জাতীয় চার নেতাকে কেন হত্যা করা হয় - জাতীয় চার নেতাকে কেন হত্যা করা হয়? - সত্য ও নিরপেক্ষ সংবাদ
Advertisements

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার আড়াই মাস পর জেলখানার মত নিরাপদ স্থানে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও এম মনসুর আলীকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ড কলঙ্কজনক ও বেদনাদায়ক অধ্যায়।

আওয়ামী লীগকে উৎখাত করা হয়েছিল আগস্টেই। তাহলে কেন জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হলো? ‘৭৫ এর নভেম্বর নিয়ে আলোচনা আরো হতে হবে। কে বা কারা জেলখানায় ঢুকে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল তা হত্যা মামলার রায়ে জানা গেছে। মৃত্যুদণ্ডও হয়েছে মামলার আসামীদের। কিন্তু হত্যার পিছনে কারণ কি হতে পারে, সেটা  জানতে সাংবাদিক এন্থনী মাসকারেণহাস ও তৎকালীন রাজনীতি বিশ্লেষক এবং গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদের বয়ান কিছুটা সাহায্য করবে।

জাতীয় ৪ (চার) নেতা হত্যার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খুনী ফারুক সাংবাদিক এন্থনী মাসকারেণহাস -কে জানান যে …
“শেখ মুজিবকে আমরা যেভাবে উৎখাত করেছি, খোন্দকার মোশতাকও সেইভাবে উৎখাত হতে পারে। ঐ অবস্থায় ভারতের সহায়তায় কোন পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে গেলে, জেলে আটক জাতীয় চার নেতার যে কোন একজনকে টেনে এনে পাল্টা সরকার গঠনের ব্যবস্থা করা হবে। সুতরাং, তাদেরকে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করাটাই আমাদের কাছে নিরাপদ মনে হয়। ”
ফারুক – রশীদ মিলে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন। রশীদ -ফারুক একমত হন যে, মোশতাককে হত্যা বা পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটলে প্রথম কাজ হবে, প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে সরকারের শূন্যতা পূরনের জন্য সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ানো। একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে একটা “জল্লাদ বাহিনী ” দ্রুত কেন্দ্রীয় কারাগারে ছুটে গিয়ে তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানকে হত্যা করবে। হত্যা করার কাজটি দেওয়া হয় ফারুকের বিশ্বস্ত “তিন থেকে পাঁচ সেনা সদস্যের ” একটা বাহিনীর উপর। এই দলটা ছিল রিসালদার মুসলেহ উদ্দিনের দল যারা ১৫ই আগষ্ট শেখ ফজলুল হক মনিকে হত্যা করেছিল।
ফারুক আরো জানায় যে, “পরিকল্পনাটি করা হয়েছিল তাৎক্ষণিকভাবে যা স্বংয়ক্রীযভাবে কাজ করে!”

তৎকালীন রাজনীতি বিশ্লেষক এবং গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, “জেল হত্যাকাণ্ডের সাথে ৩রা নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কিত। কারণ মুজিব হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সে অভ্যুত্থান আওয়ামী লীগ বা বাকশালের পক্ষে হচ্ছে।”

কিন্তু খালেদ মোশাররফ এবং তার সমর্থকদের কার্যকলাপ থেকে এ ধরণের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে মি: আহমেদ উল্লেখ করেন।

মি: আহমেদ বলেন , “ক্ষমতাসীন মোশতাক বা তার সমর্থকরা চাননি যে, তাদের বিরোধী আরেকটি শক্তি শাসন ক্ষমতায় পুনর্বহাল হোক। ঐ ধরণের একটা সরকার যদি হতো তাহলে জেলে থাকা সে চারজন ছিলেন সম্ভাব্য নেতা।” তিনি বলেন এ সম্ভাবনা থেকে জেল হত্যাকাণ্ড হতে পারে।

পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর থেকেই হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থানের আশংকায় ছিল।

সেনাবাহিনীর মধ্যে ছিল এক ধরণের বিশৃঙ্খলা। সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। একদিকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং অন্যদিকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ।

তখন ঢাকা সেনানিবাসে মেজর পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি এসব ঘটনা প্রবাহ বেশ কাছ থেকে দেখেছেন। তার সে অভিজ্ঞতা নিয়ে মি: হোসেন একটি বই লিখেছেন ‘বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায়: ১৯৭৫-৮১’ শিরোনামে।

শেখ মুজিবকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা তখন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহেমদকে পরিচালনা করছিলেন। মি: হোসেন বলেন, বঙ্গভবনে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের সাথে সেনানিবাসের উর্ধ্বতন কিছু সেনা কর্মকর্তাদের একটা সংঘাত চলছিল।

মি: হোসেন বলেন, ” খন্দকার মোশতাক যে বেশিদিন ওখানে টিকবেন না, এটাও ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে একটা ধারণা জন্মেছিল। তখন আবার সিনিয়র অফিসারদের মধ্যেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল।”

শেখ মুজিবকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ধারণা করেছিলেন যে, কোন পাল্টা অভ্যুত্থান হলে সেটি আওয়ামী লীগের সমর্থন পাবে। সে ধরণের পরিস্থিতি হলে কী করতে হবে সে বিষয়ে মুজিব হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা কিছুটা ভেবেও রেখেছিলেন।

মি: হোসেন বলেন, “ঐ ধরণের ক্যু হলে তখনকার আওয়ামী লীগে যাতে কোন ধরণের লিডারশিপ না থাকে সেটাই তারা বোধ হয় নিশ্চিত করেছিল।”

হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ভেবেছিল যদি এই চারজন রাজনীতিবিদকে যদি হত্যা করা হয় তাহলে পাল্টা অভ্যুত্থান হলেও সেটি রাজনৈতিক সমর্থন পাবেনা।

খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান যে আওয়ামী লীগের সমর্থনে হবে এমন ধারণা সঠিক ছিলনা বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।

কিন্তু তারপরেও সে ধারণার ভিত্তিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় চারজন নেতাদের হত্যা করা হয় বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।

যদিও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল সেটির সাথে আওয়ামী লীগের কোন সম্পর্ক বা সমর্থনের বিষয়টি পরিষ্কার নয়।

হাসানুল বান্না
সহ সম্পাদক, ভাওয়াল বার্তা।

Advertisements