জহির রায়হানের গুম
Advertisements

জহির রায়হান নিখোঁজের প্রায় এক বছর পর (১৯৭৩ সালের ২২ শে জানুয়ারি) সাংবাদিক আহাম চৌধুরীর লিখা ‘জহির রায়হান হত্যা রহস্য আর কতদিন ধামাচাপা পড়ে থাকবে’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলেছিলেন, জহির রায়হান মিরপুর কলোনির অভ্যন্তরে যাননি। ক্যাম্প থেকেই তিনি নাকি নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন । কারা তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই খবরও কারো অজানা নয় । সরকার নিখোঁজ জহির রায়হানকে খুঁজে বের করার কোন আন্তরিকতা দেখায়নি বরং জহির রায়হান নিখোঁজের রহস্য ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কতদিন থাকবে এই ধামাচাপা?

“জহির রায়হানকে যে কোন উপায়ে আটকাতে হবে । তাঁর তদন্ত কমিটি ভেঙে দিতে হবে নতুবা তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দাও ” — এই নির্দেশ খোদার গায়েবী আওয়াজের মতোই সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছিল। তাই জহির রায়হানকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে চিরদিনের জন্য । মুজিবনগরে যে কজন রুই কাতলার সাথে জহির রায়হানের চিন্তাধারার সাথে বচসা হয়েছিল জহির হত্যাকাণ্ডে তারাও নাকি জড়িত রয়েছেন । জহির হত্যার পরিকল্পনা ১৫ দিন ধরে করা হয়েছিল । জহিরকে তিরিশে জানুয়ারি খাঁচায় পুরে একত্রিশ তারিখে অন্য একটি স্থানে সরিয়ে দেয়া হয়। সেখানে তাকে তদন্ত কমিটি ভেঙে দেয়ার আহবান জানানো হয় । বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্তের চিন্তা না করে ভাতের চিন্তা করতে বলা হয় ।

জহির রায়হানের হত্যাকারী দল আরও একদিন তাঁকে চিন্তা করার সময়ও নাকি দিয়েছিলেন – আর সেদিনটি নাকি ছিল উনিশ’শ বাহাত্তর সালের দ্বিতীয় মাসের প্রথম দিন যথা সর্বনাশা ফেব্রুয়ারির সর্বনাশা মঙ্গলবার।”

জহির রায়হানের প্রথম স্ত্রী প্রয়াত অভিনেত্রী সুমিতা দেবী এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন “জহির রায়হান নিখোঁজ এই নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বেশ লেখালেখিও হলো। একদিন বড়দি অর্থাৎ জহিরের বড় বোন নাসিমা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব বললেন, জহিরের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে এ রকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে। পরে নাসিমা আর কিছু বলেনি। টেলিফোন করেছিল যে রফিক, তাকে নিয়ে যখন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলো। তখন তাকে নাগরিকত্ব দিয়ে পুরো পরিবারসহ আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। এই ঘটনা জহিরের নিখোঁজ হওয়ার সম্পর্কে রফিকের ভূমিকাকে আরো সন্দেহযুক্ত করে তোলে আমার কাছে।’” (সূত্র : দৈনিক আজকের কাগজ, ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩)

দৈনিক আজকের কাগজ ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সংখ্যা ‘জহির রায়হানের হত্যাকারী রফিক এখন কোথায়’ শীর্ষক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে ‘রাহুর কবলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি’ গ্রন্থে সরকার সাহাবুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘আজকের কাগজের ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সংখ্যায় জহির রায়হানের হত্যাকারী রফিক এখন কোথায়’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জহির রায়হান নিখোঁজ এই নিয়ে লেখালেখি হলে একদিন বড়দি অর্থাৎ জহির রায়হানের বড় বোন নাফিসা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব বললেন, জহিরের নিখোঁজ নিয়ে এ রকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, জহির রায়হানের মতো একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা স্বাধীনতার পর নিখোঁজ হয়েছে এটা নিয়ে চিৎকার হওয়াটাই স্বাভাবিক। জহির রায়হান তার বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে মিরপুরে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হন। সম্ভব তাকে হত্যা করা হয়েছিল। সুতরাং তার হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে তার আত্মীয়-স্বজন সোচ্চার হতেই পারেন। কিন্তু শেখ মুজিব কেন জহির রায়হানের বড় বোনকে ডেকে নিয়ে নিখোঁজ করে ফেলার হুমকি দিলেন। কি রহস্য ছিল এর পেছনে? তাহলে কি বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে শেখ মুজিব এমন কিছু জানতেন, যা প্রকাশ পেলে তার নিজের কিংবা আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতির কারণ হতো? আর কেনইবা তড়িঘড়ি করে জহির রায়হানের তথাকথিত হত্যাকারী রফিককে সপরিবারে আমেরিকা পাঠিয়ে দেয়া হলো? রফিক কে ছিলেন/ কি তার রাজনৈতিক পরিচয়? (সূত্র : সরকার সাহাবুদ্দিন আহমদ, রাহুর কবলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঢাকা, পৃষ্ঠা-১০৮)

৯ আগস্ট ১৯৯৯ দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় জহির রায়হানের মেজো সন্তান অনল রায়হানের অভিযোগ। তিনি অভিযোগ করেন, “জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার এক ভুয়া তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। এই কমিটি কোনো কাজ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের প্যানপ্যানানি করে আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এলো …মুজিব হত্যার বিচার হচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১৯৭৫ সালে। এর আগে জহির রায়হানসহ অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। কই তাদের তো বিচার হলো না।”

১৯৯২ সালের ১লা মে তারিখে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন শাহরিয়ার কবির। সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে সত্যজিৎ রায় শাহরিয়ার কবিরকে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন,

-জহিরের ব্যাপারটা কিছু জেনেছো?

-তাকে সরিয়ে ফেলার পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করে যা বুঝতে পেরেছি তাতে বলা যায়, ৩০ জানুয়ারি দুর্ঘটনায় তিনি হয়তো মারা যাননি। তারপরও দীর্ঘদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।

-স্ট্রেঞ্জ! জহিরকে বাঁচিয়ে রাখার পেছনে কারণ কি?

-সেটাই ষড়যন্ত্রের মূল সূত্র বলে ধরছি। মিরপুরে দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলে গভীর ষড়যন্ত্র মনে করার কোনো কারণ ছিল না। আমি যতদূর জানি, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন যা অনেক রথী-মহারথীদের জন্যই বিপজ্জনক ছিল, সে জন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন ছিল।

শুধু তাই নয় শাহরিয়ার কবির আরেকটি গ্রন্থে জহির রায়হানের অন্তর্ধান সম্পর্কে বলেছিলেন – ‘৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর শহিদুল্লাহ কায়সারের মৃত্যুর সংবাদ শুনে জহির রায়হান একেবারেই ভেঙ্গে পড়েন।

… বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করে হানাদার বাহিনীর সহযোগী বহু চাই ব্যক্তির নাম সংগ্রহ করলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন তিনি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য তিনি আওয়ামী নেতৃত্বকেও দায়ী করেন। মুজিবনগর সরকারের সকল গোপন তথ্য ফাঁস করে দেবেন বলেও ঘোষণা করেন।

… তাঁর উপস্থিতি যাদের জন্য অস্বস্তিকর তারা এই পরিস্থিতির সুযোগ নেবে এটা খুব স্বাভাবিক। ৭২ এর ৩০শে জানুয়ারি মিরপুরে তাঁর অগ্রজকে (শহিদুল্লাহ কায়সার) খুঁজতে গিয়েছিলেন। তদন্ত করলে হয়ত জানা যেতো সেই অজ্ঞাত টেলিফোন কোত্থেকে এসেছিল, যেখানে তাঁকে বলা হয়েছিল শহিদুল্লাহ কায়সার মিরপুরে আছেন।

… এটাও বিস্ময় যে তাঁর (জহির রায়হানের) অন্তর্ধান নিয়ে কোন তদন্ত হয় নি। কেন হয় নি অনুমান করতে অসুবিধে হয় না।” – শাহরিয়ার কবির

[তথ্যসূত্র : একুশে ফেব্রুয়ারী / জহির রায়হান (ভূমিকা : শাহরিয়ার কবির) ॥ [ পল্লব পাবলিশার্স – আগস্ট, ১৯৯২ । পৃ: ১৩-১৬]

জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে প্রখ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেন উল্লেখ করেন, “স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও একটি প্রশ্নের জবাব আমি পাইনি। প্রশ্নটি হচ্ছে, জহির রায়হানের ব্যাপারে বিভিন্ন মহলের নিস্পৃহ আচরণ। একটি মানুষ যে এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। কেউ যেন তার খোঁজ রাখল না। আমরা ঘাতক দালাল নির্মূলের কথা বলি, গণআদালত করে গোলাম আযমের ফাঁসি দাবি করি। অথচ জহির রায়হানের নামটি চলচ্চিত্র জগৎ ছাড়া আর কোথাও উচ্চারিত হয় না। কেন হয় না, সে প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো কেউ এদেশে নেই।

mojib bahini

শহীদুল্লা কায়সারের অপহরণকারী এবিএম খালেক মজুমদারকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে মুজিব বাহিনী। পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

সাম্প্রতিককালে জহির রায়হান নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে নতুন তথ্য শোনা গেছে। বলা হয়েছে— পাকিস্তানি হানাদার বা অবাঙালিরা নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশই জহির রায়হানকে খুন করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অংশটির লক্ষ্য ছিল— বাংলাদেশকে স্বাধীন করা এবং সঙ্গে সঙ্গে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীসহ সামগ্রিকভাবে বামপন্থী শক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়া। এরা নাকি বামপন্থী বুদ্ধিজীবিদের হত্যার একটা তালিকা প্রণয়ন করেছিল। এদের ধারণা এ তালিকাটি জহির রায়হানের হাতে পড়েছিল। জহির রায়হানও জানত তার জীবন নিরাপদ নয়। তবুও সে ছিল ভাইয়ের শোকে মূহ্যমান। তাই শহীদুল্লা কায়সারের নাম শুনেই সে ছুটে গিয়েছিল মিরপুরে তারপর আর ফিরে আসেনি। এ মহলই তাকে ডেকে নিয়ে খুন করেছে।

তাহলে কোনটি সত্য? জহির রায়হানকে কারা গুম করেছে? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা, আল বদর, আল শামস্, না রাজাকার? নাকি মুক্তিবাহিনীর একটি অংশ? স্পষ্ট করে বললে বলা যায় – মুক্তিবাহিনীর এ অংশটি মুজিব বাহিনী।

১৯৭১ সালে প্রবাসী স্বাধীন বাংলা সরকারের অজান্তে গড়ে ওঠা মুজিব বাহিনী সম্পর্কে অনেক পরস্পরবিরোধী তথ্য আছে। বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হয়েছে, এ বাহিনী গড়ে উঠেছিল ভারতের সামরিক বাহিনীর জেনারেল ওবান-এর নেতৃত্বে। এ বাহিনী নাকি মিজোরামে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মিজোদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। এদের নাকি দায়িত্ব ছিল— রাজাকার, শান্তি কমিটিসহ বাংলাদেশের সকল বামপন্থীদের নিঃশেষ করে ফেলা। মুজিব বাহিনী সম্পর্কে এ কথাগুলো বারবার লেখা হচ্ছে। কোন মহল থেকেই এ বক্তব্যের প্রতিবাদ আসেনি। অথচ দেশে মুজিব বাহিনীর অনেক নেতা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে আছেন। তারা কোন ব্যাপারেই উচ্চবাচ্চ্য করছেন না। তাদের নীরবতা তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বক্তব্যই প্রতিষ্ঠিত করছে এবং সর্বশেষ জহির রায়হানের নিখোঁজ হবার ব্যাপারেও মুজিব বাহিনীকেই দায়ী করা হচ্ছে।”

– নির্মল সেন / আমার জবানবন্দি [ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ – ফেব্রুয়ারি, ২০১২ । পৃ: ৪০৫-৪০৬]

জহির রায়হানের সন্তান অনল রায়হান ১৯৯৯ সালে ‘সাপ্তাহিক ২০০০’ ম্যাগাজিনে ‘পিতার অস্থির সন্ধানে পুত্র’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন – “৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ এ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত ‘জহির রায়হানের খোঁজ চলছে … রহস্যজনক ফোন আসছে’ শিরোনামে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে “বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নিখোঁজ জহির রায়হানের অনুসন্ধানের জন্য মিরপুরে ব্যাপক তল্লাশি অব্যাহত রয়েছে । ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু, রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ, মিত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরা আলাদাভাবে দুটো বৈঠকে মিলিত হন। … অথচ এরমধ্যেও আসছে টেলিফোনে অজ্ঞাত পরিচয়ে নানা মহলের হুমকি”।

এসব পুরনো খবরের পাতা উল্টাতে উল্টাতে মনে হবে এক জীবন্ত মানুষের জন্য রাষ্ট্র, পত্রিকা বা মানুষজনের চিন্তার অন্ত নেই । কিন্তু এসব ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলো না কেন এবং তা নিরুত্তর রয়ে গেলো কেন?”

স্বাধীন বাংলাদেশের একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী’র সব অপকর্মের প্রামাণ্য দলিল হাতে পাওয়ায় সেই গোষ্ঠীটি সুকৌশলে জহির রায়হান’কে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলেছিল যার কূল কিনারা সেইসময়ের শাসকগোষ্ঠী তো করেই নি বরং জহিরকে গুম করার বিষয়টিকে ধামাচাপা ও বৈধতা দিতে ২৮ বছর পর কোন এক হাবিলদার কে চাক্ষুস সাক্ষী বানিয়ে ১৯৭২ সালের ৩০ শে জানুয়ারির ঘটনা শুনায় আর সেই স্বার্থান্বেষী মহলের হাতের পুতুল বর্তমানের অন্ধ যুব সমাজের একটি অংশ সেই মনগড়া কাহিনী প্রচার করে জহিরকে গুম করার অন্যায়টির বৈধতা দেয় । অথচ একবারও তাঁদের মনে নিচের প্রশ্নগুলো জাগে না—

১. ৩০শে জানুয়ারি জহির রায়হান বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের একটি রাজনৈতিক নেতাদের গোপন কিছু দুর্লভ তথ্য প্রমাণ প্রেসক্লাবে উপস্থাপন করার আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন সেদিন তাঁকে অপরিচিত (সরকারি এক কর্মকর্তা) এক ব্যক্তি ফোন করে মিরপুরে যেতে বলেছিল কেন?

২. সেদিন ছিল মিরপুর বিহারী পল্লীতে সামরিক অভিযানের দিন যেদিন ‘মিরপুর মুক্তদিবস’ পালন করা হয়। সেই সামরিক অভিযানে একজন বেসামরিক ব্যক্তিকে কেন সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করানো হলো? ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর শুধু শহিদুল্লাহ কায়সার একাই নিহত হোননি সেদিন আরও অনেক বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছিলেন, সেইসব বুদ্ধিজীবী পরিবারের কোন সদস্যকে তো সেই অভিযানে তাঁদের হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনকে পাওয়া যেতে পারে বলে তো মিরপুরে ডেকে আনা হয়নি, তবে কেন শুধু বেছে বেছে জহির রায়হানকে শহিদুল্লাহ কায়সারকে পাওয়া যেতে পারে বলে ডেকে আনা হয়েছিল? জহির তো নিজে থেকেই সেখানে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হোননি, তাঁকে ফোন করে সেই ঠিকানায় যেতে বলা হয়েছিল, কেন?

৩. জহির যে তথ্যপ্রমাণ ৩০শে জানুয়ারি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন সেইগুলো কোথায় কেউ কি বলতে পারবেন? জহির গুম হওয়ার সাথে সাথে সেই প্রমাণাদি গুলোও কি গুম হয়ে গেলো? জহির তো সাথে করে সেইসব প্রমাণাদি কিছুই নেননি।

৪. শহিদুল্লাহ কায়সার’কে পাওয়া যাবে এমন কারনে জহিরকে বেছে বেছে জানুয়ারির ৩০ তারিখেই কেন মিরপুরে যেতে বলা হলো? এর আগে বা পরে নয় কেন? …… এসব প্রশ্ন অন্ধদের মনে জাগবে না কোনদিন। সত্যি হলো জহির ২৬ শে জানুয়ারি বিকেলে ঘোষণা দিয়েছিলেন ৩০শে জানুয়ারিতে তিনি সব অজানা তথ্য প্রকাশ করবেন আর সেই ৩০ শে জানুয়ারি সকালেই জহিরকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিরপুরে নিয়ে সামরিক অভিযানের মধ্যে ফেলে হত্যা করে লাশ গুম করা হয় আর দোষ চাপিয়ে দেয়া হয় বিহারী পল্লিতে থাকা পাকবাহিনীর উপর। একজন বেসামরিক লোককে সামরিক অভিযানের সংরক্ষিত এলাকায় সেনাবাহিনী প্রবেশ করতে দিলো আর শত্রুপক্ষ সেই লোকটিকে হত্যা করে ফেললো এমন ‘আষাঢ়ে গল্প’ বিশ্বাস করে যারা তারা আর যাই হোক স্বাধীন বাংলাদেশের, স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বপক্ষের ব্যক্তি নয় । আজও সেই ঘাতক দালালরা এই বাংলার মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে । একদিক না একদিন এই বাংলার মাটিতে জহির রায়হানের খুনিদের বিচার হবেই হবে ইনশাল্লাহ।

জহির রায়হানের গুম : যেভাবে সফল হয় সুপরিকল্পিত কুচক্রান্ত (১ম পর্ব)

ছবি ও সহযোগিতায় : কায় কাউস ভাই, জুবায়ের আহমেদ ভাই, শামসুল আলম বাবু ভাই , শানু ভাই ও ক্যাপ্টেন নিমো।

জবান/ফজলে এলাহী

Advertisements