেনিন ছিলেন একজন আস্তিক। দেখেন কারবার …! কনটেক্সট বাদ দিয়ে, কাটছাঁট করে কারো বক্তব্যকে এমনভাবে তুলে ধরা যাতে তিনি মূলত যা বলেছেন বা বলতে চেয়েছেন তারচেয়ে ভিন্নতর কিছু প্রতীয়মান হয়, এই কাজটাকে বলা হয় মিস কোটেশান।
তেমন করে কোরআন-হাদীসের অথেনটিক অথচ ইনএপ্রোপ্রিয়েট রেফারেন্সকে ব্যবহার করে শরীয়াহর মাকাসিদকে উল্টিয়ে দেয়া হলো কোরআন-হাদীসের মিস কোটেশনজনিত সমস্যা। এর অনেক উদাহরণ আমরা দেখতে পাই। যেমন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এক কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেটির উপরে একটা তাজা খেজুর ডাল লাগিয়ে দিলেন। এবং বললেন, যতক্ষণ এই ডালটি তাজা থাকবে ততক্ষণ উক্ত কবরবাসীর আযাব লাঘব থাকবে। ঘটনাটি সঠিক। এর থেকে এখানকার মুমিন-মুসলমানগণ রীতি উদ্ভাবন করেছেন, যখনই তারা কাউকে কবরস্থ করে তখন সেখানে তাজা ডাল রোপন করে দেয়। অথচ, রাসূলুল্লাহ (সা.) এই কাজটি, আমাদের জানা মতে, ওই একবার ছাড়া আর করেননি। রাসূল যেহেতু একবার এই কাজটা করেছেন, বার বার করতে নিষেধও করেননি; তাই আমরা এটি গণহারে করতে থাকি। অথচ সাহাবাগণও বিষয়টাকে এভাবে বিবেচনা করেননি।
রাসূল (সা.) বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে নামাজের পরে হয়তো সম্মিলিতভাবে ও সশব্দে মুনাজাত করেছেন। এর থেকে এখানকার বেরলভী ধারার মুসলমানেরা মাসয়ালা বের করেছেন, ফরজ নামাজের পরে সম্মিলিত মুনাজাত জায়েয। তারা বরং এটাকে কার্যত ওয়াজিব হিসেবে আমল করেন।
অতএব, কোনো কাজের অনুমোদন ও বিরল প্র্যাকটিস থাকাকে সেই কাজটি সচরাচর ও গণহারে করার বৈধতা হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। আপনারা জানেন, রাসূলুল্লাহর (সা.) জমানায়, সাহাবীদের জমানায়, প্রথম দিকে ফিকাহ বলতে আমরা এখন যা বুঝি, তা ছিল না। বরং কোনো আমলের ব্যাপারে রাসূলে করীম (সা.) ও সাহাবাগণ কী পরিমাণ গুরুত্বারোপ করেছেন সেইটার ভিত্তিতে হারাম, মাকরুহ, মুবাহ, সুন্নাত, ওয়াজিব ও ফরজ— এই টার্মগুলো চালু করা হয়েছে।
অনুসরণযোগ্য সময়কালে যে কাজকে ২০ ভাগ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, সেই কাজকে যদি কোথাও কার্যত ও স্থায়ীভাবে ৪০ ভাগ গুরুত্বও দেয়া হয়, তখন সেখানকার সৎপথপ্রাপ্তদের উচিত হবে, সেইটার বিরোধিতা করা। যেমন, কোনো জায়েয কাজকে যেখানে হারাম বানিয়ে নেয়া হয়, সেখানকার হকপন্থীদের জন্য ওই কাজটি করা ওয়াজিব হয়ে যায়। মনে পড়ছে, তখন আমরা বয়সে তরুণ। বিসিএসআইআর ল্যাবরেটরিজ মসজিদের খতীব ছিলেন মাওলানা মুনিরুজ্জামান ভাই। উনার সামনে কে যেন বললো, জালালী কবুতর খাওয়া নাজায়েয। তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ করে বললেন, তোমরা কেউ আমাকে একটা জালালী কবুতর ধরে দাও। এটি জবাই করে খাওয়া এখন আমার ওপর ওয়াজিব হয়ে পড়েছে। সত্যিই তিনি জালালী কবুতর ধরে খেয়েছেন কিনা, জানি না। খোঁজ নেইনি। কিন্তু ইসলামী শরীয়াহ অনুসরণের পদ্ধতি বোঝার জন্য একে বেশ প্রাসংগিক ঘটনা বলে মনে হলো।
মনে রাখতে হবে, হাদীস আর সুন্নাহ অভিন্ন নয়। মুসলমান হিসেবে আমাদের জন্য অনুসরণযোগ্য বাধ্যবাধকতা সুন্নতের সাথে রিলেটেড, সরাসরি হাদীসের সাথে নয়। যদিও কোনো বিষয়ে সুন্নাহসম্মত কর্মপন্থা নির্ধারণের কাজে সংশ্লিষ্ট হাদীসসমূহকে ব্যবহার করা হয়।
এত কথা বললাম যে কারণে তা হলো, এখনকার কাবিননামায় একটা ধারা সংযোজন করা আছে, যাতে নারীদের নিজেদেরকে নিজেরা তালাক দেয়ার ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। সবাই সাধারণত এতে সম্মতি দেয়। এর মাধ্যমে তালাক পুরুষরা দিবে এবং নারীরা চাইবে, ইসলামী শরীয়াহ নির্দেশিত এই তালাক ব্যবস্থাকে কার্যত পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তথা অস্থায়ীভাবে কোনো কিছুকে সমন্বয় করা আর এ ধরনের আপতকালীন বিশেষ ব্যবস্থাকে স্থায়ী রীতি বানিয়ে নেয়া, দুটো এক জিনিস নয়। ব্যতিক্রমী অনুমোদনের গণপ্রয়োগের মাধ্যমে যে কোনো ব্যবস্থার সামগ্রিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে উল্টিয়ে দেয়া সম্ভব। এ বিষয়ে লেখার শেষের দিকে আরো কিছু কথা বলা হবে।
৩। বিয়ে এবং তালাকে সাক্ষী দুইজন
বিয়ে ও তালাকের জন্য দু’জন পুরুষ সাক্ষীর সাক্ষ্য জরুরী। তালাক দেয়া বা চাওয়ার জন্য সাক্ষীর দরকার পড়ে না। কিন্তু তালাক কার্যকর হওয়ার জন্য ন্যূনতম সাক্ষ্য-এর উপস্থিতি জরুরী।
সব ধরনের সোশ্যাল ট্রানজেকশানের মতো ইসলামে বিয়ে করা ও বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার কাজ দুটিও অত্যন্ত সহজ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া। যা কিছু বাহুল্য, আড়ম্বর, আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ ও দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া; তা সবই হলো সংশ্লিষ্ট সমাজের কালচারাল কনস্ট্রাক্ট।
আজকালকার তরুণদের কাউকে কাউকে দেখি, নিজের গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ছবি দেয়। ছবির ক্যাপশানে বলে বা বাস্তব সাক্ষাতে ঠাট্টাচ্ছলে বলে, “দেখো, আমার বউ”, অথবা বলে, “আমার বউ আমার জন্য এইটা বানাইয়া আনছে”। তারা বুঝতে পারে না, এভাবে বিবাহযোগ্য কোনো নারীকে কোনো পুরুষ যদি প্রত্যক্ষভাবে স্ত্রীসুলভ কোনো কথা দ্বারা পরিচয় করিয়ে দেয়, উক্ত নারী যদি সেইটার প্রতিবাদ না করে, তাহলে তাদের মধ্যে ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী বৈবাহিক সম্পর্ক কায়েম হয়ে যাবে। মোহরানা নির্ধারণ না হলেও।
মোহরানা বিয়ের অপরিহার্য শর্ত এবং বিয়ে পূর্ণাঙ্গ হওয়ার জন্য যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার সাথে সাথে মোহরানা পরিশোধ ওয়াজিব হয়ে পড়ে। কিন্তু বিয়ের মজলিশে কোনো কারণে মোহরানা নির্ধারণ না হলেও বিয়ে বৈধ হবে। উক্ত নারীর পরিবারের অন্যান্য নারীদের বিয়ের সময় নির্ধারিত মোহরানার একটা গড়পরতা পরিমাণ তখন মোহরানা হিসেবে ধার্য বা প্রদেয় হবে।
এ ধরনের ‘বেসরকারী বিয়ের’ পরে রীতিসিদ্ধভাবে তালাক হওয়া ছাড়া উক্ত নারী যদি অন্যত্র বিয়ে করে তখন তা হবে বিয়ের ওপর বিয়ে করার মতো ব্যাপার। একজন স্বামীর সাথে তালাক ছাড়া অন্য স্বামী গ্রহণ করার মাসয়ালা কী, আশা করি তা বলে দিতে হবে না। আর ছেলে বা মেয়ে বন্ধুর সাথে এ ধরনের ‘বেসরকারী বিয়ের’ পরে ফিজিক্যাল রিলেশন হয়েছে কি হয় নাই, সেইটা বিয়ে কায়েম হওয়ার কোনো ইস্যু নয়। সেইটা বরং উক্ত বিয়ে ভেঙ্গে দেয়া বা তালাকের সাথে রিলেটেড ইস্যু।
৪. পিতার নির্দেশে স্ত্রীকে তালাক দেয়া
হ্যাঁ, পিতার নির্দেশে স্ত্রীকে তালাক দিতে ছেলেসন্তান শরিয়ত মোতাবেক বাধ্য। আধুনিক মন-মানসিকতায় এবং একক পরিবারের মাইন্ডসেটসম্পন্নদের জন্য এটি খুব ‘অস্বস্তিকর’ হাদীস।
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম সাহেব তাঁর সংকলিত ‘হাদীস শরীফ’ গ্রন্থে এই হাদীসটি উদ্ধৃত করার সময় দেয়া শিরোনামে পিতার সাথে মাতা-ও যোগ করে দিয়েছেন। এভাবে কত ‘ভেজাল’ যে উনারা হাদীসের নামে চালানোর চেষ্টা করেছেন তার আরো কিছু কিছু নমুনা আমি এই প্রবন্ধে খানিকটা তুলে ধরবো। কাউকে হেয় করার জন্য নয়। বরং, শত শত বছর ধরে চলে আসা canonical tradition, বিশেষ করে চলমান ইসলামাইজেশন প্রকল্পের বেসিক ফ্ল’র দিকগুলো দেখিয়ে দেয়া এর উদ্দেশ্য। মাওলানা আবদুর রহীমের মতো এত বড় মাপের আলেম আমার জীবদ্দশায় পাবো না, এটি আমি নিশ্চিত। আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি আন-প্যারালাল। নারী অধিকার ইস্যুতে সচেতন থাকার ব্যাপারে উনারই এই অবস্থা! তাহলে অন্যদের অবস্থা কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
পরবর্তীতে যুগের প্রয়োজনে গড়ে উঠা ফিকাহর লেন্সের ভিতর দিয়ে আল্লাহর রাসূলের (সা.) সুন্নাহকে বুঝতে চাওয়ার বিপদ সম্পর্কে আকরাম নদভীর নিম্নোক্ত বক্তব্যটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কথাগুলো তিনি ইসলামিক ফাইন্যান্স নিয়ে বললেও আলোচ্য বিষয়েও এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন,
“লোকেরা প্রায়ই ইসলামের প্রামাণ্য উৎস তথা কোরআন ও সুন্নাহ এবং এই উৎসের আলোকে মুসলিম স্কলারদের গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত (rulings) — এতদুভয়ের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। সাধারণ মুসলমানরা যখন ইসলামের প্রাথমিক উৎসের সাথে পরবর্তীতে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো মিলাতে চায়, তখন এই বিভ্রান্তি মারাত্মক জটিলতা তৈরি করে। এটা তাত্ত্বিকভাবেও হতে পারে, আবার বাস্তবেও হতে পারে। আলোচনার সুবিধার্থে কোরআন-হাদীসের আলোকে পরবর্তীকালে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোকে (rulings) আমি ‘ডকট্রিন’ হিসেবে অভিহিত করবো। আর কোরআন-হাদীস তথা ইসলামের প্রাথমিক উৎসকে ‘গাইডেন্স’ হিসেবে অভিহিত করবো।
এখন আমরা বলতে পারি, ডকট্রিন হচ্ছে ইসলামের আইনী ও সাংস্কৃতিক এমন এক ধরনের ট্র্যাডিশন, যা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। আমরা এ ডকট্রিনগুলো অধ্যয়ন করি, এগুলোর প্রতি সম্মান দেখাই, এসব থেকে শিক্ষাগ্রহণ করি। এরচেয়ে ভালো কিছু জানা না থাকলে আমরা আমাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ হিসেবে এগুলো মেনে চলি। অথচ আল্লাহ তায়ালা তাঁর অনুগত বান্দাদেরকে পরকালে যে পুরস্কার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেটা আমাদের অনুসৃত ডকট্রিনের ভিত্তিতে নয়, বরং নিশ্চিতভাবেই তা নির্ভর করবে প্রাথমিক উৎসে বিদ্যমান গাইডেন্স অনুসরণের উপর। অবশ্য, প্রায় সময় সাধারণ মুসলমানরা সরাসরি গাইডেন্সকে মেনে চলার ক্ষেত্রে ডকট্রিন অনুসরণ করাকেই সবচেয়ে ভালো উপায় বলে মনে করে। ‘ইলম’ (জ্ঞান) ও ‘তাকওয়া’র (খোদাভীতি) ঘাটতি এর কারণ।
(সূত্র: ‘ইসলামিক ফাইন্যান্স: কল্পকথা বনাম বাস্তবতা’ — মোহাম্মদ আকরাম নদভী)
সে যাই হোক, পুত্রবধূকে তালাক দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদানের ক্ষমতা শাশুড়িকে দেয়া হয় নাই। কারণটা খুবই সংগত। সে বিষয়ে আর কথা বাড়াচ্ছি না। এ সংক্রান্ত হাদীসটি হচ্ছে,
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন,
“আমার এক স্ত্রী ছিল। আমি তাকে ভালোবাসতাম। কিন্তু আমার পিতা ওমর তাকে অপছন্দ করতেন। এই কারণে তাকে তালাক দেয়ার জন্য আমাকে আদেশ করলেন। কিন্তু আমি তা করতে অস্বীকার করলাম।
তখন তিনি নবী করীমকে (সা.) বললেন,
‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমার পুত্র আব্দুল্লাহর একজন স্ত্রী আছে। কিন্তু আমি তাকে তার জন্য অপছন্দ করি। এ কারণে তাকে তালাক দেয়ার জন্য আমি তাকে আদেশ করেছি। কিন্তু সে আদেশ পালন করতে অস্বীকার করছে।’
এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বললেন, ‘তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দাও।’
এরপর, আমি তাকে তালাক দিয়ে দিলাম।”
(আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ, তিরমিজি ও নাসায়ী)
৫. হায়েয অবস্থায় তালাক দেয়া যাবে না
সরাসরি একটা হাদীস দিয়ে আমরা আলোচনাটা শুরু করি,
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি তার এক স্ত্রীকে তালাক দিলেন এমন এক সময়ে যখন তার স্ত্রী ছিলেন ঋতুবতী। এটি রাসূলুল্লাহর (সা.) জীবিত থাকা সময়ের ঘটনা। তখন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এ বিষয়ে রাসূলে কারীমকে (সা.) জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে রাসূলে করীম (সা.) বললেন, ‘তাকে আদেশ করো সে যেন তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়। এরপর তাকে রেখে দেয়। পরে সে যখন হায়েজ অবস্থা থেকে পবিত্র হবে, পরে আবার ঋতুবতী হবে, পরে আবার পবিত্র হবে; তখন ইচ্ছা করলে পরবর্তী কালের জন্য তাকে রেখে দিতে পারে। ইচ্ছা করলে তালাকও দিতে পারে। তবে তা স্পর্শ করার পূর্বে দিতে হবে।’
(বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ)
আল্লামা খাত্তাবির রেফারেন্সে মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, হাদীস শরীফ তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭৯-এ এই হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন,
“হায়েজ অবস্থায় তালাক দেওয়া বিদআত—সুন্নত বিরোধী কাজ।” এ কথা বলার পরে তিনি বলেছেন, খেয়াল করেন, “বিদআত পন্থায় তালাক দিলেও তাহা কার্যকর হয় যেমন কার্যকর হয় সুন্নত পন্থানুযায়ী দেওয়া তালাক। কেননা, তাহা যদি কার্যকর না হইতো তাহা হইলে স্ত্রীকে ফিরাইয়া লইতে বলার কোনই অর্থ হয় না।”
এক পর্যায়ে তিনি বলেছেন,
“এই হাদীস হইতে শরীয়াতের কয়েকটি বিধান জানা যায়:
(১) স্ত্রীর হায়য অবস্থায় তাহাকে তালাক দেওয়া হারাম। এই কারণেই হযরত উমর (রা)-এর নিকট হযরত ইবনে উমর (রা)-এর তালাক দানের বিবরণ শুনিয়া রাসূলে করীম (স) রাগান্বিত হইয়াছিলেন।”
এটুকু বলার পরে মাওলানা আবদুর রহীম সাহেব বলছেন, “ইহা সত্ত্বেও যদি কেহ হায়য অবস্থায়ই তালাক দেয় তবে তাহা সংঘটিত হইবে।”
অন্যান্য আলেমদের থেকে উনার একটা স্বাতন্ত্র্য হলো, উনি যা সমর্থন করেন না, এমন মতকে বেমালুম গায়েব করে দেন নাই। বরং খানিকটা হলেও উল্লেখ করেছেন। এ পর্যায়ে তিনি উপর্যুক্ত বক্তব্যের পরে বলছেন,
“তবে কাহারও কাহারও মতে (হায়েয অবস্থায়) তালাক দিলেও তাহা কার্যকর হবে না। ইহা জাহেরী ফিকাহবিদদের মত। কোন কোন তাবেয়ীও এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহাদের সংখ্যা নগন্য।”
এরপর হায়েয অবস্থায় দেয়া তালাক কার্যকর হওয়ার পক্ষে তিনি যে ‘অকাট্য’ দলীলটি পেশ করলেন তা নিম্নরূপ,
“(৬) ইমাম আবূ হানীফা এই হাদীসের ভিত্তিতে বলিয়াছেন যে, স্ত্রীর হায়য অবস্থায় তালাক দেওয়া হইলে স্বামী গুনাহগার হইবে। স্ত্রীকে ফিরাইয়া লওয়া তাহার কর্তব্য। যদি ইদ্দাতের মধ্যে ফিরাইয়া না লয় বরং ইদ্দাত শেষ হইয়া যায়, তাহা হইলে এক তালাকেই স্ত্রী হারাম হইয়া যাইবে।”
(প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৮১-২৮২)
রাসূলুল্লাহর (সা.) স্পষ্ট হাদীসের নির্দেশ কীভাবে পরবর্তী ইমাম ও আলেমদের হাতে সম্পূর্ণ উল্টে যায়, তার আরো কিছু নমুনা আপনারা পরবর্তীতেও পাবেন। ভেরি আনফরচুনেইট …! এ ধরনের মন্তব্য করার জন্য আমি খুব দুঃখিত।
৬। প্রত্যাহারযোগ্য এবং অপ্রত্যাহারযোগ্য তালাক
তালাক প্রধানত দুই প্রকার: প্রত্যাহারযোগ্য বা রিজঈ তালাক এবং অপ্রত্যাহারযোগ্য বা বাঈন তালাক। এটি তালাকের প্রধান শ্রেণীবিভাগ। এই দুইটাকে ঠিক রেখে খুটিনাটি নানা বিষয়ের ভিত্তিতে আরো বেশ কয়েক প্রকার তালাকের বিবরণ ফিকাহর কিতাবাদিতে বর্ণনা করা আছে।
স্ত্রী হায়েয হতে পবিত্র হওয়ার পর শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বে তালাক দিলে সেই তালাক হবে রিজয়ি তথা রুজু করা যায় এমন তালাক। আগেই বলেছি, তালাক দেয়ার জন্য সাক্ষী লাগে না। তবে তালাক কার্যকর করার জন্য, অর্থাৎ তালাক যে দেয়া হয়েছে তা উপযুক্ত সাক্ষীদের সাক্ষ্যদান জরুরী। কারণ, এর সাথে জড়িত আছে পক্ষদ্বয়ের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধার বিষয়াদি। দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন কিংবা ভাঙ্গার ক্ষেত্রে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর পারস্পরিক সম্মতি থাকাটা নৈতিকভাবে জরুরী। সাক্ষ্য ইত্যাদি বিষয় হলো আইনগত বিষয়। যদিও এ ধরনের নেসেসারি আইনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাটাও তাদের প্রাসঙ্গিক নৈতিক দায়িত্ব।
তালাক সম্পর্কিত শরীয়াহসম্মত পদ্ধতি হলো, রিজয়ী তালাকের পরেও স্বামী-স্ত্রী এক ঘরে বসবাস করবে। ইতোমধ্যে যদি স্ত্রীর সাথে স্বামী শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তবে উক্ত তালাক প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। উক্ত তুহরেও যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন না হয়, এরপর আরো এ রকম দুই তুহর যদি অতিবাহিত হয়, তাহলে উক্ত নারীর ইদ্দত পালিত হয়েছে এবং তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয়েছে, এমনটা মনে করতে হবে।
মহান আল্লাহ তায়ালা এ ব্যাপারে বলেছেন,
“হে নবী! (তুমি তাদেরকে বলো) তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে চাও তখন তাদেরকে তালাক দাও তাদের ইদ্দাতের প্রতি লক্ষ্য রেখে, আর ইদ্দাতের হিসাব সঠিকভাবে গণনা করবে, (তালাক দেয়া ও ইদ্দাত পালন সংক্রান্ত শারীয়তের বিধি-বিধান পালনে) তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করো। তাদেরকে তাদের বাসগৃহ থেকে বের করে দিও না, আর তারা নিজেরাও যেন বের হয়ে না যায়, যদি না তারা স্পষ্ট অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়। এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। যে কেউ আল্লাহর সীমারেখা লঙ্ঘন করে, সে নিজের উপরই যুলম করে। তোমরা জানো না, আল্লাহ হয়তো এরপরও (স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতার) কোনো উপায় বের করে দিবেন।”
(সূরা তালাক, আয়াত ১)
এভাবে তালাক হওয়ার পরে উক্ত দম্পতি চাইলে আবার ইজাব-কবুল, মোহরানা ও সাক্ষীর উপস্থিতিতে রীতিসিদ্ধভাবে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। এরপরও যদি একইভাবে স্বামী তাকে আবার তালাক দেয় তাহলেও তারা চাইলে আবার বিবাহ বন্ধনের মধ্যে আসতে পারবে।
তৃতীয়বারও যদি অনুরূপ ঘটনা ঘটে তাহলে উক্ত স্ত্রী স্বাভাবিকভাবে অন্য কারো সাথে সংসার করার পরে যদি কোনো কারণে সেই বিবাহ স্বাভাবিকভাবে ভেঙ্গে যায় বা উক্ত স্বামী যদি মৃত্যু বরণ করে, তখন তারা চাইলে আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে।
তবে, স্ত্রী যদি তালাক নেয় তাহলে প্রথম বিচ্ছেদের পরে অন্যত্র তার বিবাহ হওয়া ও নিয়মানুযায়ী বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হওয়া ছাড়া উক্ত নারী উক্ত পুরষের সাথে আবারো দাম্পত্য সম্পর্কে আবদ্ধ হতে পারবে না।
উল্লেখ্য, বাঈন তালাক হলো অফেরতযোগ্য তৃতীয় তালাক।
৭. একসঙ্গে তিন তালাক দেয়া রাসূলুল্লাহর (সা.) হাদীসবিরোধী প্রথা, অথচ কীভাবে এর প্রচলন ঘটলো
হযরত ইবনে ওমরকে (রা.) যখনই কোনো তিন তালাকদাতা ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হতো তখনই তিনি সেই লোককে বলতেন, ‘তুমি যদি এক তালাক দুই তালাক দিতে (তাহলে তোমার পক্ষে খুবই ভালো হতো); কেননা, নবী করীম (সা.) আমাকে এরূপ করতে আদেশ করেছেন। বস্তুত যদি কেহ তাহার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে দেয় তাহলে সে তার জন্য হারাম হয়ে গেল, যতক্ষণ না সে অন্য স্বামী গ্রহণ করে।
(বুখারী ও মুসলিমে এই মারফু হাদীসটি বর্ণিত)
এ বিষয়ে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) কী বলেছেন তা খেয়াল করেন:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন,
আবদে ইয়াজিদের পুত্র বনু মুত্তালিবের ভাই রুকানা তার স্ত্রীকে একই বৈঠকে তিন তালাক দিয়েছিলেন।
ফলে এ জন্য তিনি খুব সাংঘাতিকভাবে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। তখন ইবনে আব্বাস বলেন,
রাসূলে করীম (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কীভাবে তোমার স্ত্রীকে তালাক দিলে?
রুকানা বললেন, আমি তাকে তিন তালাক দিয়েছি।
ইবনে আব্বাস বলেন, রাসূলে করীম জিজ্ঞেস করলেন, একই বৈঠকে দিয়েছো কি?
সে বলল, হাঁ।
তখন রাসূলে করীম (সা.) বললেন,
এটি তো মাত্র এক তালাক। কাজেই তুমি তোমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নাও, যদি তুমি ইচ্ছা করো।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, এরপর রুকানা তার স্ত্রীকে ফিরাইয়া লইলেন। ইহা হইতে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এইমত গ্রহণ করিলেন, তালাক কেবলমাত্র তুহরে (ইতোমধ্যে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় নাই এমন পবিত্রাবস্থায়) দেয়া বাঞ্ছনীয়।
(হাদীস গ্রন্থ মুসনাদে আহমদে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে)
এ বিষয়ে মুসনাদে আহমদে বর্ণিত অপর একটি আছার (সাহাবীর কথা) বর্ণিত হয়েছে। এটি সহীহ মুসলিমেও বর্ণিত হয়েছে:
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহর (সা.) যুগ, আবু বকরের (রা.) যুগ এবং ওমরের (রা.) খেলাফতের প্রথম দুই বৎসর তালাকের অবস্থা এই ছিল যে তিন তালাক দিলে এক তালাক সংঘটিত হইতো। পরবর্তীকালে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বললেন, যে ব্যাপারে লোকদের জন্য বিশেষ মর্যাদা, ধৈর্যসহ অপেক্ষা ও অবকাশ ছিল তাতে লোকেরা খুব তাড়াহুড়া করে ফেলছে। কাজেই আমরা এটাই তাদের উপর কার্যকর করবো না কেন? এরপর তিনি একে তাদের উপর কার্যকর করে দিলেন।
ইমাম তাহাবী হযরত ওমরের (রা.) বক্তব্যটি নিম্নোদ্ধৃত ভাষায় উল্লেখ করেছেন,
হে জনগণ, তালাকের ব্যাপারে তোমাদের জন্য একটা মহাসুযোগ দেয়া হয়েছিল। যে লোক আল্লাহর দেয়া এ সুযোগকে তালাকের ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত ও ত্বরান্বিত করবে আমরা তাকে উহার জন্য বাধ্য করে দেবো।
দেখা যাচ্ছে, তিন তালাক একসাথে দেয়াকে শাস্তির আওতায় আনার জন্য এবং এ ধরনের অপকর্মের প্রচলন রোধ করার জন্য সে সময়ের সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর কর্তৃত্বশীল অথরিটি বা উলিল আমর হিসেবে ওমর (রা.) শরীয়তের মূল ফরমেটের মধ্যে সাময়িক কিছু পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। স্পষ্টতই বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণ ছিল তাঁর লক্ষ্য। যেমন করে দুর্ভিক্ষের সময় তিনি চোরের হাত কাটার বিধান সাময়িকভাবে রহিত করেছিলেন। মাকাসিদে শরীয়াহর এই দিকটাকে উপেক্ষা করে আলেম ও ফকীহগণ ব্যাপারটাকে কোনদিকে নিয়ে গেছেন তা নিচের উদ্ধৃতি হতে লক্ষ করেন:
“হযরত উমর (রা.) এই ভাষণ দিয়াছিলেন সেই লোকদের সম্মুখে, যাঁহারা নবী করীমের (সা.) যুগে কী বিধান ছিল তাহা ভালো করিয়াই জানিতেন। কিন্তু তাঁহাদের কেহই হযরত উমরের (রা.) এই কথার প্রতিবাদ করেন নাই। কাজেই ইহা একটা অতিবড় ও অকাট্য প্রমাণ— ইহা সাহাবীদের ইজমা। নবী করীমের (সা.) যুগে অনেক ব্যাপারের এক রকমের তাৎপর্য ছিল, তাঁরই সঙ্গী-সাথীগণ সেই সবেরই ভিন্ন তাৎপর্য করিয়াছেন পরবর্তী কালে। ফলে ইহা এমন একটি দলীল হইয়া দাঁড়াইয়াছে যাহা পূর্ববর্তী তাৎপর্য বাতিল করিয়া দিয়াছে। সাহাবীদের ইজমা কোরআনের অকাট্য সুস্পষ্ট ঘোষণা— নস-এর মতই ইলমে ইয়াক্কীন দেয়। কাজেই এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ বা মত-বিরোধের অবকাশ থাকিতে পারে না। সাহাবীদের ইজমা ‘মশহুর হাদীস’ হইতেও অধিক বলিষ্ঠ। উহার ভিত্তিতে অকাট্য দলিল বা নস-এর উপর বৃদ্ধি সাধনও জায়েজ।”
(হাদীস শরীফ, মাওলানা আবদুর রহীম, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৯)
এরপরের পৃষ্ঠায় তিনি এ ব্যাপারে বলছেন,
“বস্তুত হাদীসের বর্ণনাকারীই যদি সেই হাদীসের মূল প্রতিপাদ্যের বিপরীত ফতোয়া দেন তাহা হইলে তাঁহার বর্ণনা অপেক্ষা তাঁহার ফতোয়া-ই গ্রহণের দিক দিয়া অগ্রাধিকার পাইবে, ইহা সর্বজনমান্য নীতি।”
এ প্রসঙ্গে আমার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। মুয়াবিয়ার (রা.) খেলাফতকালে একবার গমের দাম বেড়ে যায়। তিনি মদিনায় এসে মসজিদে নববীতে ভাষণ দিতে গিয়ে ফিতরা হিসেবে প্রদেয় গম নির্ধারিত পরিমাণের অর্ধেক দেয়ার জন্য লোকদেরকে বললেন। এরপর গমের দাম কত উঠানামা করলো। কিন্তু সেই থেকে, অন্তত আমাদের দেশে যা দেখা যায়, গমের ফিতরা এখনো খেজুর ইত্যাদির অর্ধেকই রয়ে গেল …! ফিতরা দিতে হয় প্রধান খাদ্য বা major crops হিসেবে যেসব খাদ্যদ্রব্য সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে প্রচলিত সেগুলোর মধ্য হতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ। তৎকালীন আরব দেশের প্রধান খাদ্য শস্যের তালিকায় চাল না থাকায় আমাদের দেশে এখনো ফিতরার শস্য হিসেবে চাল দেয়া স্বীকৃতি লাভ করে নাই।
এসব কিছু থেকে আমরা বুঝতে পারি, মাকাসিদে শরীয়াহ তথা শরীয়াহর উদ্দেশ্যকে উপেক্ষা করে শরীয়াহর বাহ্যিক কাঠামো বা পরবর্তীতে প্রবর্তিত সাময়িক ব্যবস্থাকে অলঙ্ঘনীয় আইনী ব্যবস্থা হিসেবে দাবি ও চর্চিত হয়ে আসছে। ব্যাপারটা দুঃখজনক।
তখনকার সময়ে যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্বের আসনে আসীন ছিলেন তারা তিন তালাক একসাথে দেয়ার এই নিবর্তনমূলক আচরণকে বন্ধ করার জন্য সেটাকে ইমিডিয়েটলি কার্যকর করে দেয়ার একটা সাময়িক রুলিং দিয়েছিলেন। অথচ, এখন তিন তালাক একসাথে প্রয়োগের মাধ্যমে নারীর মানবিক অধিকারকে অহরহ ভূলুণ্ঠিত করা হচ্ছে। এবং এ ধরনের তালাককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এরপরেও একসাথে দেয়া তিন তালাককে এক তালাক হিসেবে গণ্য না করে তিন তালাক হিসেবে গণ্য করার যে জোরালো ধর্মীয় অবস্থান ও তোড়জোড়; তাতে করে মূল টেক্সট পড়া না থাকলে যে কেউ মনে করতে পারে, এটি বুঝি কোরআনেরই প্রত্যক্ষ বিধান। আফসোস …!
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা) এ ধরনের কথা বলেছিলেন, মেয়েরা এখন যেভাবে সাজগোজ করে মসজিদে যায়, সেভাবে তাদেরকে মসজিদে যেতে দেখলে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করে দিতেন। সহীহ বুখারীতে হযরত আয়িশার (রা.) এই ধরনের অভিমতকে আছার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। নারীদেরকে মসজিদে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধ না করার জন্য স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (সা.) একাধিক হাদীস থাকা সত্বেও ফকীহগণ আয়িশার (রা.) উপরোক্ত হাদীসটিকে নারীদের মসজিদে যাওয়ার অধিকার রুদ্ধ করার জন্য দলীল হিসেবে ব্যবহার করেন।
এভাবে কোনো প্রমিন্যান্ট সাহাবীর কোনো বিশেষ আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের ভিত্তিতে কোরআন-সুন্নাহর কোনো সুস্পষ্ট বিধানকে স্থায়ীভাবে পরিবর্তন করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখা জরুরী। কোরআন-সুন্নাহকে কীভাবে বুঝতে হবে, সে ব্যাপারে কোরআনে ও হাদীসে ক্লিয়ার-কাট কথাবার্তা বলা আছে। ফিকাহর কিছু কিছু বিষয় দেখে মনে হয় যেন সাহাবীদের কথা দিয়ে রাসূলুল্লাহর কথা বুঝতে হবে, হাদীস দিয়ে কোরআন বুঝতে হবে। অথচ, কোরআনের ব্যাখ্যা হলো হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.)। আর হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বুঝার জন্য সাহাবীগণের কথা ও কাজ সহায়ক সূত্র হিসেবে বিবেচনাযোগ্য।
ইসলামী শরীয়াহর এই তিন উৎসকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা বা বোঝার চেষ্টা হলো ভুল পদ্ধতি। আবার, এই তিনটাকে সমগুরুত্বে দেখাটাও ভুল। এ ব্যাপারে সঠিক পদ্ধতি হলো, শরীয়াহর নির্দেশ ও নির্দেশনা বুঝার জন্য কোরআনের স্পষ্ট বর্ণনাকে প্রায়োরিটি দেওয়া। এরপর হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.)। এরপরে সাহাবা আজমাইনের আমল। সাহাবীদের কথা ও কাজকর্ম হাদীস বুঝার জন্য কমপ্লিমেন্টারি সোর্স। মানদণ্ড নয়। হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেই নিজের মানদণ্ড। তেমনিভাবে কোরআন বুঝার জন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) হলো ক্ষেত্রবিশেষে সহায়ক সূত্র, কিন্তু মানদণ্ড নয় (interpretative source, not the primary criteria)। কোরআন নিজেই নিজের মানদণ্ড।
সুন্নাতুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) বুঝার জন্য এই প্রপার মেথডকে স্ট্রিক্টলি ফলো করাটা অত্যন্ত জরুরী। হেদায়েতের মূল উৎস হলো কোরআন। এরপর হাদীসের মর্যাদা। এরপর সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ ও তাবে-তাবেয়ীগণের আমল। এটি আমাদের জন্য সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের মতো প্র্যাকটিক্যাল বিষয়ের জন্যেও সমভাবে সত্য ও প্রযোজ্য।
এই বেসিক মেথডোলজিকে স্মরণে না রেখে এক্সপার্ট হতে শুরু করে সাধারণ লোকজন, এখান থেকে ওখান থেকে কিছু একটা রেফারেন্স পেয়ে, সেটাকে নিজের মন-মানসিকতা ও কালচারের সাথে মিলিয়ে কিছু একটা ‘ইসলামিক রুল’ বের করে ফেলে, যা শেষ পর্যন্ত ইসলামী শরীয়াহর মূল প্রস্তাবনা ও লক্ষ্যকেই টার্ন-ডাউন করে দেয়। সে জন্য এ ধরনের কোনো কিছু নিছক নির্ভরযোগ্য সূত্র হতে প্রাপ্ত হওয়াটাই সেইটা আমলযোগ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং, সেই বর্ণনাটিকে সংশ্লিষ্ট অপরাপর বর্ণনাগুলোর সাথে সামগ্রিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
এই কথাগুলো স্মরণে রেখে এবার নিচের কথাগুলোকে খেয়াল করেন।
কখনো কখনো কোনো কোনো বিষয়ে কোনো সাহাবী কোরআন-হাদীসের প্রচলিত বিধান হতে ভিন্নতর কিছু করেছেন বা বলেছেন। এর কারণ হতে পারে বিবিধ। হতে পারে তিনি তৎকালীন কোনো বিশেষ পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে কিছু একটা বলেছেন। একজন ফকীহ বা উলিল আমর হিসেবে যে কেউ এমনটি করার ক্ষমতা রাখেন। কোরআন-হাদীসের অংশ না হলেও কোরআন-হাদীসের আন্ডারস্ট্যান্ডিং হিসেবে গৃহীত কোনো রায় বা ফতোয়াতে তৎকালীন পরিবেশ ও পরিস্থিতির ছাপ বা প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। বরং, নামাজ, রোজা, যাকাত ও হজ্বের মতো মৌলিক ইবাদতের বিষয়গুলো বাদে যে কোনো সামাজিক বিষয়ে উলিল আমর বা যথাযথ অথরিটি কর্তৃক মাকাসিদে শরীয়াহ তথা বৃহত্তর কল্যাণকে বিবেচনা করে যে কেনো ধরনের সাময়িক ব্যবস্থা গৃহীত হতে পারে। সেটি বরং হওয়াই উচিত।
প্রচলিত ধরনের ফিকাহ চর্চায় এ ধরনের সাময়িক ও যুগনির্ভর ব্যবস্থাকে ‘ইজমা’র দোহাই দিয়ে শত সহস্র বছরের জন্য স্থায়ী বিধান হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। সমস্যাটা এখানে। ইজতিহাদ সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণা ও অন্ধ অনুসরণের অচলায়তনের জন্য এমনটি হয়েছে বা হতে পারে। যুগনির্ভর ইজমা যে যুগ পরিবর্তন হলে পাল্টে যেতে পারে, তা ফকীহগণ মানতে নারাজ। ওয়ার্ল্ড-ভিউ পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখার পরিবর্তে ইসলামকে তারা ডকট্রিনাল পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখেন। লিগ্যাল ডকট্রিন কনসেপ্টকে ফ্রেইম করে না বা করা উচিত নয়। বরং, কনসেপ্টের ভিত্তিতে, যুগের প্রয়োজনকে সামনে রেখে লিগ্যাল ডকট্রিন ফ্রেইম করা হয়। বা হওয়া উচিত।
যে বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর নবী করীমের (সা.) সুস্পষ্ট বক্তব্য আছে, সে বিষয়ে এর ভিন্নতর কোনো কিছুতে কীভাবে ইজমা হতে পারে, তা আমার কোনোক্রমেই বুঝে আসে না!
এখানে আর একটি কথা স্মরণ রাখা অত্যন্ত জরুরী। তা হলো, সাহাবীগণের যুগ ছিল উচ্চতম নৈতিক মানের যুগ।
তৎকালীন সময়ে ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে পাথর নিক্ষেপে হত্যার যতগুলো ঘটনার কথা জানা যায়, তার সবগুলোই ছিল স্বীকারোক্তিমূলক। চারজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য দিয়ে কারো যিনা প্রমাণিত হয়েছে এবং পাথর নিক্ষেপে আসামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, আজ পর্যন্ত এমন একটা ঘটনার কথাও জানা যায় নাই।
প্রসংগত উল্লেখ্য, এর কারণ হলো ব্যভিচার প্রমাণ হওয়ার জন্য যে ধরনের সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে হয় তা অত্যন্ত কঠিন। সংশ্লিষ্ট পুরুষটির লিঙ্গ নারীটির গোপনাঙ্গে পূর্ণভাবে প্রবিষ্ট হয়ে আছে, ফাহেশা চরিত্রের নয় এমন ৪ জন পুরুষ মানুষ একসাথে তা অপরিকল্পিত ও অনিচ্ছাকৃতভাবে দেখার পরে একসাথে আদালতে নিশ্চিত করে বলতে হবে।
এ বিষয়ে আমার পয়েন্ট হলো, সমাজ ও রাষ্ট্রে সামগ্রিকভাবে ইসলাম কায়েম থাকা এবং জনগণ অতীব উন্নত নৈতিক মানসম্পন্ন হওয়ার পরিবেশে প্রদত্ত মাসয়ালাকে এনে এ সময়কার রাষ্ট্রবিহীন ইসলাম ও অতীব নিম্নমানের চরিত্রসম্পন্ন জনগণের মধ্যে খণ্ডিতভাবে প্রয়োগের চেষ্টা যে কতটা অনুচিত, আশা করি তা আক্বলসম্পন্ন ও সমঝদার ব্যক্তিমাত্রই সহজে বুঝতে পারার কথা।
৮। হিল্লা বিবাহ প্রথার উৎপত্তি ও তা নিরসনের উপায়
স্ত্রীর পক্ষ থেকে তালাক কিংবা স্বামীর পক্ষ থেকে অফেরতযোগ্য তিন তালাক (বাঈন তালাক) প্রযোজ্য হওয়ার পরে সেই নারীর পুনর্বিবাহ ও তালাক যদি স্বাভাবিক নিয়মে সম্পন্ন হয়, তাহলেই কেবল তিনি পূর্বতন স্বামীর কাছে ফেরত যেতে পারবেন। এটি নিয়ম। আমরা জানি।
রাগের মাথায় তিন তালাক দিয়ে এরপর কারো সাথে নাম-কা-ওয়াস্তে আকদ পড়িয়ে দেয়ার অব্যবহিত পরে সেই নারীকে পূর্ব-নির্ধারিত চুক্তি বা সমঝোতা মোতাবেক তালাক দেয়া, এরপর নারীটির আগের স্বামীর সাথে তাকে আবার বিয়ে দেয়া, এটাই হলো হিল্লা বিয়ে। বেআইনী হওয়া সত্ত্বেও এই হাস্যকর কাজের একটা রেওয়াজ আমাদের দেশে প্রচলিত। এতদিন ভাবতাম, এটি নিছকই এক খারাপ রেওয়াজ। পড়াশোনা করে দেখলাম, বিয়ে বা আকদ বলতে কী বুঝায় সেইটা নিয়ে তাবেয়ীদের হাল্কা ভুল বুঝাবুঝি বা মতভেদের ছিদ্র দিয়ে এটি আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে মাওলানা আবদুর রহীম বলছেন,
“বিবাহ বলিতে এখানে কী বুঝানো হইয়াছে এবং কী কাজ হইলে প্রথম স্বামীর সহিত পুনরায় বিবাহিত হওয়া হালাল হইবে, এ বিষয়ে শরীয়তবিদ লোকেরা নানা কথা বলিয়াছেন। সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব এবং তাঁহার সমর্থকদের মত হইল, দ্বিতীয় একজনের সাথে শুধু বিবাহের আকদ হওয়াই যথেষ্ট। হাসান ইবনে আবুল হাসান বলিয়াছেন: কেবলমাত্র সঙ্গমই যথেষ্ট নয়। স্ত্রী অঙ্গে শুক্র নিষ্ক্রমণ হওয়া জরুরী। জমহুর আলেম ও বিপুল সংখ্যক ফিকাহবিদ বলেছেন, শুধু যৌন সংগমই যথেষ্ট। …
যে সব লোকের নিকট এই পর্যায়ের হাদীস পৌঁছায় নাই কিংবা পৌঁছিয়া থাকিলেও যাঁহারা এই পর্যায়র হাদীসকে সহীহ মনে করেন নাই, কেবলমাত্র তাহারাই দ্বিতীয় স্বামীর সহিত শুধু ‘আকদ-নিকাহ’ হওয়াকেই প্রথম স্বামীর পক্ষে তাহার হালাল হওয়ার জন্য যথেষ্ট মনে করিয়াছেন। কিন্তু এই পর্যায়ের হাদীস সহীহ না হওয়ার কোনই কারণ নাই।”
(প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৯২)
সহীহ বুখারীতে ইমাম আবু ইসমাইল বুখারী কর্তৃক উদ্ধৃত একটি হাদীস হতে জানা যায়,
হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দিলো। পরে সে স্ত্রী অন্য এক স্বামী গ্রহণ করলো। পরে সেও তাকে তালাক দিলো। এই সময় নবী করীমকে (সা.) জিজ্ঞাসা করা হলো, এই স্ত্রী লোকটি কি তার প্রথম স্বামীর জন্য হালাল? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘না। যতক্ষণ না এই দ্বিতীয় স্বামী তার মধু পান করেছে। যেমন করেছে প্রথম স্বামী।’
উপরের কথাগুলোর মানে হলো, শারীরিক সম্পর্কহীন বিয়ে অবশ্য বিয়ে, তবে তা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ বা কার্যকর হয় নাই। সে কারণে শারীরিক সম্পর্কের আগে স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক দেয়, তাহলে স্ত্রীকে প্রদেয় মোহরানা তাকে পরিশোধ করতে হবে না।
তালাক দেয়ার যে পদ্ধতি কোরআন ও হাদীসে বলা আছে তা যদি অনুসরণ করা হয় তাহলে
(১) হায়েজ অবস্থায় তালাক দেয়া যাবে না,
(২) শারীরিক সম্পর্ক করা হয়েছে এমন তুহরে তালাক দেয়া যাবে না।
(৩) তালাক দিতে হবে অসঙ্গমকৃত তুহরে এবং
(৪) তালাক দিয়ে একই ঘরে স্ত্রীর সাথে বসবাস করতে হবে আরো দুই তুহর।
(৫) কোনো অবস্থাতেই গর্ভবতী স্ত্রীকে তালাক দেয়া যাবে না।
ইসলামী শরীয়াহ অনুমোদিত তালাক সংক্রান্ত এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে অবাঞ্চিত তালাক দেয়া বা নেয়ার সুযোগ তেমন থাকবে না। থাকবে না হিল্লা বিয়ের তেমন কোনো অবকাশ বা প্রয়োজনীয়তা।
৯। বাধ্যগত পরিস্থিতিতে তালাক হয় না
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা.) বলতে শুনেছি, প্রতিবন্ধকতায় তালাক হয় না।
(আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ, মুসনাদে আহমদ ও মুস্তাদরাক-এ হাকিম)
অথচ, মাওলানা আবদুর রহীম সাহেবের হাদীস শরীফ, ৩য় খণ্ডের ২৯৩ পৃষ্ঠায় এই হাদীস উল্লেখ করে এর পরের পৃষ্ঠায় লিখেছেন,
“কুরআন ও হাদীস উভয় স্থানেই তালাক শর্তহীন ভাবেই সংঘটিত হওয়ার কথা ঘোষিত হইয়াছে। কাজেই তালাক যে অবস্থায়ই দেয়া হউক না কেন তাহা অবশ্যই সংঘটিত হইবে। জোর পূর্বক তালাক লওয়া হইলে— কাহারও চাপে পড়িয়া তালাক দিতে বাধ্য হইয়া তালাক দিলেও তাহা কার্যকর হইবে। ইহার স্বপক্ষে যুক্তিও রহিয়াছে।….”
বইটির সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠা থেকে আপনারা ওইসব যুক্তি পরখ করে দেখতে পারেন।
রাসূল (সা.) কী বলেছেন আর ফকীহগণ কী বলছেন, তা আপনি নিজেই মিলিয়ে নেন।
ফকীহদের এ ধরনের গ্রস মিসটেকের রুট খুঁজে পাবেন উনার উক্ত কিতাবের পরবর্তী পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত নিম্নোক্ত ঘটনা থেকে:
“আমর ইবনে শারাহীল হইতে বর্ণিত হইয়াছে, একটি স্ত্রীলোক তাহার স্বামীকে তালাক দিতে জোর পূর্বক বাধ্য করিল। সে তালাক দিয়া দিল। পরে এই মামলা হযরত ওমর ফারূক (রা)-এর সমীপে উপস্থিত করা হয়। তিনি সেই তালাককে কার্যকর করিয়া দেন।”
তালাক নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে হযরত উমর (রা.) তখনকার প্রেক্ষাপটে একজন উলিল আমর হিসেবে যা করেছিলেন শাস্তি ও শিক্ষা দেয়ার জন্য, ইংরেজীতে পেনালাইজ করা বলতে যা বোঝায়, সেই সাময়িক ব্যবস্থাটাকেই পরবর্তী ফিকাহবিদগণ কর্তৃক গ্রহণ করা হয়েছে স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে, at the cost of nullifying the confirmed decision of prophet Muhammad (s.)। ইজতিহাদের গতিশীলতা বুঝতে এই ব্যর্থতার দায় কার, তা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
ইসলামকে একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে না দেখে নিছক আইনী কাঠামো থেকে দেখার এই সমস্যার ব্যাপারে বিশেষভাবে বলেছেন শ্রদ্ধেয় আকরাম নদভী। প্রবন্ধের শুরুর দিকে তা উদ্ধৃত করা হয়েছে।
আমরা জানি, মুয়ামালাতের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে মূলনীতিটাই বড় কথা। কাঠামোটা সমন্বয়যোগ্য। এই বুনিয়াদী বিষয়টা যিনি বুঝতে অক্ষম তিনি আমার এই লেখাকে ঝামেলাপূর্ণ মনে করবেন, এটি স্বাভাবিক। কিন্তু যারা চিন্তাশীল, যারা সংবেদনশীল মন ও মননের অধিকারী, বিশেষ করে নারী অধিকারের ব্যাপারে যারা পজিটিভ, সোচ্চার, যারা একইসাথে চরমপন্থী পুরুষতন্ত্র ও উগ্র নারীবাদের উভয় প্রান্তিকতার বিরোধী, তারা আমার এই লেখা পড়বেন। উপকৃত হবেন। দাম্পত্যজীবনের এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিকটির ভালো-মন্দ সম্বন্ধে সচেতন হবেন। এটাই স্বাভাবিক।
১০। স্ত্রী যদি স্বামীর কাছ হতে খোলা তালাক নেয় তাহলে সে মোহরানা ফেরত দিতে বাধ্য
এটি আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে নাই। তাই শুরুতেই এ সম্পর্কিত একটা হাদীসকে আমরা সামনে রেখে এই বিষয়ে আলোচনা শুরু করি।
হযরত সাহল ইবনে হাসমা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, সাহল কন্যা হাবিবা, সাবিত ইবনে কায়েস ইবনে হিশাম আল আনসারীর স্ত্রী ছিল। পরে তাকে ঘৃণা করতে লাগল। কেননা, সে (সাবিত) একজন কুত্সিত চেহারা ও খারাপ আকার-আকৃতির লোক ছিল।
এই সময় সে (হাবিবা) নবী করীমের (সা.) নিকট এসে বলল,
‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি লোকটিকে দেখি বটে। কিন্তু মহান আল্লাহর ভয় যদি না থাকতো তাহলে আমি নিশ্চয়ই তার মুখের ওপর থুতু নিক্ষেপ করতাম।’
তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন,
‘তুমি কি তাকে সেই বাগানটা ফেরত দিবে, যা সে তোমাকে মোহরানা হিসেবে দিয়েছিল?’
সে বলল, ‘হ্যাঁ, দিব।’
তখন রাসূলে করীম (সা.) তাঁর (সাবিত) নিকট লোক পাঠিয়ে তাকে ডেকে আনালেন। হাবিবা বাগানটি তাকে ফেরত দিল। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিলেন।
হাদীস বর্ণনাকারী বলেছেন, এটি ইসলামে সংঘটিত প্রথম খোলা তালাক।
(হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে মুসনাদে আহমদ, মুসনাদে বাজ্জার ও তাবারানী ফিল কাবীরে)
স্বামী যখন তালাক দিবে তখন সে ইতোমধ্যে স্ত্রীকে যা দিয়েছে তা ফেরত নিতে পারবে না। বড়জোর সে মোহরানার সমপরিমাণ অর্থ ফেরত চাইতে পারে। তালাক দেয়া প্রাক্তন স্ত্রীকে কিছু উপহার ইত্যাদি দিবে। এটি মানবিকতা ও সৌজন্যতাবোধের জন্য সে দিবে। সন্তান জন্মদানের পূর্বে গর্ভবতী নারীকে তালাক দেয়া যাবে না। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান থাকলে এবং সেই সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব নারীটিকে বহন করতে হলে ভরণপোষণের খরচ সন্তানের পিতা হিসেবে উক্ত পুরুষ বহন করবে।
যারা মনে করেন, স্ত্রী তালাক নিলে সে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য নয়, তারা সূরা নিসার নিম্নোক্ত ২০ নং আয়াতটিকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। আল্লাহ তায়ালা বলছেন,
“তোমরা যদি এক স্ত্রীর পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হও এবং তোমরা তাদের কাউকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ দিয়ে থাকো তাহলে তোমরা তা হতে কিছুই গ্রহণ করো না।”
অথচ, এই আয়াতটিতে খোলা তালাকের কথা বলা হচ্ছে না। বরং, পুরুষের পক্ষ হতে দেয়া তালাকের কথা বলা হচ্ছে।
এ সংক্রান্ত অন্য একটা আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলছেন,
“তোমরা যদি আশঙ্কাবোধ করো যে স্বামী-স্ত্রী আল্লাহর সীমাসমূহ কায়েম ও রক্ষা করিতে পারিবে না (বা করিবে না), তাহলে স্ত্রী যে বিনিময় মূল্য দিবে তার ভিত্তিতে (বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত করায়) তাদের দুইজনের কোনো গুনাহ হবে না।”
এটি সূরা বাকারার ২৯ নং আয়াতে বর্ণিত। এ প্রসঙ্গে মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম বলছেন,
“আবূ বকর ইবনে আবদুল্লাহ মনে করিয়াছেন যে, সূরা বাকারার এই শেষোক্ত আয়াতটি সূরা নিসার উপরোদ্ধৃত আয়াতটি দ্বারা মানসুখ হইয়া গিয়াছে। অতএব তালাকের বদলে স্বামী স্ত্রীর নিকট হইতে কোন কিছু গ্রহণ করিতে পারিবে না— এই হুকুমই বলবত রহিয়াছে। (এর বিপরীতে,) ইবনে জায়দ প্রমুখ বলিয়াছেন, আবূ বকরের কথা যথার্থ নয়। বরং সূরা বাকারার এই আয়াতটি দ্বারা সূরা নিসার আয়াতটিই বরং মনসুখ হইয়া গিয়াছে।”
(প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০০)
আমি মনে করি, এই পয়েন্টে আলোচনার শুরুতে হাবিবার (রা.) যে ঘটনার বিবরণ আছে তা স্ব-ব্যাখ্যাত ও সুস্পষ্ট। সুতরাং, এ বিষয়ে আর বিশেষ কিছু বলা প্রয়োজন বোধ করছি না।
আপাতত শেষ কথা:
‘বিয়েকে সহজ করো, বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ককে কঠিক করো’— এই মূলনীতির ভিত্তিতে সমাজ গঠন করতে হলে সহজ বিয়ের পাশাপাশি চালু থাকতে হবে সহজ পুনর্বিবাহ। এর জন্য দরকার সহজতর অথচ ন্যায়সংগত বিবাহবিচ্ছেদের ব্যবস্থা। যে সমাজে তালাকপ্রাপ্ত নারীর পুনর্বিবাহ একটি সহজতর সমাজসিদ্ধ বিষয়, সে সমাজে তালাক হলো পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য মুক্তির উপায়। যে সমাজে, যেমন পাশ্চাত্য সমাজে, অধিকাংশ বিয়ে ভেঙ্গে যায়, তা অস্বাভাবিক। আবার যে সমাজে অসুখী দাম্পত্য সম্পর্কের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে স্বামী বা স্ত্রীর অথবা উভয়ের ব্যক্তিগত জীবন ধ্বংস হয়ে যায়, অথচ তারা বিবাহ-বিচ্ছেদ করতে পারে না, সেই সামাজিক ব্যবস্থাটিও নিঃসন্দেহে নিবর্তনমূলক ও অস্বাভাবিক।
গড়পরতা হিসেবে একপ্রকারে বলা যায়, অনূর্ধ্ব এক তৃতীয়াংশ সংখ্যক বিয়ে এক পর্যায়ে ভেঙ্গে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, যদি সেই সমাজে নারীদের পুনর্বিবাহ হয় একটি সহজতর স্বাভাবিক ঘটনা। যতই দেখে শুনে বিয়ে করেন না কেন, হতে পারে ভেতরকার পরিস্থিতি ‘অন্যরকম’। অনভিপ্রেত। সেটি হতে পারে নানা দিক থেকে। তাই তো ইসলামে আছে তালাকের ব্যবস্থা।
অথচ, আমাদের সমাজে আজকাল তালাককে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রধানত নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে। যখন তখন যে তালাক দেয়া যায় না, এটাই শতকরা আটানব্বই ভাগ পুরুষ জানে না। পুরুষদের এই স্বেচ্ছাচারিতায় মদদ দিচ্ছে আলেম সমাজ।
ডিভোর্সের বিরুদ্ধে কড়াকড়ি করতে গিয়ে বিয়ে ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা
এই অনাকাংক্ষিত পরিস্থিতির মোকাবেলায়, বিশেষ করে পাশ্চাত্য ব্যবস্থার আদলে নারী অধিকার রক্ষায় সরকার যা করছে তা কম ক্ষতিকর, এমন নয়। তালাক ঠেকানোর জন্য মোটা অংকের মোহরানা ধার্য করা হচ্ছে। দেশের আইন এই অপব্যবস্থাকে সমর্থন করছে। খোলা তালাকের ক্ষেত্রে মোহরানার টাকা ফেরত দানের ব্যবস্থা হাদীস-কোরআন দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও সেটাকে আমাদের আইনী কাঠামোয় অস্বীকার করা হয়েছে। এ ধরনের ট্রায়াল এন্ড এরর এপ্রোচে নারী অধিকার সংরক্ষণের জন্য যা কিছু করা হচ্ছে কার্যত তা নারী অধিকারকে আরো ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ঘরে ঘরে নারীরা আরো বেশি নির্যাতত হচ্ছে। মিরপুরে একটা মেয়েকে স্বামীগৃহে সবাই মিলে নির্যাতন করে মৃত-প্রায় মনে করে ফেলে দিয়েছে। পরে পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করার পর তারা বলেছে, তালাক দিলে ৮ লাখ টাকা মোহরানা বাবদ দিতে হতো। তাই তারা ভাবছিলো, মেরে ফেলে পুলিশকে লাখ দেড় লাখ টাকা দিলেই সব ‘ঝামেলা’ চুকে যাবে। ভাবা যায়, পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে …!
যে পাশ্চাত্যকে মডেল হিসেবে নিয়ে নারী অধিকার রক্ষার আইন-কানুন করা হচ্ছে সেখানকার পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। বিয়ে ভেঙ্গে গেলে সেখানে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সকল ব্যক্তিগত ও যৌথ সম্পত্তিকে ‘বৈবাহিক সম্পত্তি’ (matrimonial asset) হিসেবে গণ্য করে উভয়ের মধ্যে তা সমভাবে ভাগ করা হয়। স্বামীর পেনশনের অর্ধেক তার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী পেয়ে যায়। এমনকি স্ত্রীর পরকীয়ার কারণেও যদি সংসার ভাঙ্গে তাও এই ব্যবস্থা। সেক্ষেত্রে অবশ্য উক্ত স্ত্রী স্পাউজাল সাপোর্ট বা খোরপোষের টাকা (alimony) পাবে না।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তালাকের পরে নারীরা বিপুল সম্পদ ও টাকা-পয়সা মুফতে পেয়ে যায়। এ ধরনের আইনের বিষয়ে আমি নানাভাবে খোঁজ-খবর নিয়েছি। এরমধ্যে ইউটিউবে ভিডিও দেখেছি অনেক। উন্নত বিশ্বে থাকে এমন পরিচিত জনের সাথে কথা বলেছি। ডিভোর্স সংক্রান্ত এক একটা ভিডিওতে পুরুষেরা যে কী পরিমাণে গালাগালি করে মন্তব্য করছে তা সহজেই কল্পনাযোগ্য। একটি কথা কমন। সবাই বলছে, বাদ দাও ওসব। বিয়ে করারই দরকার নাই।
হ্যাঁ, তারা তাই করছে। একজন হোমলেস নারীর ভিডিও দেখলাম। সে একটা গাড়িতে থাকে। সে বললো, তার সবই ছিল। একদিন তার বয়ফ্রেন্ড বললো, সে আর ওর সাথে থাকতে চায় না। বাধ্য হয়ে তাকে সব ছেড়ে গাড়িটি নিয়ে বের হয়ে আসতে হলো।
মানবিক মর্যাদা রক্ষার জন্য ইসলাম চায় নারীদের থাকুক ন্যূনতম অর্থনৈতিক নিরাপত্তা
ইসলাম সম্পর্কে আমি যা পড়াশোনা করেছি, তাতে বুঝতে পেরেছি, ইসলাম চায়, সব নারীর একটা অর্থনৈতিক অবলম্বন থাকুক। অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা ছাড়া মানুষের মানবিক মর্যাদা রক্ষা হতে পারে না। সে জন্য খরচের কোনো দায়-দায়িত্ব না থাকা সত্ত্বেও ইসলামী শরীয়াহ নারীদের সম্পত্তির ভাগ দিয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে তা পুরুষের চেয়ে কম, কোনো কেনো ক্ষেত্রে তা পুরুষের সমান, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা সমপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট পুরুষ হতে বেশি। এ ব্যাপারে আমার লেখা এই আর্টিকেলটা পড়তে পারেন: “ইসলামী আইনে নারীদেরকে দেয়া হয়েছে কখনো কম, কখনো সমান ও কখনো বেশি সম্পত্তির উত্তরাধিকার”
ইসলামী শরীয়াহ নারীকে মোহরানা লাভের অধিকার দিয়েছে। এগুলো নারীদের সম্পত্তি লাভের অনলি সোর্স, এমনটি নয়। বরং, এগুলো হলো সিম্বলিক প্রোপ্রাইটারশীপ। যাকাত যেমন ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তি, সমগ্র নয়; তেমন করে মিরাস আর মোহরানা হলো নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার প্রতীক। ইসলাম চায়, স্বাধীন মানুষ হিসেবে নারীর ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা যাতে সব সময়ে প্রতিষ্ঠিত থাকে। সে যাতে সাহল কন্যা হাবীবার (রা.) মতো নিছক হ্যান্ডসাম না হওয়ার জন্যও বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
তালাকপ্রাপ্ত নারীর পুনরায় বিয়ে না হওয়ার দায় মোস্টলি নারীদের
তালাকপ্রাপ্তা নারীকে পুরুষরা বিয়ে করতে চায় না। পুরুষরা বিয়ে করতে চায় না, পুনর্বিয়ের কোনো নিশ্চয়তা নাই, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা নাই, এসব কারণে কোমর ভেঙ্গে যাক, কিন্তু বিয়ে ভাঙ্গা যাবে না, এমন মরনপণ হয়ে নারীরা সংসারকে আঁকড়ে পড়ে থাকে। এটি একটা ভিসিয়াস সার্কেলের রূপ লাভ করেছে। এই চক্র ভাঙ্গার বৃহত্তর দায় নারীদের। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনছেন। এর দায় নারীদের বেশি।
কোনো পুরুষ একজন তালাকপ্রাপ্ত নারীকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে প্রধান বাধাটা আসে তার স্ত্রীসহ পরিবারের অন্যান্য নারী সদস্যদের কাছ থেকেই। অথচ, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কোনো মেয়েলোকই তার ভগিনীর তালাক চাইতে পারবে না, এই উদ্দেশ্যে যে, তার পাত্রে যা কিছু আছে তার সবকিছুই সে একাই ঢালিয়া লইবে।” (তিরমিযী, ইবনে হাব্বান, বুখারী ও মুসলিম)
হাদীসে বলা হচ্ছে স্বামীর অপর স্ত্রীকে তালাক দেয়ার কথা বলতে পারবে না। আর আমাদের এখানে তো প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া বিয়ে করলে সাক্ষাৎ শ্রীঘর নিবাস! উপরে উদ্ধৃত হাদীসটিসহ এই ধরনের inconvenient হাদীসগুলো ইসলামী নারীবাদীদের দু’চোখের বিষ। সে যাই হোক, বলছিলাম, তালাকপ্রাপ্ত নারীদের পুনর্বিবাহ না হওয়ার এই অপচক্র ভাঙ্গার বৃহত্তর অংশের দায় স্বয়ং নারীদেরই। এর একটা অংশ তো উপরে বললাম।
এর অপর অংশ হলো, তালাক নিলে জীবনমানের অবনমন ঘটবে। সুখে থাকায় ব্যাঘাত হবে। স্ট্যাটাস কমে যাবে। তাই, যেভাবেই হোক, বিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে। স্বামীর পরকীয়াকে প্রবল আপত্তি সহকারে হলেও মানতে রাজী, কিন্তু স্বামী কর্তৃক অপর নারীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে নারাজি। এমনকি স্বামীহীনা সেই বিপদগ্রস্ত নারীটি যদি তারই নিবাসে থেকে একটা নিছক দাম্পত্য সুরক্ষার মধ্যে থাকতে চায়। এই যে অবস্থা, এটি কি পরিষ্কার সুবিধাবাদিতা নয়? মানবিক মর্যাদা বিসর্জন দিয়ে হলেও যারা বাহ্যত সুখে থাকতে চায়, তাদের পজিশন কী করে নৈতিক হতে পারে, তা আমার বুঝে আসে না। যারা ইতোমধ্যে তালাক দিয়েছেন বা পেয়েছেন, কিন্তু ভালো বিয়ে হচ্ছে না, তারা অপেক্ষায় থাকেন কোনো রাজপুত্তর এসে উনাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাবেন। বিবাহিত বলেন, অবিবাহিত বলেন, এই ধরনের Cinderella Syndrome তথা অবাস্তব পরনির্ভরশীলতাবোধ হতে খুব কম নারীই মুক্ত।
যার অধীনস্ত হয়ে থাকা যায়, এমন যোগ্য পুরুষ না পেলেও কোনো একজনকে কম যোগ্যতাসম্পন্ন, লেস চার্মিং পুরুষকে খুঁজে নেয়া অসম্ভব নয়, যদি সেটাকে মানসিকভাবে তারা গ্রহণ করে নিতে পারে। ডিমান্ড একটু কমিয়ে নিয়ে, কিছুটা এডজাস্ট করে নিজের একাকীত্বকে ঘুচিয়ে নিতে তারা মোটেও রাজী নয়। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষিত নারীদের মধ্যে এ ধরনের সমস্যা প্রকট।
পোশাকশ্রমিক ও খণ্ডকালীন গৃহকর্মী দুলারির কাহিনী:
আমাদের পারিবারিক বিল্ডিং ‘সৈনিক গৃহ’-এর দারোয়ান হারুন। ওর বউ দুলারি। দুলারির ফ্যামিলি হারুনের চেয়ে অধিকতর স্ট্যান্ডার্ড। ওর আগে বিয়ে হয়েছিল। তার একটা শারীরিক খুঁত আছে। সে কারণে তার বিয়ে ভেঙ্গ গেছে। ওই সংসারে তার একটা সন্তান আছে। এখানে এসে সে মিলে চাকরি নিয়েছে। চাকরির অবসরে পার্শ্ববর্তী বস্তি হতে এসে আমার বোনদের বাসায় সে ছুটা বুয়ার কাজ করতো। এরমধ্যে সে তার চেয়ে বয়সে ছোট, আর্থিকভাবে দুর্বল কিন্তু দেখতে হ্যান্ডসাম এই জামাইটাকে অর্থাৎ হারুনকে বিয়ে করে নিয়েছে। আমার বোনদের সাথে যোগাযোগ করে সে হারুনকে আমাদের বাসায় দারোয়ানের চাকরিটা নিয়ে দিয়েছে। এর আগ পর্যন্ত হারুনকে সে পালতো। হারুন হাওয়া বাতাস খেয়ে বেড়াতো। বলা যায়, হারুন হলো দুলারির house-husband।
হাউজ-হাজবেন্ড হলেও দুলারি হারুণকে অসম্মান করে না। একবার কে যেন হারুনের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল। সে জন্য সে হারুনকে নিয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় এসে বিচার দিয়ে গেছে। সম্প্রতি তাদের একটা পুত্র সন্তান হয়েছে।
আমি দেখি, জীবন সম্পর্কে অশিক্ষিত দুলারির যে উদার ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি তা অধিকাংশ শিক্ষিত নারীর মধ্যেই নাই। জীবন সম্পর্কে, দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে অধিকাংশ শিক্ষিত নারী এক ধরনের ফ্যান্টাসিতে ভোগে। শিক্ষা তাদেরকে আলোকিত করে নাই। অচলায়তন ভাংগার সৎ সাহস তাদের মধ্যে খুব কম। সরি টু সে, তারা অধিকাংশই সুবিধাবাদী।
পুরুষরা চাইলে সহজেই কুমারী মেয়ে বিয়ে করতে পারছে। তাই তালাকপ্রাপ্ত নারীদের, বিশেষ করে তাদের যদি সন্তান থাকে, তাহলে তাদের পুনর্বিয়ে হওয়াটা আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় অসম্ভব-প্রায়। আবার স্বামীর আগের ঘরে সন্তান আছে, এমন পুরুষকে বিয়ে করার ব্যাপারে অ-কুমারী নারীদের প্রবল আপত্তি। সম্প্রতি এক পরিচিতজন এমন অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। শুনে অবাক হয়ে গেছি। পুরুষ কিংবা নারী কেউই আরেকজনের ঔরসে বা গর্ভে হওয়া সন্তানকে নিজ সন্তান হিসেবে মেনে নিতে পারে না। এমনকি তারা এটি ভাবতেও পারে না।
অপর পক্ষের সন্তান খারাপ হতে পারে। তাতে কী? নিজের সন্তানেরাই আজকাল কি ততটা ভালো হচ্ছে?
জীবনকে যে কোনো পরিস্থিতিতে বৈধ ও নীতিসম্মত উপায়ে উপভোগ করা, অতিরিক্ত ও বহন-অযোগ্য বোঝা বহনের চেষ্টা না করা, নিজেকে রক্তমাংসহীন ফেরেশতা-তুল্য মনে না করা, সর্বোপরি একাকীত্বের যন্ত্রণা হতে মুক্তি লাভের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেকেরই উচিত বৈবাহিক বন্ধনের মধ্যে থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করা।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিয়ে সম্পাদন করে দাও; এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ণ তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে স্বচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।”
(সূরা নূর, আয়াত ৩২)
চাই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় জোরদার সামাজিক আন্দোলন
শেষ কথা হলো, সেই পুরনো কথা, সহজ বিয়ে। সহজ বিয়ের অপরপিঠে আছে সহজ পুনর্বিয়ে। নারীদের পুনর্বিয়ের সামাজিক বাধা দূরীভূত করার আগ পর্যন্ত তালাককে বা তালাকের ভয়কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ব্যাপারে পুরুষদের নিরস্ত করা যাবে বলে আমার মনে হয় না। নারীরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হলে, তাদের পুনর্বিয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকলে নারীকে নিবর্তন করার ব্যাপারে পুরুষেরা ভয় পাবে। এই কাজে সুনির্দিষ্ট তিনটি সাপোর্ট নারীদের পক্ষে থাকা চাই:
(১) বাবা-মা-ভাই-চাচা-মামাদের পক্ষ হতে তথা অভিভাবকের পারিবারিক সাপোর্ট,
(২) নারীর নিজস্ব লেখাপড়া ও ক্যারিয়ার সাপোর্ট ও
(৩) সোশ্যাল ট্যাবু থেকে মুক্ত সুস্থ মন-মানসিকতা ও ঋজু ব্যক্তিত্ব।
সোশ্যাল মুভমেন্টের কাজে নারীর মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হলো সিএসসিএসের একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এজেন্ডা। আমরা খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করতে চাই। নিছক সমালোচনা করার পরিবর্তে বাস্তবসম্মত করণীয়কে সকলের সামনে তুলে ধরতে চাই। জীবন ও জগত সম্পর্কে সুস্থ চিন্তার নারী-পুরুষদের সাথে আমরা চাই একটা মাঠের-ঐক্য বা মেলবন্ধন গড়ে তুলতে। সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তন ব্যতিরেকে আমি, আপনি বা কেউ-ই বিরাজমান সামাজিক অপসংস্কৃতির ক্ষতি হতে নিরাপদ থাকতে পারবো না। চিন্তার পরিশুদ্ধি ও স্ববিরোধমুক্ত কর্মউদ্যোগ ব্যতিরেকে হতে পারে না টেকসই সামাজিক পরিবর্তন।
আসুন, নির্বিবাদী আত্মস্বার্থবাদ কিংবা নেতিবাচক ‘প্রগতিবাদিতা’র পথ পরিহার করে একটা ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের কাজে আত্মনিয়োগ করি। অন্তত যতটা পারি পূরণ করি আমাদের শিক্ষার দায় ও বিবেকের দাবি। অলস চাওয়া দিয়ে সমাজ পরিবর্তন হয় না। সমাজ পরিবর্তনের কাজে নেতা-কর্মীদের হতে হয় প্রাণান্তকর সচেষ্ট। সুন্দর ব্যক্তিজীবন আর ক্যারিয়ার নিয়ে যারা সুখে জীবন কাটাতে আগ্রহী, সমাজ পরিবর্তনের কাজে কমফোর্ট জোন হতে বের হওয়ার ঝুঁকি নিতে নারাজ, তাদের সাথে আমি নাই। যতই তারা আদর্শবাদিতার কথা বলুক, তাদেরকে দিয়ে কাজের কাজ কিছু হবে না।
যারা অদম্য, অকুতোভয় ও আপসহীন, তারাই সমাজ গড়ার কারিগর। তাদের আদর্শবাদিতার ভিত্তি ও কাঠামো যা-ই হোক না কেন। আছো যারা মননে কর্মে স্বতঃবিপ্লবী, তারা আওয়াজ তোল উচ্চকণ্ঠে। বেছে নেই একটাই পরিচয়, আমরা সমাজ কর্মী, বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কর্মী। শুদ্ধ মানবিক পরিচয় ছাপিয়ে যাক আমাদের অন্য সব পরিচয়।
লেখকঃ মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
https://mozammelhq.com