গাজা-ইসরাইল যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়বে। এখন পর্যন্ত যা অবস্থা তার ফলাফল হিসেবে ঘটনার ধারাবাহিকতা সেদিকেই যায়। মুসলিম জাহানে শিয়া-সুন্নি মাযহাবের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সমাপ্তির ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণ অপেক্ষা করছে ফিলিস্তিনের পবিত্র মাটিতে। তবে তা সরকার পর্যায়ে কার্যকর হবে নাকি জনগণ পর্যায়ে- সেটার জন্য আরো অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় দেখছি না।
৭ অক্টোবর ২০২৩ সাল। হামাসের ‘অপারেশন আল আকসা স্টর্ম’ ইসরাইলের উপর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আঘাত। দখলদার ইসরাইল সৃষ্টির পরে যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে সবগুলোর ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের একটুকরো শত্রুবেষ্টিত জমি গাজা এই প্রতিরোধ শুরু করেছে। এমন এক শত্রুর বিরুদ্ধে এই মজলুমের যুদ্ধ, সেই শত্রুরা হলো পৃথিবীর জন্মের পরে এখন পর্যন্ত সর্বাধিক শক্তিশালী শাসকদের ঐক্যবদ্ধ জোট। সম্মিলিত ইসরাইল-পশ্চিমা বাহিনীর সকল ঐক্যবদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে হামাস, ইসলামী জিহাদ, হিজবুল্লাহ এবং তাদের অন্যান্য সহযোগী প্রতিরোধ ফ্রন্টকে নিয়ে বীরদর্পে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে সম্মিলিত আরব জোট শিশু ইসরাইলের সামনে ৬ দিনের বেশি টিকতে পারেনি। সেই বিচারে হামাস এবং সহযোগীরা অনেক বেশি শক্তিশালী। মোদ্দাকথা আল্লাহর দয়া প্রাপ্ত। আরবের পশ্চিমা মদদপুষ্ট তৎকালীন সেকুলার সরকাররা আরব জাতীয়তাবাদের পতাকা নিয়ে ইসরাইলের সাথে যুদ্ধ করে প্রত্যেকটাতেই শোচনীয়ভাবে হেরেছে। জাতীয়তাবাদ দিয়ে ধর্মযুদ্ধ হয় না। জাতীয়তাবাদের পরিচয়ের যুদ্ধে শক্তিশালী হিটলারও জিততে পারেনি।
হিজবুল্লাহ মহাসচিব সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহর বক্তব্য শুনতে প্রতীক্ষায় ছিলেন সমগ্র দুনিয়ার মজলুমেরা। তিনি হতাশ করেননি। তাঁর বক্তব্যে চমক ছিল না; গভীরতা ছিল, মিথ্যা আশ্বাস- গালভরা বুলি ছিল না; বুদ্ধিদীপ্ত, প্রয়োজনীয়, ভ্রাতৃত্বসুলভ নিশ্চয়তা ছিল। আর ছিল সব সময় সর্বাবস্থায় একইভাবে পাশে থাকার ওয়াদা।
আগামীকাল যদি নাসরুল্লাহ ঘোষণা দেন, ইসরাইলের সাথে তিনি সম্পর্ক রক্ষা করে বাণিজ্য করতে চান, সারা দুনিয়ার মুসলমানদের শুধু মাত্র ত্রান দিয়ে সহযোগিতা করতে চান; তাহলে আমৃত্যু লেবাননের ক্ষমতায় থাকার জন্য সব ব্যবস্থা ইসরাইলই করে দেবে। ইসরাইলের দরকার অথর্ব, বাকপটু, মোনাফেক মুসলিম সরকার। যারা মুসলমানদের বলবে আমি তোমাদের বন্ধু, কাফেরদেরও বলবে আমি তোমাদের বন্ধু। তুরস্কসহ আরব দেশগুলোর বেলায় আমরা তাই দেখি।
দীর্ঘমেয়াদে যারা ওইসব দেশগুলোতে আছে তাদের সবাইকে ইসরাইলের সাথে আঁতাত করেই থাকতে হয়। সেটা কম বা বেশি। তুরস্ক গণতান্ত্রিক হওয়ায় জনগণের চাপে অনেক কথা বলতে হয়। বাস্তবতা অন্যরকম। ক্ষমতায় থাকাই যখন মুখ্য তখন তাদের কাছে মুসলিম উম্মাহ কিছু আশা করতে পারে না। আশা করা উচিতও না।
সৌদি, আমিরাত, মিশর, তুরস্ক, জর্দান, বাহরাইন, কুয়েতের সেই ক্ষমতা নেই ইসরাইলের বিপক্ষে সত্যি সত্যি অস্ত্র ধরবে। বরং তারা বিগত কয়েক দশকে এমন সংস্কারকৃত ধর্মীয় প্যারাডাইম সৃষ্টি করেছে যা তাদের মসনদের নিরাপত্তা দেবে ধর্মীয়ভাবে। সেই প্যারাডাইম ছড়িয়ে দিতে দেশে দেশে অনুদান, মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ, তথাকথিত স্কলার তৈরি এবং তাদের প্রচারে কাড়ি কাড়ি পেট্রোডলার ঢালছে। এমন এক ইসলামিক প্যারাডাইমের পাটাতন তৈরি করছে, যেখানে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ অনুপস্থিত। হক-ইনসাফের আলাপ নিরুদ্দেশ। ফলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইসলামের চর্চা এবং বিশেষ করে বিভাজন, বিতর্ক, অনৈক্য, মতভেদকেন্দ্রিক ফতোয়ার ইসলামে রুপান্তরের মহাযজ্ঞ চলছে। এতে মুসলমান এমন এক বিভাজনের ইউটোপিয়ার ভেতরে ঢুকে গেছে, একজন মুসলমান আক্রান্ত হলে বা বিপদে পড়লে আগে খোঁজ করে তার আক্বিদা কী। অথচ ইসলাম শিখিয়েছে প্রতিবেশীকে সহযোগিতা করো। প্রতিবেশীর ধর্মীয় পরিচয় সেখানে গৌণ।
আরব জাহান বিগত দশকগুলোতে এই বিশ্রী ইসলামিক প্যারাডাইমের উপর আমাদের দাড় করিয়েছে। তাদের দেয়া শিক্ষা গ্রহণ করলে হামাসের পাশে কাউকে পাওয়া যাবে না। আর সুন্নি হিসেবে হামাসকে ধরা হলে বাকি সুন্নিরা আজ কোথায়? চারপাশের ডজনখানেক সুন্নিদেশ কেন হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না। আসলে ইসলাম কি শিয়া-সুন্নি আইডেন্টিটিকে সমর্থন করে! ইসলাম কোনো বিভাজনকেই সমর্থন করে না। সারা দুনিয়ার সুন্নিরা আজ অপেক্ষায় নাসরুল্লাহ কী বলবেন, ইরান কী করবে। এই অর্জন কোন তাত্ত্বিক প্যারাডাইমের ফলাফল না। নেতৃত্ব আল্লাহ তাকেই দেবেন যিনি সত্যিকারের দায়িত্ব নেবেন। সাইয়েদ নাসরুল্লাহ তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
তিনি পশ্চিমাদের পরিষ্কার বলেছেন, তাদের উপরও হামলা হবে। ভূমধ্যসাগরের যুদ্ধজাহাজের জন্যও তিনি আপ্যায়নের পূর্ণ প্রস্তুতি রেখেছেন এবং গাজার বিজয় না আসা পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে। এতটুকু বলার হিম্মত তাবৎ দুনিয়ার কোন শাসকের হয়েছে, কেউ বলতে পেরেছে এখন পর্যন্ত?
এই কথাগুলোকে এনালাইসিস করলে বোঝা যায়, হিজবুল্লাহ যুদ্ধের ভেতর আছে তো বটেই আরো বড় পরিসরে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হিজবুল্লাহ, হামাসের সাথে সমন্বয় করে কাজ করছে। নাহলে যুদ্ধ কতদিন চলবে সেই সিদ্ধান্ত হয় উনি দিতেন না; নাহয় এড়িয়ে যেতেন। উনি পরিষ্কার করেছেন, গাজার বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে। এতে আরো বোঝা যায় দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধের প্রস্তুতি তাদের আছে এবং একাধিক ফ্রন্ট থেকে এই যুদ্ধ জারি থাকবে। তারমানে ইসরাইলকে গাজার বাইরে আলাদা আলাদা ফ্রন্টেও দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধ করতে হবে। অবশ্য যুদ্ধ শুরু হতে না হতেই ইসরাইল পশ্চিমের কাছে অস্ত্র চেয়েছে। এতে তার সামরিক অস্ত্রের সরবরাহ সক্ষমতার আভাস পাওয়া যায়।
জনাব নাসরুল্লাহ ২০০৬ সালের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, হিজবুল্লাহর হাতে বন্দী দুই জন ইহুদি সৈনিককে ফেরত নিতে কোন আলোচনা ছাড়াই ইসরাইল ঢুকে পড়েছিল। তারা কোন আপোষ না করে শুধুমাত্র ক্ষমতা দিয়ে সফল হতে চেয়েছিল এবং সেই যুদ্ধ চলেছিল ৩৩ দিন। তেত্রিশ দিনের সেই যুদ্ধে ইসরাইল পরাজিত হয়ে ফিরেছে।
সে সময় যুদ্ধ যখন চলে তখন উম্মাহ এক হতাশার ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু রাহবার বলেছিলেন, যুদ্ধে হিজবুল্লাহর বিজয় হবে। ইনশাআল্লাহ হয়েছেও তাই। গাজার বিষয়েও রাহবারের একই মত ইনশাআল্লাহ হামাস বিজয়ী হবে।
হামাস যদি ইসরাইলের উপর বিজয়ী হয় তাহলে আরব দুনিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় রমকের ঝাঁকুনি লাগবে। বিশেষ করে রাজতন্ত্রে। জনতাকে জুজুর ভয় দেখিয়ে, পশ্চিমের কাছে সবকিছু বন্ধক রেখে হয়তো আর টেকা যাবে না। অতএব হামাসের দীর্ঘমেয়াদের যুদ্ধে সুদুরপ্রসারি ফলাফল অপেক্ষা করছে। যা আরব শাসকদের বিপক্ষেই যাবে যদি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হামাসের পাশে না দাঁড়ায়।
ইসরাইল হামাসের সাথে যুদ্ধে না পেরে জনগণকে হত্যা করছে। প্রকাশ্য গণহত্যা চালাচ্ছে। এভাবে কি ফিলিস্তিনিদের ভীত করা যাবে? পৃথিবীর ইতিহাসে মোঙ্গলদের দেখা যেত জনগণকে হত্যা করতে। সেই কাজটা করছে ইসরাইল। পশ্চিমের মদদে এবং আরবদের মৌন সম্মতিতে এই অপরাধ তারা করেই যাচ্ছে। দুনিয়া নির্বিকার। এরমানে কেউ আসবে না।
হয়তো আরব শাসকেরা মনে করছে, হামাসের বিজয়ে তাদের সুদূরপ্রসারী ক্ষতি হবে তাই ফিলিস্তিনকে তারা সহযোগিতা করছে না। হামাসের চাইতে বরং তারা ফাতাহকে বেছে নেবে। অথর্ব ফাতাহর নেতৃত্বে ফিলিস্তিনকে রাখতে পারলে আরব দুনিয়া নিরাপদ। তাই ফাতাহকে দিয়ে আলোচনা আলোচনা খেলা শুরু করতে পারে। ইয়াসির আরাফাত সারাজীবন এই খেলার কুশীলব ছিলেন। এভাবে সময়ক্ষেপণের ইতিহাস বহু পুরোনো। সেই ৪৮ সাল থেকে আলোচনার খেলাধুলা চলছে। আজো কার্যকর কিছু হয়নি।
ফাতাহ মূলত প্রো-ইসরাইলি দল। মাহমুদ আব্বাসের সরকার চলে ইসরাইলের অর্থায়নে। তাদের কাছে ইউরোপের অনুদানও আসে ইসরাইলের হাত দিয়ে। ফাতাহও চায় না হামাস বিজয়ী হোক। পুরো ফিলিস্তিনকে নেতৃত্ব দিক। এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের ভিতরে মানবেতর জীবন-যাপন করছে ফিলিস্তিনি জনগণ। অত্যাচারিত মুসলমান জিহাদ করবে এটাই তার কাজ। হামাস সেটাই করছে।
হাসান নাসরুল্লাহ তাঁর বক্তব্যে একটা কৌশলগত দিক উল্লেখ করেছেন। তা হচ্ছে লেবানন সীমান্তে ইসরাইলের পূর্ণ ক্ষমতার একটি বড় অংশকে নিয়োজিত করে রাখছে ইসরাইল। ইসরাইলের উত্তরাঞ্চল খালি করে সেখানে আইডিএফ-এর বড় একটা অংশ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। হিজবুল্লাহ বুক দিয়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর করা আঘাতের ভাগ নিচ্ছে। এতে পূর্ণ শক্তি নিয়ে গাজায় অভিযান চালাতে পারবে না জায়নবাদী দেশটি। ইরাক, সিরিয়ার প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাদের ফ্রন্ট থেকে ইসরাইীর সমর্থকদের উপর হামলা অব্যাহত রেখেছে। ইসরাইলকে ইয়েমেনের হুতির দিকেও নজর দিতে হচ্ছে।
এতগুলো ফ্রন্টে দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধ করার নৈতিক সাহস ও অভিজ্ঞতার ইতিহাস ইহুদিদের নেই। এই যুদ্ধ যদি এক-দুই বছর চলে। তাহলে ফিলিস্তিনে যোদ্ধা ছাড়া আর কোন নাগরিক থাকবে না। নাগরিকদের যেকোনভাবে বের করে নেয়া হবে। দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের ফলাফল হবে ইউক্রেনের মত। ইসরাইলের পেছন থেকে তার মিত্ররা একে একে সরে যাবে। ইতিহাস বলে ইহুদিদের কার্যকলাপে একসময় সবাই মুখ ফিরিয়ে নেয়। সেই সময়টা হয়তো আসছে। আরবের সাধারণ নাগরিকও অপ্রচলিত যুদ্ধে অংশ নেবে। যাকে আমরা ভলান্টিয়ার সার্ভিসও বলতে পারি। এছাড়া ইসরাইলের ভিতরে টানা মাসের পর মাস হামলা হতে থাকলে বহু জনজাতির ইহুদি নাগরিকেরা কি ওখানে বসবাস করতে চাইবে, মনে হয় না।
ফিলিস্তিনের যুদ্ধকে আর দশটা দুনিয়াবী যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের সংজ্ঞার আলোকে দেখার সুযোগ নেই। এটা পরিষ্কার ধর্মযুদ্ধ। মুসলিম মাত্রই এই যুদ্ধে অংশ নিতে হবে। তবে মুনাফিকের কথা আলাদা। প্রচলিত সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান দিয়ে ফিলিস্তিন ইস্যুকে বিচার-বিশ্লেষন করা যাবে না। ফিলিস্তিন তাদের হাতেই বিজয় হবে যারা ওই জমানার সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত দল। যারা সত্যের উপর থাকবে না তাদের কাছে আল্লাহর তরফ থেকে কোন সাহায্য আসবে না। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া ফিলিস্তিনে কোন মুসলিমেরই বিজয় সম্ভব নয়। এই কথা প্রমাণের জন্য ফিলিস্তিনের ইতিহাসই যথেষ্ট।
এ পর্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যতটুকু বিজয় এসেছে সেগুলোও প্রতিরোধ যোদ্ধাদের দ্বারাই এসেছে কোন আরব দেশের দ্বারা নয়। এই আশায় বুক বাঁধা যায় আমাদের যোদ্ধারা ঈমান ও ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। তাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যই জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ। মুমিনের বিজয় ও সাফল্যের মাপকাঠি দুনিয়ার সরল সংজ্ঞা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যায় না। আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত ইনশাআল্লাহ।#
লেখক: প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক