জিয়াউর রহমানের আলোচিত-সমালোচিত-বিতর্কিত পাঁচটি বিষয়
Advertisements

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের বগুড়া জেলার নশিপুর ইউনিয়নের বাগবাড়ী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। শৈশবের কিছুকাল বাগবাড়ী গ্রামে থাকার পর লেখাপড়ার জন্য তিনি কলকাতায় আসেন। এই সময় তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষ বিভাজনের পর তিনি তাঁর পরিবারের সাথে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এরপর তিনি তাঁর পিতা-মাতার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান এবং করাচি একাডেমী স্কুলে ভর্তি হন। ঐ স্কুল থেকে তিনি ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি ১৯৫৩ সালে করাচির ডি.জে. কলেজে ভর্তি হন। একই বছর তিনি পাকিস্তানী সেনাবহিনীতে যোগাদানের চেষ্টা করে সফল হন এবং কাকুল মিলিটারি একাডেমীতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন। এরপর তিনি ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে আসেন। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে খালেদা খানমের সঙ্গে জিয়াউর রহমান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে খেমকারান সেক্টরে তিনি যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে দুর্ধর্ষ সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য যেসব তার কোম্পানি পুরস্কৃত হয়, তার ভিতরে তার কোম্পানিটিও ছিল। পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘হিলাল-ই-জুরাত’ খেতাবে ভূষিত করে। এছাড়াও তাঁর সেনাদল বীরত্বের জন্য দুটি ‘সিতারা-ই-জুরাত’ এবং নয়টি ‘তামঘা-ই-জুরাত’ পুরস্কার লাভ করে।

১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে পেশাদার ইনস্ট্রাক্টর হিসাবে যোগাদান করেন। সে বছরই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মেজর পদে উন্নীত হয়ে জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন। এরপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানিতে যান। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসাবে দায়িত্ব লাভ করেন।

স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার নিয়োগ করা হয় এবং ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ;ডেপুটি চিফ-অফ-স্টাফ’ পদে উন্নীত হন। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে এবং বছরের শেষের দিকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পান।

১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যার পর বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনীতি ও সেনাবাহিনীতে নানা অঘটন এবং চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন জিয়াউর রহমান।

ক্ষমতায় থাকাকালীন জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়।

জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনকালে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং কূটনীতিতে মৌলিক বাঁক বদল ঘটেছে। এসব ঘটনা অনেকের দৃষ্টিতে ইতিবাচক আবার অনেকের দৃষ্টিকে নেতিবাচক।

জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যেগুলো নিয়ে নানা আলোচনা, সমালোচনা এবং বিতর্ক রয়েছে।

বহুদলীয় রাজনীতির প্রবর্তন
জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হবার পরে বাংলাদেশ একদলীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় রাজনীতিতে ফেরে।

বহুদলীয় রাজনীতির পুনপ্রবর্তনের ফলে তৎকালীন বাংলাদেশে একটি মৌলিক পরিবর্তন আসে। এর ফলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ উন্মুক্ত হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭২ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় রাজনীতিতে ফিরে আসার নীতি কারণে ধর্মভিত্তিক দলগুলো সুযোগ পায়।

এর ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতাকারী জামায়াতে ইসলামীও রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পায়।

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে অনেকের মধ্যে তীব্র বিতর্ক রয়েছে। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করে, এর মাধ্যমে তিনি জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছেন।

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল বাঙালি।

কিন্তু জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হবার পরে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নামে নতুন ধারা চালু করেন এবং সংবিধানে সেটি অন্তর্ভুক্ত করেন।

বাংলাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ।

জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ বাংলাপিডিয়ায় লিখেছেন, “বাংলাদেশে বহুসংখ্যক বিভিন্ন মতের ও ধর্মের জাতিগোষ্ঠী বাস করে। তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মাত্রা ও ধরণ বিভিন্ন। তাই জিয়া মনে করেন যে, শুধুমাত্র ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, বরং ভূখণ্ডের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত।”

তবে জাতীয়তাবাদের এই বিতর্ক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরেও চলমান। রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমসের অধ্যাপক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ মনে করেন, ‘বাঙালি’ এবং ‘বাংলাদেশি’ জাতীয়তাবাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক একটি বিভাজিত সমাজ তৈরি করেছে।

তিনি বলেন, এই বিভাজন থেকে বাংলাদেশ এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাঁর মতে বাংলাদেশের রাজনীতি সবচেয়ে বড় ইমপ্যাক্ট বা প্রভাব ফেলেছিল জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা।

জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি
পর্যবেক্ষকদের অনেক মনে করেন, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বলয় থেকে বেরিয়ে আমেরিকা এবং চীনের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি হয়।

আমেরিকার পাবলিক ইউনির্ভাসিটি সিস্টেমসের অধ্যাপক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলেন, জিয়াউর রহমান ভারত-বিরোধী ভূমিকায় যাননি। তবে তিনি চীন, আমেরিকা এবং সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

এ তিনটি দেশের সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, জিয়াউর রহমানের সময় মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়।

অধ্যাপক আহমদ লিখেছেন. মুসলিম দেশগুলোর সাথে ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে একটি অনুচ্ছেদ যোগ করেন জিয়াউর রহমান।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জোট সার্ক গঠনের ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এছাড়া জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়।

স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে আপোষ
জিয়াউর রহমানের শাসনামল নিয়ে যে অভিযোগটি সবচেয়ে বেশি সেটি হচ্ছে, যেসব ব্যক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার রাজনৈতিক বিরোধিতা করেছিল কিংবা পাকিস্তান সরকারের প্রতি অনুগত ছিল তাদের মন্ত্রীসভায় স্থান দেয়া হয়।

এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন, শাহ আজিজুর রহমান। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদ নেতা নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সামরিক সরকার জাতিসংঘে যে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল সেটির অন্যতম সদস্য ছিলে শাহ আজিজ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর দালাল আইনে গ্রেফতার করা হয় শাহ আজিজুর রহমানকে। পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে ১৯৭৩ সালে মুক্তি লাভ করেন শাহ আজিজুর রহমান।

পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করেছেন।

তবে অনেকের ধারণা, জিয়াউর রহমান সবাইকে অন্তর্ভুক্ত হরে রাজনীতি ও সরকার পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন।

অধ্যাপক সাঈদ ইফতেখার বলেন, ” এটা ছিল জিয়াউর রহমানের কৌশলগত রাজনীতি। স্বাধীনতা বিরোধীদের অন্তর্ভুক্ত করা তার যতটা না আদর্শ ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক কৌশল।”

১৯ দফা কর্মসূচী

জিয়াউর রহমানের শাসনামলের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ১৯ দফা কর্মসূচী।

এই কর্মসূচীর মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিভিন্ন দিক অন্তর্ভুক্ত ছিল। জিয়াউর রহমানের সমর্থকদের মতে এই কর্মসূচী ছিল ‘উন্নয়নমুখী রাজনীতির’ অংশ।

অধ্যাপক এমাজউদ্দিনের বর্ণনা মতে ১৯ দফা কর্মসূচীর লক্ষ্য ছিল – কৃষি উৎপাদন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ,খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, ব্যক্তি খাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকাশ। এই কর্মসূচীর মধ্যে একটি আলোচিত বিষয় ছিল খাল খনন কর্মসূচী এবং গ্রাম সরকার ব্যবস্থা চালু করা।

অধ্যাপক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলেন, তৎকালীন প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমানের এসব কর্মসূচী গ্রামীণ রাজনীতিতে সাড়া ফেলেছিল। তবে জিয়াউর রহামনের প্রবর্তিত গ্রাম সরকার পদ্ধতি মৌলিক কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি।

বাংলাপিডিয়ায় অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘গ্রাম সরকার’ পদ্ধতি জিয়াউর রহমানের জন্য একটা সস্তা রাজনৈতিক ধারণাতে পরিণত হয়েছিল।

সূত্রঃ বিবিসি ,উইকিপিডিয়া

Advertisements