একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রাকিবুল ইসলাম (২৫)। রাত ১০টার দিকে ট্রেনটি থামে গাজীপুরের টঙ্গী রেল জংশনে। রাকিবুল তখন ট্রেনে জানালার পাশে মুঠোফোনে কথা বলছিলেন। হঠাৎ করেই হ্যাঁচকা টানে রাকিবুলের মুঠোফোনটি নিয়ে দৌড় দেয় এক ছিনতাইকারী। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন থেকে নেমে রাকিবুলও ছোটেন পিছু পিছু।
রেললাইন ধরে কিছুদূর যেতেই ওই ছিনতাইকারীকে ধরে ফেলেন রাকিবুল। শুরু হয় দুজনের ধস্তাধস্তি। একপর্যায়ে তাঁর বুকে চাকু মেরে বসেন ওই ছিনতাইকারী। মাটিতে পড়ে যান তিনি। গুরুতর আহত রাকিবুলকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। গত ৬ মার্চ রাতের এ ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের কাছ থেকে।
ঢাকার এয়ারপোর্ট থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত রেলপথটুকু ট্রেন ভ্রমণকারীদের কাছে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। অরক্ষিত স্টেশন, স্টেশনে বহিরাগতের আনাগোনা বা রাস্তায় ওত পেতে থাকা ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। অনেক সময় চলতি ট্রেনে থাবা বা ঢিল মেরে চলছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। রাকিবুলের মতো অনেকেই বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
গাজীপুর থেকে নিয়মিত ঢাকায় যাতায়াত করেন, এমন ব্যক্তিদের নিয়ে রয়েছে ‘গাজীপুর-ঢাকা ট্রেন প্যাসেঞ্জার ফোরাম’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ। ১৬ সেপ্টেম্বর সজিব তুহিন নামের একজন গ্রুপে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। ক্যাপশনে লেখেন—‘আজ জামালপুর কমিউটার ট্রেনে গাজীপুর যাচ্ছিলাম। ৯টা ২০ মিনিটে টঙ্গীর বনমালা লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে যেতে কয়েকজন ছিনতাইকারী চলন্ত ট্রেনে মোবাইল টান দেয়। একজনের হাতে পাথরও ছিল। জয়দেবপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত প্রতিনিয়ত চলন্ত ট্রেনে ছিনতাই, ছিনতাই থেকে হত্যা ও পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। গাজীপুরের প্রশাসনকে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখার অনুরোধ করছি।’
ঢাকার এয়ারপোর্ট থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ছয় থেকে সাতটি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে জয়নাল আবদুল্লাহপুর, বউবাজার, মিরাশপাড়া, নতুন বাজার, মাজারটেক বস্তি, বনমালা, হায়দ্রাবাদ, সুকন্দিরবাগ, ধীরাশ্রমসহ কিছু জায়গা উল্লেখযোগ্য। এসব জায়গায় রেললাইনের পাশেই ওত পেতে থাকে কিছু ছিনতাইকারী, দুর্বৃত্ত।
২৫ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দেখা যায়, কেউ একজন ট্রেনের জানালার পাশে বসে মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করছেন। রেললাইনের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে চার কিশোর। ট্রেনটি তাদের কাছে যেতেই চারজনই একসঙ্গে মুঠোফোনটি (যে ভিডিও ধারণ করছিলেন) ছিনিয়ে নিতে থাবা দেয়। পরে তিনি সরে গিয়ে শেষ রক্ষা পান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার এয়ারপোর্ট থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ছয় থেকে সাতটি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে জয়নাল আবদুল্লাহপুর, বউবাজার, মিরাশপাড়া, নতুন বাজার, মাজারটেক বস্তি, বনমালা, হায়দ্রাবাদ, সুকন্দিরবাগ, ধীরাশ্রমসহ কিছু জায়গা উল্লেখযোগ্য। এসব জায়গায় রেললাইনের পাশেই ওত পেতে থাকে কিছু ছিনতাইকারী, দুর্বৃত্ত। কোনো কারণে ট্রেনের গতি কমলে বা সিগন্যাল পড়লে ট্রেনের জানালার পাশে থাকা ব্যক্তিদের মুঠোফোন, গয়না বা অন্য জিনিসপত্র নিতে টান দেয়। এতে অনেক সময় ঘটে দুর্ঘটনা। মূল্যবান জিনিস হারান অনেকে।
এ ছাড়া রেল জংশন খোলামেলা বা বহিরাগতের আনাগোনায় বাড়ছে ঝুঁকি। বিশেষ করে গাজীপুরের টঙ্গীর রেল জংশনটি সবচেয়ে বেশি খোলামেলা। জংশনটিতে কোনো শক্ত নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই। অনেকটা চারদিক থেকেই খোলামেলা। ফলে সারা দিনই জংশনটিতে থাকে বহিরাগতের আনাগোনা। চলে প্রকাশ্যে মাদক সেবনও। এতে যেমন যাত্রীরা বিব্রত হন, থাকেন দুর্ঘটনার ঝুঁকিত
রাকিবুলের মৃত্যুর পর তাঁর সহকর্মী আকবর আলী মুঠোফোনে প্রথম আলো কে বলেছিলেন, ‘সামান্য একটা মোবাইলের জন্য এভাবে প্রাণ যাওয়াটা দুঃখজনক। যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার থাকলে এ সমস্যা হতো না।’ ফেসবুক গ্রুপে ভিডিওটি আপলোড হওয়ার পর অসংখ্যবার শেয়ার হয়। পড়ে লাইক, কমেন্টও। এর মধ্যে হাসান হাবিব নামের একজন লেখেন, এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। সমাধানে কখনোই কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি।
জয়দেবপুর রেল জংশনের স্টেশনমাস্টার মো. শাজাহান বলেন, ‘আমাদের কাছে অনেক সময় যাত্রীরা এসব নিয়ে অভিযোগ করে। আমরা বিষয়গুলো রেলওয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবগত করি। এর বাইরে আমাদের স্টেশন এলাকায় সব সময় নিরাপত্তা জোরদার থাকে।’
ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রকিবুল হোসেন বলেন, এই দুর্বৃত্তদের ধরার জন্য সব সময় চেষ্টা চলছে। ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কারও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ঢিল ছোড়ার ব্যাপারে লোকজনকে সতর্ক করা হচ্ছে।
সূত্রঃ প্রথম আলো